কোভিড যাচাই যন্ত্রে কিস্তিমাত, জাতীয় শিক্ষকের শিরোপা পাচ্ছেন যে বাঙালি
Teachers' Day 2023: পড়ুয়াদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় এই শিক্ষক অধ্যাপনা তো করেনই, তার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার গবেষণায় তাঁর নজির চোখে পড়ার মতো।
মানুষের জীবনে হঠাৎ এক অভিশাপের মতোই নেমে এসেছিল কোভিড অতিমারি। ভেঙে পড়েছিল স্বাস্থ্যব্যবস্থা। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিল মানুষ। লকডাউন কেড়েছিল লক্ষ মানুষের পেশা, জীবিকা। সেই পরিস্থিতি থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে আনতে প্রত্যেকে যে যার মতো করে চেষ্টা করেছেন। কেউ মুমূর্ষের মুখে জুগিয়েছেন অক্সিজেন, তো কেউ পৌঁছে দিয়েছেন হাসপাতালে। বিজ্ঞানীরা নিরন্তর পরিশ্রম করে গিয়েছেন নিজেদের অস্ত্র হাতে। করোনা নির্ণয়ের যন্ত্র থেকে কোভিডের ভ্যাকসিন, সহজ ছিল না সেই পথ। তবু তাঁরা তা করে গিয়েছেন অনর্গল। যেমন করেছিলেন খড়্গপুর আইআইটির অধ্যাপক সুমন চক্রবর্তী। কীভাবে সস্তা দামে মানুষের হাতে তুলে দেওয়া যায় কোভিড নির্ণয় যন্ত্র, তা তৈরি করতে লাগাতার লেগে থেকেছেন সুমনবাবু। আর সেই পরিশ্রমই এনে দিয়েছে বিরাট সম্মান।
শিক্ষক দিবসে তাঁর কাছে এসেছে জাতীয় শিক্ষকের শিরোপা। এক জন অধ্যাপকের জন্য এর চেয়ে ভালো পুরস্কার, ভালো সম্মান আর কী-ই বা হতে পারত! এই প্রথমবার উচ্চশিক্ষায় জাতীয় শিক্ষক সম্মান দিচ্ছে দেশ। আর সেই শিরোপা জিতে নিলেন খড়্গপুর আইআইটির অধ্যাপক সুমন চক্রবর্তী। পড়ুয়াদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় এই শিক্ষক অধ্যাপনা তো করেনই, তার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার গবেষণায় তাঁর নজির চোখে পড়ার মতো। অতিমারির সময়ে যখন করোনা পরীক্ষার জন্য অসুস্থ শরীরে সরকারি হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরছেন, সেসময়ই সুমন চক্রবর্তী বানিয়ে ফেলেছিলেন নির্ভুল করোনা পরীক্ষার ক্ষুদ্র এক যন্ত্র, তাও আবার কম খরচে। আর তাঁর এই অবদানই তাঁকে এনে দিয়েছে জাতীয় শিক্ষকের শিরোপা।
বিজ্ঞানে দেশের সর্বোচ্চ 'শান্তিস্বরূপ ভাটনগর সম্মান' ইতিমধ্যেই সুমনবাবুর ঝুলিতে। ২০২২ সালে পান ইনফোসিস পুরস্কারও। এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে এল জাতীয় শিক্ষকের খেতাব। মঙ্গলবার শিক্ষক দিবসে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে জাতীয় শিক্ষকের সম্মান নেওয়ার কথা তাঁর। ওই অনুষ্ঠানের জন্য ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছেন নয়াদিল্লিতে। ইতিহাসে এই প্রথমবার, উচ্চশিক্ষায় কোনও অধ্যাপক জাতীয় শিক্ষকের সম্মান পেতে চলেছেন। মোট ১৩ জন আছেন সেই তালিকায়। সুমনের পাশাপাশি সেই লিস্টিতে জায়গা করে নিয়েছেন আর এক বাঙালি। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স রিসার্চ (আইআইএসইআর)-র অধ্যাপক সায়ম সেনগুপ্ত একই মঞ্চে পুরস্কার পেতে চলেছেন। দেশের পক্ষে তো বটেই, বাংলার জন্যেও এ সংবাদ ভারী আনন্দের।
আরও পড়ুন: সেই শিক্ষকদের কথা মনে পড়লেই ভিতরে টের পাই আস্ত টাইম-মেশিন
সেই আনন্দ ঝরে পড়ল সুমনের গলাতেও। জানালেন, রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সম্মান পাওয়াটাই বড় প্রাপ্তি। ইতিমধ্যেই এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক দফার মুলাকাত সারা হয়েছে সুমনের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গিয়ে পড়ুয়াদের জীবন গড়ে দেওয়াই দায়িত্ব শিক্ষক-অধ্যাপকদের। এই সম্মানের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করবেন আজীবন, জানালেন যাদবপুরের প্রাক্তনী সুমন।
হ্যাঁ, সেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র সুমন। গত কয়েক মাস ধরে রীতিমতো চর্চার শীর্ষে থেকেছে কলকাতার এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রশ্ন উঠেছে তার মেধা নিয়েও। তবে বারবার সমস্ত কথাবার্তার মুখে দাড়ি টেনেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরা। দিন কয়েক আগেই সফল ভাবে চাঁদে পাড়ি দিয়েছে ভারত। ইসরোর ওই চন্দ্রাভিযান প্রজেক্টেও ছিলেন দুই যাদবপুরের প্রাক্তনী। যারা আদতে চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান ৩-র ল্যান্ডারের সফট ল্যান্ডিংয়ের বিষয়টি সামলেছেন। ইসরোর ওই দুই বিজ্ঞানীর পর ফের একবার জাতীয় শিক্ষক সম্মানের মঞ্চে প্রমাণ হয়ে গেল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মোটেও হেলাফেলা করার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় আজও। তা সে নিন্দুকেরা যাই বলুন না কেন!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর ২০০২ সালে খড়্গপুর আইআইটির অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন সুমন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক হলেও তাঁর গবেষণাক বিষয় ছিল ‘ফ্লুইড মেকানিকস অ্যান্ড থার্মাল সায়েন্স’। এর আগে রোগনির্ধারণের বহু যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন সুমন। যেগুলোর মাধ্যমে ডায়াগনস্টিক, সেন্সিং ও থেরাপিউটিকসের জগতে স্বল্পমূল্যের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। করোনাকালে পৃথিবী যখন বিপন্ন, সেসময় ভাইরোলজিস্ট অরিন্দম মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন স্বল্পমূল্যের করোনা পরীক্ষার যন্ত্র 'কোভিব়্যাপ'। তারও আগে রক্তাল্পতা নির্ণয়ে 'হিমো অ্যাপ' নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন সুমনবাবু। গতবছর ১৫ অগস্ট, স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দেশের ৭৫ জন সেরা বিজ্ঞানীকে সম্মানিত করেছিল দেশ। সেই তালিকায় ছিলেন সুমনও।
আরও পড়ুন: ছাত্ররা টেনে নিয়ে গিয়েছিল শিক্ষকের জুড়িগাড়ি, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের যে কাহিনি জানে না অনেকেই
এবার তাঁর মুকুটে যুক্ত হল নতুন পালক। শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতির মতো মূল্যবান কী-ই বা হতে পারে একজন অধ্যাপকের জীবনে। তাই এমন সম্মানে আপ্লুত ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক সুমন চক্রবর্তী।