জাতপাত ব্যবস্থা থেকে মুক্তির বড় উপায় গাজনের সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া

Gajan Festival: কৃষি দেবতার মৃত্যু, পুনর্জন্ম ও বিবাহের উৎসবকে ঘিরেই প্রাচীন ধর্মানুষ্ঠান গাজন। সূর্য ও পৃথিবীর যৌন মিলনকে প্রতীকায়িত করেই স্থাপন করা হয় চড়ক গাছ।

SG

"চাইলেও আমি গাজনের সন্ন্যাসী হতে পারব না" — বলেই একটু থামলেন সুশান্ত পণ্ডিত। বয়স ২৫। হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার চকরুহিত গ্রামে বড় হয়েছেন। বর্তমানে কর্মসূত্রে থাকেন গুজরাতের অঙ্কলেশ্বরে।

"আমি যে কাজটা করি সেটাকে বলে লেটার রাইটিং ওয়ার্ক। বড় বড় অয়েল ট্যাঙ্ক, গ্যাস চেম্বার, ভেসেল, পাইপের গায়ে ছোটবড় হরফে তথ্য আঁকাই আমার কাজ। এখানে কাজে যোগ দেওয়ার আগে হোল বডি চেক আপ করা হয়, মেডিক্যাল টেস্ট হয়, পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়। গায়ে যদি কাটা চিহ্ন থাকে, ক্ষত চিহ্ন থাকে আপনি এখানে কাজ পাবেন না। ওরা ধরে নেবে আপনার পূর্ব অপরাধ কিছু আছে, বা আপনি অপরাধ করতে পারেন, তাতে কোম্পানি সমস্যায় পড়বে। তাই ফাইনাল ভেরিফিকেশনে কাটা, ক্ষত চিহ্ন দেখেই বাতিল করে দেয় আবেদনকারীকে। এবার কেউ যদি গাজনের সন্ন্যাসী হয়, শরীরটাকে নিয়ে তো যা খুশি করবে। বাণ ফুঁড়বে, শালে ভর দেবে, গায়ে-হাতে পেরেক লোহার শিক ঢুকিয়ে সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড। আর সেই চিহ্ন থেকেই যাবে।"

কোম্পানির শাসনকালেই গাজনের রক্তারক্তি কাণ্ড নজর কাড়ে মিশনারিদের। ভক্ত সন্ন্যাসীদের আচার আচরণ বন্ধ করতে তারা আইনের দ্বারস্থ হলে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ বাংলার ছোটলাট বিডন আইন জারি করে গাজনে বাণফোঁড়া, চড়ক গাছ থেকে ঝোলা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করেন। আজ যে সচরাচর চৈত্রের গাজনে বাণফোঁড়া, চড়ক গাছ থেকে পিঠে কাঁটা বিঁধিয়ে ঝোলা দেখাই যায় না, তার কারণ ওই আইন। কোম্পানির শাসন শেষ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে; সে আইনও বলবৎ আছে। আর নতুন যুগের নতুন কোম্পানি নতুন শর্ত আরোপ করেছে কর্মচারীর জন্য— দেহে কাটা ক্ষতের চিহ্ন থাকলে আপনি আবেদন করার যোগ্য নন। একই নিয়মে অযোগ্য একজন শিয়া মুসলমান কারণ কারবালার স্মৃতিতে তিনি মহরমে সরাসরি অংশ নেন; দেবতা মুরুগানের তামিল ভক্তও অযোগ্য, কারণ তিনি মেতে ওঠেন থাইপুসাম উৎসবে; অযোগ্য একজন কেরলের কালী ভক্ত, যদি তিনি মাতেন গ্রুদান থক্কানে –কারণ এই সব আচার অনুষ্ঠানের অন্যতম শর্ত যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করা।

