মদ, মাংস এবং ... হোটেল-রিসর্টময় শান্তিনিকেতন এখন যেখানে দাঁড়িয়ে
Shantiniketan Hotels & Resorts: আমোদগেঁড়ে শহুরে বাঙালি এই অঞ্চলে পৌঁছেই মদের দোকানে ছোটে। ক্যানাল পাড়ে, সামান্য বেঁচে থাকা জঙ্গলে, খোয়াইয়ের আনাচেকানাচে, কোপাইয়ের ধারে চলে মোচ্ছব।
যখন কম বয়সে এসেছি, তখন শান্তিনিকেতন এতটা উচ্চকিত ছিল না। এখানে মানুষ আসত একটা নিরিবিলি প্রকৃতির খোঁজে। তারা মূলত বিশ্বভারতীর চারপাশ দেখত, শান্তিনিকেতনে ঘুরে বেড়াত। জঙ্গল দেখত, খোয়াই দেখত, কোপাই নদী দেখতে যেত। ক্যাম্পাসের ভেতরে থাকা নানা বিখ্যাত শিল্পীর ভাস্কর্য, ফ্রেস্কো, ম্যুরাল, আর রবীন্দ্রনাথের তৈরি বাড়িগুলি ছিল প্রধান আকর্ষণ। তখন পর্যটকদের সংখ্যা যথেষ্টই কম ছিল। বেশি দিন নয়, এই দু'চার দশক আগের কথা। কিন্তু শান্তিনিকেতন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর ক্রমে আমূল পরিবর্তন হতে শুরু করল। ভিড় বাড়ল, হোটেল বাড়ল, রিসর্টের ঢল নামল আর ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠল হোমস্টে। শান্তিনিকেতন হয়ে উঠল ফস্টি-নস্টি করার বিনোদনের শ্রীক্ষেত্র। তার সঙ্গেই ঘোষিত হলো 'হেরিটেজ'। তাতে যে মূল শান্তিনিকেতন (যা আসলে হেরিটেজ) দেখতে সাধারণ মানুষ উৎসাহিত হলো, তা কিন্তু নয়। তা হওয়ার কথাও নয়। কেননা ইতিমধ্যেই বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসে প্রবেশে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
বেশ কয়েক বছর সিকিমে কাজ করার সূত্রে দেখেছি, সেখানে সারা ভারত থেকেই অসংখ্য পর্যটকদের আসা-যাওয়া সম্বৎসর লেগে আছে কিন্তু এমন বিশৃঙ্খলা নেই। স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে রাজ্যব্যাপী। যার কোনও ছিটেফোঁটাও নেই শান্তিনিকেতনে। মেলা-উৎসবের সময় রাজ্য ও বিশ্বভারতীর প্রশাসন খানিকটা নড়েচড়ে বসে। সেখানেও পরিকল্পনার অযুত ফাঁক। মূল লক্ষ্য হলো আমদানি। কে কত টাকা নানাভাবে তুলে নিতে পারে। পরিষেবার কথা কেউ ভুলেও ভাবে না। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কোনওরকম ভাবেই নিয়মকানুনের ধার ধারে না। শুধু কামিয়ে নাও। এখন মেলা আর উৎসবেই শুধু নয়, সারা বছরেই ট্যুরিস্ট আসছে। বিশেষ করে শনি-রবিবার। কখনও কখনও পুরো বোলপুর মহকুমা শহরই যেন ট্যুরিস্টদের বাসভূমি হয়ে উঠছে। তাদের মূল আকর্ষণ সরকারের বদান্যতায় বা সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় গোটা তিনেক হাট। হাট নিয়ে অন্য পর্বে লিখব। এখন বলি ট্যুরিস্ট আর হোটেল রিসর্ট নিয়ে।
আরও পড়ুন- রবিঠাকুরের গানের সুর বদলে দিয়েছে শান্তিনিকেতনের মুরুব্বিরা
