"আকাশে কেঁপেছে বাঁশিসুর, আঁচলে উড়েছে ময়ূর"। এই চিত্রকল্পটা রঞ্জন পেয়েছিল ওঁর প্রেমিকার থেকে।
চৈত্রের কাফন উড়িয়ে বিদায় নিয়েছিল মণিদা
Choitrer Kafon Moheener Ghoraguli: গানটা শুরু হচ্ছে এমন একটা মিউজিক দিয়ে যেন কোনও সিমেট্রির মধ্যে গানটা হচ্ছে। একটা বিষণ্ণ সুর বাজছে। যেন কেউ মারা গেছে, সকলে জড়ো হয়েছে সেই ফিউনেরালে।
১৯৭৩ সাল। টনি অর্ল্যান্ডো আর ডন একটা গান রেকর্ড করেন। মার্কিন দেশ, যুক্তরাজ্য জুড়ে ওই রেকর্ড ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল সেই সময়। গানটা ছিল, টাই আ ইয়েলো রিবন রাউন্ড দ্য ওলে ওক ট্রি। গানের বিষয়টা ছিল খানিক এমন, জেল থেকে একজন প্রেমিকাকে চিঠি লিখছে। জানাচ্ছে যে, তার মুক্তির দিন সমাগত। সে জানতে চাইছে, এই দীর্ঘসময় জেলে কাটিয়ে যখন সে আবার ফিরবে, তখন কী কী তার রইল, কী কী চিরতরে হারিয়ে গেল? প্রেমিকাকে লিখছে, খবর পেয়েছো তো ছাড়া পাচ্ছি? তুমি কি এখনও আমাকে ভালোবাসো? অপেক্ষা করো? যদি আমাকে এখনও ভালোবাসো, তাহলে গ্রামের মুখে যে ওক গাছটা আছে, সেখানে একটা হলুদ রিবন বেঁধে দিও। আমি বাসে করে ফিরব, গাছটা দেখতে দেখতে। যদি দেখি কোনও হলুদ রিবন নেই, আমি আর বাস থেকে নামব না। অবশেষে মুক্তি পেয়ে সে গ্রামের পথে ফেরে। বাসের কনডাক্টরকে বলে, দেখো তো ওই দূরে ওক গাছে একটা হলুদ রিবন বাঁধা আছে কিনা দেখতে পাচ্ছো? দেখতে পেলে জানিও, আমি তাকাব না। গ্রামের কাছাকাছি আসতে বাসশুদ্ধ লোক আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে। দেখা যায়, একটা কই! সেই ওক গাছে বাঁধা আছে অজস্র হলুদ রিবন!
গল্পটা রঞ্জন ঘোষালের মুখ থেকেই শোনা। মহীনের ঘোড়াগুলির রঞ্জন। সদ্য চৈত্রের কাফন গানটা লিখেছে তখন। রঞ্জনের দাদার সূত্রে এই টাই আ ইয়েলো রিবন রাউন্ড দ্য ওলে ওক ট্রি গানের রেকর্ডটি ওর হাতে আসে। সেই গানটা শুনেই রঞ্জন চৈত্রের কাফন গানটি লেখে। লেখার সঙ্গে সঙ্গেই সুর দিয়েছিলাম। আমাদের মহীনের ঘোড়াগুলির নতুন গান চৈত্রের কাফন ১৯৭৯ সালে দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি অ্যালবামে প্রকাশ পায় ভারতী রেকর্ডস থেকে। রঞ্জন গানটায় অবশ্য লিখেছিল, "চলে যাই, বলেছিল চলে যাই"। 'বলেছিলে' লেখেনি। এব্রাহাম একটা ইন্ট্রো বাজিয়েছিল কীবোর্ডে। গানটা শুরুর আর শেষের সময় সেই অংশটা রাখা হয়। ওই অংশটা আবার কম্পোজ করেছিল বিশু, আমার ছোট ভাই। তখন অবশ্য কে কোনটা করেছে তা লেখা হতো না। শুধুই মহীনের ঘোড়াগুলির গান, আমাদের সকলের গান।