সুশান্ত পণ্ডিত

জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ না হলেও সুশান্তের পরিবার বহুকাল আগে লৌকিক পূজারি ব্রাহ্মণের দায়িত্ব পালন করত। সেই দায়িত্ব পালন করতে হলে তামা ধারণ করতে হতো; তা করলে কোদাল লাঙলে হাত দেওয়া যেত না আজীবন। তার দাদুর আমলে অভাব এমন পর্যায়ে যায় যে রোজ কোদাল লাঙলে হাত না দিলে দুটো ভাত জুটত না। দাদু দেয়াশিনী বৃত্তি ছেড়ে বরাবরের চাষি হয়ে গিয়েছিলেন। নিজস্ব মন্দির ছেড়ে উঠে এসেছিলেন চকরুহিত গ্রামে। আজ ভাগ্যান্বেষণের কারণে নাতি ভিনদেশে। দুশো বছরের প্রাচীন বুড়ো শিবের গাজনে উপস্থিত থাকতে না পারলেও ফোন করে খোঁজ খবর নিতে ভোলেন না সুশান্ত। ফোনেই কথা হচ্ছিল আমাদের। যে সুশান্ত নিজের রুজিরোজগারের প্রয়োজনেই গাজনের সন্ন্যাসী হবেন না কোনওদিন, তিনি কীভাবে দেখছেন এই যন্ত্রণা উপেক্ষা করে নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করার বিষয়টিকে?

"সন্ন্যাসী হলে একটা সম্মান পাওয়া যায়। সেই দেখাদেখি সবাই করে। সব জাতের মানুষ সন্ন্যাসী হতে পারে। সেটাও একটা দিক। শরীর দুর্বল হয় অনেকের কিন্তু সেই যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে ওরা। একটা নেশা। সবাই করছে, আমিও করব। আমি যে করছি না তাতে দুঃখ নেই। ভক্তি মনে মনেও করা যায়। আমাদের বাতানলের সেরা আকর্ষণ সন্ন্যাসীদের যিশুখ্রিস্ট হওয়া। মানে একদম যিশুর মতো দু-হাত দু'দিকে থাকবে, শরীরটা মাঝখানে থাকবে। যেমন করে যিশুকে ক্রুসবিদ্ধ করা হয়েছিল! তেমনি করে বড় কাঠের উপর হাত ছড়িয়ে ভক্তদের শুইয়ে পেরেক দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়। মানে গোটা বডিটা ধারে ধারে চামড়ার উপর দিয়ে পেরেক গেঁথে আটকে দেওয়া হয়। সার দিয়ে এইভাবে সবাই যিশু সেজে ইঞ্জিন ভ্যানের উপর হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা সব দু'মাস তিন মাস আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। যদি আগের বছর দুটো শিক গাঁথে, এবছর চারটে শিক গাঁথবে। যারা মানত করে সন্ন্যাসী হয় তারা জিভে বাণ ফোঁড়ে। আমার বন্ধু সন্তু কর্মকার। ও হিরে সেটিংয়ের কাজ করত। বাইরে ছিল। এ বছর ভক্ত হয়নি, কিন্তু ও যিশু হয়েছিল সন্ন্যাসী হয়েছিল গত বছর। ছবি পাঠাচ্ছি দেখবেন। ওরা এসব হাসতে হাসতে করে। রাত গাজনের পরের দিন, মানে চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকালের এই প্রসেশনটা যদি না দেখেন, বুঝতে পারবেন না ভক্তরা কতটা যন্ত্রণা সহ্য করে।"