বোলপুর, আশেপাশের জেলা ও বিশেষ করে কলকাতার প্রোমোটারকুল আদিবাসীদের ও গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের থেকে নানা ছলাকলায় জমি হাতিয়ে তৈরি করছে অসংখ্য হোটেল ও রিসর্ট। যার বাড়বৃদ্ধি অপ্রতিহত। গ্রামের মধ্যে, বাইরে, জঙ্গলের মধ্যে, কোপাইয়ের ধারে এমনকী সীমালঙ্ঘন করে অর্থে খাস ও ফরেস্টের জমি দখল করে গড়ে উঠেছে এবং ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে বেআইনি রিসর্ট ও হোটেল। এর বেশিরভাগটাই রাজনৈতিক মদতপুষ্ট। এখানে সবুজপত্র নামে একটি রিসর্ট কাম বাংলো তৈরি হয়েছে একশো বিঘার ওপর জমিতে। রিসর্ট সংলগ্ন প্রায় সাড়ে চারশো বাংলো আছে। এই বিস্তীর্ণ এলাকাটাই স্থানীয় আদিবাসীদের। এখন তারা আন্দোলন শুরু করেছে। জমি ফেরত চাইছে। চাইলেই কি ফেরত পাওয়া যায়? এই রিসর্টের মালিকের রাজনৈতিক অনুষঙ্গ থাকার ফলে কিছুই করা যাচ্ছে না।
আসলে এটা একটা ঘটনাই উল্লেখ করলাম মাত্র। এখানে প্রায় ৮০ শতাংশ রিসর্টই বেআইনি। তা নিয়ে বহু লেখালিখি হয়েছে, দু-একটা নিউজ চ্যানেল দেখিয়েছেও কিন্তু তাতে কিচ্ছুটি হয়নি। যেমন সোনাঝুরি হাটের মধ্যে বন দফতরের জমিতেও তৈরি হয়েছে নানা মাপের হোটেল, রিসর্ট, রেস্তোরাঁ। প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই। এইসব তথাকথিত রিসর্টে ব্যবস্থাপনার হাল খুবই খারাপ। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তাও নয়। কিন্তু যেটা বলতেই হবে, সারা বছর একরকম ভাড়ার রেট হলেও মেলা উৎসবের সময় চাহিদা অনুযায়ী তা পাঁচ-সাত গুণ বাড়িয়ে দেয় এগুলোর মালিকেরা। সে সময় বোলপুর, শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতনের বাজারে আগুন খেলা করে। বিশেষ করে শনি-রবিবার ট্যুরিস্ট আসার কারণে। অটো চালকদের আবদার তখন তুঙ্গে পৌঁছয়। স্থানীয়দের অবস্থা তখন রীতিমতো নাজেহাল। আরেকটি নতুন বিষয় কয়েক বছর ধরে শুরু হয়ছে। তা হলো, ঝাড়খণ্ড থেকে আসা বিয়েবাড়ির পার্টি। এখানকার রিসর্ট ভাড়া করে অনুষ্ঠান করা এখন 'ফ্যাসান'। চরম হল্লোড়, আতশবাজি ফাটানো, মধ্য রাত পর্যন্ত তারস্বরে ডিজে বাজানো এখন নিত্যকার বিষয়।পুলিশে ফোন করলে একটি শব্দই কর্ণগোচরে পৌঁছয় "দেখছি"। ব্যাস, এরপর ফোন রেখে দেওয়া হবে। ওই যে লিখেছি, সরকারি কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এইভাবেই চলছে বছরের পর বছর।
এবার আসি ট্যুরিস্টদের দৌরাত্ম্যের কথায়। আমোদগেঁড়ে শহুরে বাঙালি এই অঞ্চলে পৌঁছেই মদের দোকানে ছোটে। ক্যানাল পাড়ে, সামান্য বেঁচে থাকা জঙ্গলে, খোয়াইয়ের আনাচেকানাচে, কোপাইয়ের ধারে চলে মোচ্ছব। এ যেন নেশা করার জায়গা, যা ইচ্ছে তাই করার চারণক্ষেত্র। চারদিকে প্লাস্টিক আর বোতল। দূষণের চূড়ান্ত। এরপর আরেকটা দিক হলো, দলবদ্ধ হয়ে গাড়ি বা টোটো নিয়ে সাঁওতাল গ্রাম পরিদর্শনের পালা। সেও মহা উৎপাত! এরা শান্তিনিকেতনের আশেপাশের গ্রামগুলোতে হাঁড়িয়া খেয়ে হুজ্জুতি, বচসা করে। সাধারণ গ্রামের মানুষ তাতে একেবারে অতিষ্ঠ। এর সঙ্গে আছে সেলফি বিহার। রান্নাঘরে ঢুকে পর্যন্ত ছবি তোলে। কোনও অনুমতি নেওয়ার বালাই নেই।
