বাংলাদেশ ইস্যুতে অতি সক্রিয় বিজেপি কি তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসাবে?
BJP on Bangladesh: 'হিন্দু'-দের ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বিজেপি-আরএসএস-এর নেতৃত্বে বিশাল বিশাল সমাবেশে ক্রমেই ভিড় বাড়ছে।
ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত চোখ রাখলে, কান পাতলে একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে ইচ্ছে করবে প্রবল। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করবে যে, বাংলাদেশ আর ভারত আসলে যুযুধান। দুই ধর্মের মানুষ একে অন্যকে পেলেই শায়েস্তা করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা দায়। বাংলাদেশের বা ভারতের সীমান্তের মানুষজন কি তেমনই আতঙ্কে আছেন বাস্তবে? সত্যিই কি ভারতের কেউ বাংলাদেশে গেলেই তাঁকে ওদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা পাকড়াও করছে, হুমকি দিচ্ছে, অত্যাচার করছে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভ্রান্তিমূলক খবর ছড়িয়ে বিদ্বেষ বাড়ানোয় অগ্রভগে রয়েছে ভারতীয় সংবাদমাআধ্যম। ওদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন যা ঘটেছে, তা নতুন কিছুই নয়। এর আগেও চিরকালই যেমন সমস্ত দেশে সংখ্যালঘুরাই থাকেন নিশানায়, তেমনটাই সত্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। এই ঘটনাগুলিও বিচ্ছিন্নই।
স্ক্রোলডটইন সম্প্রতি একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদনে বাস্তবের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বনগাঁর একটি গ্রাম শিমুলতলার বাসিন্দা প্রসেনজিৎ দাস হামেশাই বাংলাদেশ সফর করেন, হয় আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে বা ব্যবসায়িক কাজে। ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট অবধি অটো করে গিয়ে তারপর পায়ে হেঁটেই সীমানা পেরোন তিনি। গত ৫ অগাস্ট ঢাকায় শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও এভাবেই যাতায়াত করেছেন প্রসেনজিৎ।
স্ক্রোলডটইন-কে তিনি বলেছেন, “আমি ২০ নভেম্বর পর্যন্ত ১০ দিন ঢাকায় ছিলাম। আমি কোনও সমস্যার সম্মুখীন হইনি।" তাহলে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর, বিশেষ করে হিন্দুদের উপর হামলার খবর কি ভুয়ো? এপার বাংলার বহু মানুষের আত্মীয়দের বাসা সীমান্তের ওপারে। ১৯৭১ সালে খুলনা ও যশোর জেলা থেকে লক্ষাধিক বাঙালি হিন্দু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে এপারে পাড়ি দেন। তাঁরা ঐতিহাসিক যশোর রোড ধরে রওনা দেন বাংলাদেশ থেকে বনগাঁ হয়ে কলকাতা পর্যন্ত। এই পরিবারের মধ্যেই ছিল প্রসেনজিৎ দাসের পরিবারও।
আরও পড়ুন- সীমান্তে মায়ানমারের সশস্ত্র গেরিলা অভ্যুত্থান আদৌ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত?
খবরের চ্যানেলে চিৎকার শুনে প্রতিবেশী দেশের সাম্প্রতিক হিংসা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন তিনি। তবে পার্শ্ববর্তী যশোর ও খুলনা জেলায় তাঁর আত্মীয়রা বলছেন, সমস্যা হচ্ছে না কোনও। "আমার আত্মীয়রা আমাকে বলছেন যে তাঁরা তেমন সমস্যার সম্মুখীন হননি। সরকার পতনের পর মাদ্রাসার লোকেরাই হিন্দুদের মন্দিরগুলিকে রক্ষা করেছিল কিন্তু এখন বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনা শুনি। তাই আমরা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন,” স্ক্রোলডটইন-কে বলছেন প্রসেনজিৎ। তাঁর মতে, ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী চট্টগ্রামের দিকেই অশান্তি বেশি। সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস একটি ধর্মীয় কেন্দ্রের প্রধান।
পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকার অনেক মানুষই বলছেন, সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ভারত সরকারকে বাংলাদেশের ওপর কূটনৈতিক চাপ দিতে হবে। তারা মনে করছেন, ভারত সরকারের আরও সোচ্চার হওয়া উচিত আরর হিন্দুদের পক্ষে কথা বলা উচিত। বলা বাহুল্য, এই বাংলায় ভারতীয় জনতা পার্টি নিজেকে সেই একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসাবে তুলে ধরতে সফল হয়েছে যারা নাকি হিন্দুদের জীবন নিয়ে সত্যিই চিন্তিত। বাংলাদেশের এই ইস্যুর পরে গত কয়েক সপ্তাহে, বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে রাজ্য জুড়ে ২০ টিরও বেশি বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছেন। তাঁর বক্তব্যে ভয় ছড়ানোর প্রবণতা রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি এড়ায়নি।
বনগাঁ থেকে ১০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে আছে পেট্রাপোল সীমান্ত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর এক বড় স্থলবন্দর। ডিসেম্বরের শুরুতেও সুতির কাপড়, যানবাহন এবং মোটর যন্ত্রাংশবাহী ট্রাকের ভিড় ছিল সেখানে। তবে সীমান্ত অতিক্রমকারী মানুষের সংখ্যা অবশ্য তুলনামূলকভাবে কম ছিল।