সন্তু কর্মকার

নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ খেয়াল করেছে ফসলের মৃত্যু এবং পুনর্জন্মকে। পশুপালনের পর্ব অতিক্রম করে পুরোদস্তুর খাদ্যউৎপাদকের ভূমিকায় এগিয়ে গিয়ে কৃষিকাজ শুরু করেছে সে। শস্য বীজ যেমন করে ছড়িয়ে পড়ে এক থেকে বহু হয়, তেমনই আকাঙ্খা কাজ করেছে তার মনে। বীজ বোনা থেকে ফসল কেটে আনার পর সেই ফসলের মতোই মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম স্বাভাবিক মনে করেছে তারা কৃষিদেবতার জীবন কল্পনায়। কৃষি দেবতার মৃত্যু, পুনর্জন্ম ও বিবাহের উৎসবকে ঘিরেই প্রাচীন ধর্মানুষ্ঠান গাজন। সূর্য ও পৃথিবীর যৌন মিলনকে প্রতীকায়িত করেই স্থাপন করা হয় চড়ক গাছ। গাজনে চড়ক গাছ পুঁতে সন্ন্যাসীদের পাক খাওয়ার রীতি আসলে সূর্যের গতিপথকে অনুসরণ করার চেষ্টা মাত্র। অনুকরণমূলক জাদু বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য চড়কের প্রতিটি অনুসঙ্গে এইভাবে জড়িয়ে আছে এখনও। গোষ্ঠীস্মৃতিই বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাচীন এই ধারাটিকে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে ‘উত্তরখণ্ড’ অংশে যে শিবপূজার বিধিনির্দেশ বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে পুরাণকথক লিখছেন,

“চৈত্রমাসে কী ক্ষত্রিয় কী বৈশ্য কী শূদ্র সকলেই জিতেন্দ্রিয় হইয়া ত্রিসন্ধ্যাস্নান ও রাত্রিকালে হবিষ্যান্নভোজন; এইরূপে দেহপীড়নপূর্ব্বক নৃত্যগীত মহোৎসব সহকারে ভক্তিপূর্ব্বক শিবোৎসব করিবে; ইহা দেবদেবের পরমপ্রীতকর। ইহা করিলে শিবত্বলাভ ও পদে পদে অশ্বমেধের ফল হইয়া থাকে।”

"গতবছর ভক্ত হয়েছিলেন ৭২৩১ জন, তার আগের বছর ভক্ত হয়েছিলেন প্রায় ৬৬০০ জন, এ বছরে কত জন হয়েছেন বলতে পারা যাবে আগামিকাল সূর্যার্ঘ দেওয়া শেষ হলে। আজ সন্ধ্যায় সূর্যার্ঘ দেওয়া শুরু হয়েছে। সবমিলিয়ে এবছর প্রায় ৭০০০ ভক্ত ছাড়িয়ে যাবে মনে হয়।" এই বছর বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর থানার ডিহর গ্রামের ষাঁড়েশ্বর বাবার গাজনে ভক্ত হয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্দীপন চক্রবর্তী। সূর্যোদয় থেকে জলপান করতে পারেননি। প্রথা মেনে সূর্যার্ঘ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন উপবাস ভাঙতে। সেইটুকু সময়েই কথা বললেন তিনি —

"আমি এই নিয়ে পাঁচবার ভক্ত হলাম। প্রথমে নদীঘাটে যাই। নদী মানে দ্বারকেশ্বর নদী। প্রথা মেনে সবাই পৈতে ধারণ করেন, উত্তরীয় নেন। তারপর মন্ত্র নিতে হয়— আত্মগোত্র পরিত্যাজ্য, শিবগোত্র প্রবেশিত — এর মানে ভক্তের গোত্র-কূল-জাত সব চলে গিয়ে শিবগোত্রে প্রবেশ হলো। সবাই এক হয়ে গেল। এ বছর মনে হয় ভক্তের সংখ্যা ৭০০০ ছুঁয়ে ফেলবে। আমার বয়স ৩৯ হলো, জ্ঞানত ষাঁড়েশ্বর বাবার গাজনে এমন ভক্তের সংখ্যাই দেখে আসছি। আকাঙ্খা নিয়েই তো সবাই আসে। পূরণ হলে আস্থা বেড়ে যায়। স্থানীয় বিষ্ণুপুর, জয়কৃষ্ণপুর, বসন্তপুর, ডিহর এলাকার মানুষই মূলত ভক্ত হন। তবে মানত করলে দূরদুরান্ত থেকেও ভক্ত হন অনেকে। এখানে বাণফোঁড়া, আগুনের উপর দিয়ে হাঁটা এসবের প্রচলন আছে, কিন্তু চড়ক হয় না।"