ফলন্ত ক্ষেতে ছুটে বেড়ায়। ধানগাছ নষ্ট করে, তার ওপর পোজ দিয়ে ছবি তোলা এখন তো নব্য শহুরেদের আদত হয়ে গেছে। তা নিয়ে গ্রামের লোকেদের সাথে ঝগড়াঝাটি, হাতাহাতির খবর পর্যন্ত পাওয়া যায়। ক্ষেত নষ্ট হচ্ছে, দরিদ্র কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু কে শুনবে কার কথা! বসন্ত উৎসবের সময় সমস্ত পলাশ গাছের ডাল ভেঙে সাজার জন্য ফুল সংগ্রহ তো প্রায় মাৎসন্যায়ের পর্যায় চলতে থাকে। আচ্ছা এসব বিষয় কি শুধু প্রশাসনের দোষ ধরলে চলবে? এ তো যাকে বলে বাঙালির মূল্যবোধের চূড়ান্ত অধোগমনের নয়া ধারাপাত! এর থেকে কী করে রক্ষা পাওয়া যাবে?
আরও পড়ুন-ক্রমে জমি জালিয়াতিতে ডুবে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সাধের শান্তিনিকেতন
এবার এই পর্ব শেষ করব আরেকটি মারাত্মক তথ্য দিয়ে। আগেই লিখেছি যে, কলকাতা থেকে তিন-সাড়ে তিনঘণ্টা গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় এখানে। ট্রেনে আরও কম সময় লাগে সেক্ষেত্রে। আশেপাশের জেলা থেকেও বহু লোক আসে। এর সঙ্গে আছে ঝাড়খণ্ড থেকে আসা লোকজনও। এই সুবাদে একটা নতুন ব্যবসা শান্তিনিকেতন তথা বোলপুরে গজিয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত মাত্রায় মানুষ এখানে সস্তা বিনোদনের কারণে আসছে প্রায় সারা বছর। আগে যেটা ছিল না বললেই চলে। তথাকথিত পর্যটকদের আসা ও সামগ্রিকভাবে বোলপুর মহকুমার বিভিন্ন গ্রামের অর্থনৈতিক দুরবস্থা হেতু একটা ভালো সংখ্যক কম বয়সি মেয়েরা এখানে রাস্তায় নেমে এসেছে। আছে মাঝ বয়সি মহিলারাও। বোলপুর ডাকবাংলা মাঠের ধারেকাছে গেলেই এদের দেখা যায়। আর দেখা যায় শ্রীনিকেতন হয়ে সিউড়ি যাওয়ার রাস্তার ধারে জঙ্গলের সামনে। সারাদিনই তারা থাকে। সন্ধ্যার সময় সংখ্যাটা বাড়ে। এরা সব যৌনকর্মী। এদের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে স্থানীয় আড়কাঠি ও বেশ কিছু রিসর্ট ও হোটেলের। সমস্ত ব্যবস্থাপনা তারাই করে দেয়। ঘটনা হলো এই ব্যবসা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে এখন সোনাঝুরি হাটকেও স্পর্শ করে ফেলেছে।
কিছুদিন আগে এই হাটের মধ্যেই বেআইনি হোটেলে নীল ছবির শুটিংয়ের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। দু-চারদিন সেই হোটেল বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে স্থানীয় মাতব্বরদের দৌলতে খুলে যায়। সে গল্প সোনাঝুরি হাটের পর্বে বিস্তারিত বলা যাবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা তাহলে এই শান্তিনিকেতনে কোথায় এসে পৌঁছলাম আর কোথায় ছিলাম। আর কোথায়ই বা যাচ্ছে ভবিষ্যতের তাহাদের শান্তিনিকেতন?