আত্মীয়দের সঙ্গে ভারতে দেখা করতে এসেছিলেন তাদের বাংলাদেশের যশোর জেলার বাসিন্দা চৈতনা সিকদার। তিনিও স্ক্রোলকে জানিয়েছেন, বাড়ির পরিস্থিতি উদ্বেগজনকই। "কিন্তু হামলা এমন কিছু ব্যাপক নয়। কিছু জায়গায় হিন্দুদের বাড়ি ও মন্দিরে হামলা হয়েছে, সবগুলোয় নয়। কেউ কেউ এই অশান্তিকে তাদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা বা জমি দখলের জন্য ব্যবহার করেছে,” স্পষ্ট বলছেন তিনি। তিনি বলছেন, সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয় তো আছেনি। "তাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে ভারতে আসতে চায়। দুই দেশের উগ্র বক্তব্যও পরিস্থিতি খারাপ করসে," বলছেন চৈতন্য। পেট্রাপোল এবং এর আশেপাশের এলাকায় বসবাসকারী বাঙালি হিন্দু পরিবারগুলিও সীমান্ত বাণিজ্যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উত্তেজনার প্রভাব নিয়ে চিন্তিত৷
“যারা আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার উপর নির্ভরশীল তাদের আয় শূন্য হয়ে গেছে। এখান থেকে প্রতিদিন ৫,০০০-৭,০০০ লোক বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশে যেত এবং একই সংখ্যক লোক ভারতেও আসত। এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে,” বলছেন চৈতন্য। পেট্রোপোলের কাস্টমস ক্লিয়ারিং বিভাগ জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন ভ্রমণকারীর সংখ্যা প্রতিদিন ১,০০০-এরও কম। মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় ছিল যাদের তা এই কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে পড়ে ১০,০০০ টাকায় নেমে এসেছে।
এই সমস্ত আবহে বিজেপি বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিয়েছে। গত ২ ডিসেম্বর, অখিল ভারতীয় সন্ত সমিতির ব্যানারে পেট্রাপোল সীমান্তে একটি পদযাত্রায় পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ১,০০০ জনেরও বেশি সন্ন্যাসী অংশ নিয়েছিলেন। এই পদযাত্রার নেতৃত্বে ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। বনগাঁ উত্তরের বিধায়ক এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের বিজেপি নেতা অশোক কীর্তনিয়া বলেছিলেন, এটি কোনও রাজনৈতিক ডাক বা অনুষ্ঠান ছিল না তবে বিজেপিই ছিল এই বিক্ষোভের পিছনে মূল চালিকা শক্তি। সীমান্তের প্রতিটি ওয়ার্ড ও গ্রামে বিজেপি সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করছে।
বিজেপির দাবি, মানুষই নাকি তাঁদের প্রশ্ন করছে যে, বিজেপির নেতৃত্বে থাকা সত্ত্বেও ভারত সরকার কেন হিন্দুদের বাঁচাতে পদক্ষেপ করছে না? বিজেপিই নাকি মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, কেউই অন্য স্বাধীন দেশে আক্রমণ করতে পারে না। বিষয়টা নিয়ম মেনেই স্থিতিশীল করতে হবে। তবে 'হিন্দু'-দের ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বিজেপি-আরএসএস-এর নেতৃত্বে বিশাল বিশাল সমাবেশে যে ক্রমেই ভিড় বাড়ছে তা অস্বীকার করার জায়গা নেই।
আরও পড়ুন- হাসিনার পাশে নেই ভারত? বাংলাদেশ নিয়ে ক্রমেই স্পষ্ট অবস্থান
এই সমাবেশগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি নেতারা বাংলায় বসবাসকারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলছেন বলে অভিযোগ। স্থানীয়দের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, "মুসলিমদের সঙ্গে কথা না বলার জন্য, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার জন্য অনুরোধ করছে বিজেপি। বিক্ষোভ বাংলাদেশি হিন্দুদের নিয়ে ছিল না। বিজেপির উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তারা এখানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ঘটাতে চায়।”
এই সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের অনেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। এদের কাছে বরাবরই বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা আছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হওয়া হিন্দুরা বাংলায় বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়নের ধারণা নিয়ে এখন তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু পরিবারগুলিকেও বিজেপি নিজের দিকে টানার চেষ্টা করছে, বলছেন বিশ্লেষকরা। বিজেপি আরেকটি মতামত পাশাপাশি গড়ে তুলছে। বাংলায় ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস কেন এই নিপীড়নের প্রতিবাদ করছে না? প্রতিবেশী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলা দরকার ছিল বলেই মনে করছেন সীমান্তের এই মানুষরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে অশান্তি বিজেপির পক্ষে হিন্দুদের জোট বাঁধানোর কাজকে সহজতর করছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলিম নেতারা এবং সুশীল সমাজের মুসলিম সদস্যরা যদি বাংলাদেশে হিন্দু গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাহলেই একমাত্র বিজেপির এই হিন্দু একত্রীকরণকে প্রতিহত করা যেতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা এও বলছেন যে, হিন্দুদের একত্রীকরণ এবং ভোটের ফলাফলের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই কারণ পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সাফল্য অনেকাংশে সাংগঠনিক শক্তির উপর নির্ভর করে। বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠনকে এখনও ততটা টক্কর দিতে পারে না।