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া থানার হরশঙ্করপুরের হাটে শ্রীশ্রী কৈলাসেশ্বর জিউ মন্দিরের গাজনে এই বছর ভক্ত হয়েছেন তপন ঘরা। বয়স ৫৫। পুত্রের মঙ্গল কামনায় ভক্ত হয়েছিলেন, এখন গ্রামের যে ১৬ জন সন্ন্যাসী মূল দায়িত্ব পালন করেন তাদের একজন হয়ে উঠেছেন তিনি। তিনি জানালেন,

"আমাদের পাঁশকুড়া থানার ১৬টা অঞ্চল। হাউর অঞ্চলে ২৫টা গ্রাম। এখানের দুটো গ্রামে গাজনে খুব ধুম। আমাদের এখানে যেমন চৈত্রে গাজন হয় আবার বৈশাখে গাজন হয় পুরুল গ্রামে। শিবের কাছে মানত করে মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে বলেই তো ভক্ত হয়। আর একটা আনন্দ আছে। এখানে নির্বাক নৃত্য বলে একটা অনুষ্ঠান হয়, সবাই খুব আনন্দ উপভোগ করে। পৌরাণিক কাহিনি থেকে নেওয়া সব, কথা থাকে না। যেমন মহিষাসুর বধ, শিব-দুর্গা এইসব। তারপর পঁচিশ ফুট উপর থেকে বঁটিঝাঁপ হয়। মন্দিরের সেবাইত অশোক মিশ্র দায়িত্ব পালন করেন। ওই ১৬ জন সন্ন্যাসী ঘট স্থাপন করে। ওটাই নিয়ম। আবার ওরাই সংক্রান্তির দিনে শিবালয় পুকুর থেকে চড়ক কাঠ তোলে। ওরাই পাক খায়। আগের চেয়ে জল ঢালা ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে দিন-দিন। গড়ে ৩০-৫০ জন ভক্ত হয় নারী পুরুষ মিলিয়ে। এই বছর ভক্ত হয়েছেন ২০ জন।"

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার শ্রেষ্ঠ উৎসব গাজন। কাকদ্বীপ থানার মধুসূদনপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ৬ নং লক্ষ্মীপুর গ্রামে এই বছরের গাজনে বাজেট পঞ্চাশ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে যেখানে অনেক গ্রামে গাজন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেখানে তারা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। গ্রামের গাজন গানের দলের ম্যানেজার মনোজ ধাড়া। তাঁর হাতেই অর্থ তুলে দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তিনি জানালেন,

"গত দু' বছর একটু গাজনে ভাটা চলছিল। করোনার প্রভাবটা ছিল। মানুষের হাতে টাকা ছিল না। এই বছর দেখছি সবাই উঠেপড়ে লেগেছে। এই এলাকায় প্রায় সব পাড়ায় গাজন দল তৈরি হয়। আমরা প্রতি আসরে গান করতে যাই। তাদের পাড়ার দল আমাদের এখানে এসে গান করে যায়। এটা বহুদিনের ঐতিহ্য। আমরা তোমার কাছে গান করে এলাম, তুমি আমার কাছে এসে গান করে যাও। গান বিনিময় হলো। সেই জন্য কেউ কারও সঙ্গে টাকা পয়সা নিই না। যদি আমি কুড়িটা পাড়ায় গেয়ে আসি, সেই কুড়িটা পাড়ার টিম আমাদের পাড়ায় গান গেয়ে যাবে। এইটাকে সবাই বলে ‘দেল ভেড়া’। আমরা বলি ‘ঢাল শোধ করাকরি’।”