রঞ্জন ঘোষাল
সে যাই হোক, গানটার দ্বিতীয় অংশে একটা লাইন আছে। "আকাশে কেঁপেছে বাঁশিসুর, আঁচলে উড়েছে ময়ূর"। এই চিত্রকল্পটা রঞ্জন পেয়েছিল ওঁর প্রেমিকার থেকে। পরে সে স্ত্রী হয়, সঙ্গীতা। সঙ্গীতা একদিন একটা শাড়ি পরেছিল, যার আঁচলে ছিল ময়ূর আঁকা। শুধু এই অংশটা নয়, গোটা গানটায় একটা নরম রোম্যান্টিসিজম আছে, আবার সেটা থেকে হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়াও আছে। একেবারে শেষে, "সে বুঝি শুয়ে আছে চৈত্রের হলুদ বিকেলে, সেখানে চূর্ণ ফুল ঝরে তার আঁচলে"। পরের লাইনেই হঠাৎ আঁচল বদলে গিয়ে হচ্ছে কাফন। যে চূর্ণ ফুল আঁচলের উপর খসে পড়ছিল, সেগুলিই ঝরে পড়ছে কাফনের উপর। এবার ফিরে আসি, গানের নামে। চৈত্রের কাফন। বিষণ্ণতা, কাফন, সুরের মধ্যে এক কান্না, হলুদ আলোর মায়া — সব মিলে গানটা একইসঙ্গে রোম্যান্টিক, একইসঙ্গে চরম রুক্ষ।
আরও পড়ুন- খবরের কাগজ বলেছিল বাঁদরের নৃত্য, গান নয়, ইতিহাস হয়ে থেকে গেল মনিদার কাজ
যে গেছে বনমাঝে চৈত্র বিকেলে
যে গেছে ছায়াপ্রাণ বনবীথিতলে,
যে গেছে ছায়াপ্রাণ বনবীথিতলে।বন জানে অভিমানে গেছে সে অবহেলে
যে গেছে অশ্রুময়, বন-অন্তরালে
যে গেছে অশ্রুময়, বন-অন্তরালে।
আকাশে কেঁপেছে বাঁশিসুর
আঁচলে উড়েছে ময়ূর
চলে যাই, বলেছিল চলে যাই
মহুল তরুর বাহু ছুঁয়ে
যে গেছে অশ্রুময়, বন-অন্তরালেসে বুঝি শুয়ে আছে চৈত্রের হলুদ বিকেলে
সেখানে চূর্ণ ফুল ঝরে তার আঁচলে
সেখানে চূর্ণফুল ঝরে তার কাফনে।
আরও পড়ুন- ‘ভিনদেশি তারা’ গৌতমদার জন্য গাইব ভেবে রেখেছিলাম
গানটা আগে লেখা হয় তারপর কম্পোজিশন তৈরি হয়। গানটা শুরু হচ্ছে এমন একটা মিউজিক দিয়ে যেন কোনও সিমেট্রির মধ্যে গানটা হচ্ছে। একটা বিষণ্ণ সুর বাজছে। যেন কেউ মারা গেছে, সকলে জড়ো হয়েছে সেই ফিউনেরালে। তারপর একটা টুয়েলভ স্ট্রিং গিটারের অংশ। এই ফিউনেরালের অংশ আবার ফিরে আসছে শেষে। মাঝে একটা শোঁ শোঁ হাওয়ার শব্দ আমি দিয়েছিলাম মুখ দিয়েই আওয়াজ তৈরি করে। স্পেনের জিপসিদের সঙ্গীতে ফ্ল্যামেঙ্কো গিটারে এক অদ্ভুত সুর বাজে। সেই সুরের মূর্চ্ছণা রাখতে চেয়েছিলাম চৈত্রের কাফন গানটাতেও। আকাশে কেঁপেছে বাঁশিসুর অংশটার আগে সেটা জুড়তে চেয়েছিলাম, ওই গিটারটা আমিই বাজিয়েছিলাম। রেকর্ডিং শোনার পর বুঝি, আমার নাইলন স্ট্রিং গিটারের তার আর আঙুলের ওঠা নামার একটা অদ্ভুত শব্দ আসছে। রেকর্ডিস্ট বোধহয় ভেবেছিলেন, বিষয়টা আমাদের মোটেও ভালো লাগবে না। বলেছিলেন, এই 'গ্লিচ'-টা মুছে দেবেন। কিন্তু মণিদা বলেছিলেন, "না, এটা থাক, এই হিউম্যান টাচটা থাক।" আমাদের গান, আমাদের সঙ্গীতের এই স্বাভাবিক ছন্দটা আমরা হারাতে চাইনি কখনও।

একেবারে ডানদিকে বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় (বিশু)
মহীনের ঘোড়াগুলির মোট ৮টা গান আমরা প্রকাশ করেছিলাম। প্রতিটা গানই কিন্তু প্রত্যেকটার থেকে আলাদা। রোম্যান্টিক অথচ রোম্যান্টিসিজমকে নস্যাৎ করার প্রবণতা, দুই আমাদের গানে আছে। রোম্যান্টিসজমের মধ্যে দিয়ে অন্য আরেক বাস্তবের কাছে পৌঁছনোর দরজা খোলা আছে গানে। হায় ভালোবাসি গানটার কথাই ধরি। অতসব ভালো লাগার জিনিসের কথা বলে তারপর মন খারাপ হওয়ার কথা। কেন কিছুই ভালো লাগছে না আসলে, সেই বাস্তবটা খোঁজার নেপথ্যে একটা রেবেল মাইন্ড কাজ করেছে। আসলে সত্তর দশক পরবর্তী সময়টাকে এভাবেও তো ধরা যায়। হয়তো সেটা একটা ব্যর্থতা ছিল। আবার সেই সময়টা, সেই আন্দোলনটাই আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। সত্তরের দশক, আমাদের পরবর্তী দশকগুলোকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছে। আন্দোলনেরর স্বপ্ন, আর রক্তাক্ত স্বপ্নভঙ্গ দুই তো দেখেছি আমরা।

আব্রাহাম মজুমদার
এই চৈত্রের কাফন গানটা নিয়ে একটা শেষ কথা বলে যাই। মণিদাকে (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) যখন আমরা শ্মশানে নিয়ে যাই, চুল্লিতে ঢোকানো হচ্ছে যখন, চারপাশে মহীনকে ভালোবাসার মানুষদের ভিড়। কত কত মানুষ, যারা আমাদের গান ভালোবাসেন, আমাদের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে জুড়ে থেকেছেন, তাঁদের ভিড়। চুল্লিতে ঢোকানোর মুখে সকলে মিলে এই গানটাই ধরেছিল। চৈত্রের বিকেলের যে বিষণ্ণতার কথা আমরা গানে বলতে চেয়েছিলাম, সেই বিষণ্ণতাকেই মূর্ত হতে দেখেছিলাম। যে গেছে বনমাঝে চৈত্র বিকেলে/ যে গেছে ছায়াপ্রাণ বনবীথিতলে — আমরা মণিদাকে চলে যেতে দেখেছিলাম হলুদ বিকেলে এক কাফন উড়িয়ে।