প্রগতি গীতিনাট্যের অন্যতম অভিনেতা রাজীব গাজন গাইছেন ছোটবেলা থেকেই। ছ’বছর গাজন গেয়ে ভাগ্যানুসন্ধানে চলে গিয়েছিলেন আহমেদাবাদ। সেখানে ছিলেন দশ বছর। সাত বছর গ্রামে কাটিয়ে তিন বছর হলো আবার ফিরে গেছেন আহমেদাবাদে সোনার কাজে। এই প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন,

“এখন কাজ ছেড়ে কয়েক বছর হলো দেশে চলে এসেছি। গাজন করছি। আগের সেই মনোভাবটা ফিরে পেয়েছি। এতে আমার খুব আনন্দ। এই যে আমরা মেয়েছেলে সাজি, সারাদিন খুব কষ্ট হয়। রোদে মাঠে হেঁটে হেঁটে গাঁয়ে গাঁয়ে যাই কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে আনন্দ উপভোগ করি তো। গরমের কষ্টটা বুঝতে পারি না। ওই পাড়ার দল কেমন করল, ওদের থেকে আমরা ভালো করব। এটাই। আমার মা কেন স্ত্রী কেন, ওরাও চায় আমি গাজনটা করি। কারও বাড়ি থেকে বারণ কিছু নেই। চৈত্র মাসের এই ক'টা দিন আমাদের গাজন স্টাফেদের খুব আনন্দ। তখন সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যাই। খুব মেহনত করি এমনিতে সারাদিন। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পরে আমাদের রিহার্সাল করতে হয়। রাত বারোটা, একটা, দুটো পর্যন্ত। সকালবেলা আবার যে যার কাজে বেরিয়ে যাই। কেউ ভাটায় কাজ করি, কেউ বাতাসা ফ্যাক্টরিতে। পানের বরজ। ভ্যান টানি কেউ। জনমজুর খাটে অনেকে, সবার তো জমি নেই।’’

৬ নং লক্ষ্মীপুরে এই বছরের পালা লিখেছেন স্থানীয় হাইস্কুলের পার্শ্ব শিক্ষক মানস ধাড়া, পালার নাম ‘জন্ম রক্তে জননী পূজা’ — নারী পাচারকে কেন্দ্র করে লেখা এই নাটকে শেঠজি চরিত্রে অভিনয় করছেন মিঠুন অধিকারী। কলকাতায় সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেন তিনি। পনের দিনের ছুটি নিয়ে গ্রামে ফিরে রিহার্সাল দিয়ে তৈরি করেছেন নিজেকে, মেতে উঠেছেন গাজনে। নারী চরিত্রে অভিনয় করে নাম করেছেন সূর্য কয়াল, মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেই রিহার্সালে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

ফরাসি নৃতাত্ত্বিক লুই ডুমন্ট তাঁর অনন্য কাজ ‘হোমো হায়ারারর্কিসাস’ (১৯৬৬)-এ দেখিয়েছিলেন ভারতীয় হিন্দু সমাজে ‘কাস্ট’ ব্যবস্থা থেকে মুক্তির একটা বড় উপায় সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া। গবেষক অনিকেত দে দেখিয়েছেন, ‘গাজনের সন্ন্যাসী’ও সামাজিক জাত ব্যবস্থা ও জল-অচল প্রথার বিরুদ্ধে এক নীরব বার্তা প্রেরক। সে সাময়িক সময়ের জন্য সন্ন্যাসী হলেও তার আত্মত্যাগ ও যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই কারও। ভদ্রবৃত্ত ও শাসকের চোখে তাই এত সন্দেহ তাকে ঘিরে। এই অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে এই ছোট্ট প্রতিবেদনে এটুকুই বলতে চাইলাম যে, গাজনের লোকাচারে, ধর্মানুষ্ঠানে আছে সমাজ সম্মিলনের, ভাব বিনিময়ের, আত্মপ্রকাশের ও আমোদ প্রমোদের উপকরণ। সেই অমূল্য উপকরণগুলিই আসলে বঞ্চিত, নিপীড়িত, অন্ত্যজের জীবনের চালিকা শক্তি, টিকে থাকার রসদ।

More Articles