অনুপ্রেরণা জন আব্রাহাম! ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছিল যেভাবে...

India's Biggest Bank Robbery: ৩১ ডিসেম্বর সকালবেলা, ব্যাঙ্ক খুললে কর্মীদের চোখ কপালে উঠে যায়! ব্যাঙ্কের সব লকার ফাঁকা, মেঝেতে গর্ত এবং দেওয়ালে লেখা ‘জয় মাও’।

৩১ ডিসেম্বর ২০০৭। কেরলের মালাপ্পুরাম জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম চেলেম্ব্র। বর্ষবরণের কয়েক ঘণ্টা আগেই গোটা দেশের শিরোনামে চলে আসে এই ছোট্ট গ্রামটি। কারণ, এই গ্রামে অবস্থিত কেরল গ্রামীণ ব্যাঙ্কে ঘটে যায় এক ভয়াবহ ডাকাতি। এখনও পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক ডাকাতি এটিই। ডাকাতরা ৮০ কেজি সোনা-সহ ৮ কোটি টাকা নগদ নিয়ে চম্পট দেয়। না ছিল পায়ের দাগ, না ছিল আঙুলের ছাপ! ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ এসে দেখে ব্যাঙ্কের মেঝেতে রয়েছে একটি বড় গর্ত এবং দেওয়ালে লেখা ‘জয় মাও’। ওই লেখা দেখে পুলিশ প্রথমে ভেবেছিল এটি নকশালদের কাজ। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর একটি ফোন নম্বর হাতে আসতেই পুলিশ বুঝতে পারে, যাদের আসলে নকশাল ভাবা হয়েছিল তারা নিজেদের ‘ধুম’ সিনেমার জন আব্রাহাম ভাবে।

প্রথমেই তাকানো যাক কাহিনির মুখ্য চরিত্র বাবুর দিকে। ছোটবেলায় গ্রামে খেলনার দোকানে ছোটখাটো চুরি করেই অপরাধের জগতে পা রাখে সে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুরি, ছিনতাই-সহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে নাম জড়াতে থাকে তার। সেই সুবাদে জেল ভ্রমণও হয় বেশ কয়েকবার। এই জেলেই বাবুর সঙ্গে আলাপ হয় তার শাগরেদ শিবুর। সেইসময় বাবু, শিবুকে জানিয়েছিল তার স্বপ্নের কথা। একটা ‘ড্রিম হাইস্ট’ করে সেই টাকা দিয়েই সারা জীবন আয়েসে জীবন কাটানোর স্বপ্ন। জেলে থাকাকালীন দু'জনেই এই একই স্বপ্ন দেখত। তবে জেল থেকে বেরিয়ে বাবুর এই স্বপ্ন খানিক থমকে যায়। বাবুর জীবনে আবির্ভাব হয় প্রেমের, অনিতার। অনিতার বাবা ছিলেন বড়লোক ব্যবসায়ী, ফলত অর্থের আর অভাব ছিল না বাবুর। বিয়ে করে দিব্যি ঘর-জামাই হয়ে যায় সে। তবে এর পাশাপাশি গাঁজা বিক্রির একটি ছোটখাটো কারবারও খুলে বসে সে। এই গাঁজা বিক্রি করতে গিয়েই তার দেখা হয়ে যায় শিবুর সঙ্গে। ফের দু'জনের মনে চাগাড় দিয়ে ওঠে জেলে দেখা সেই স্বপ্ন, দুর্দান্ত ডাকাতি করার স্বপ্ন। তবে কোথায় ডাকাতি করা যায়? অনেক আলোচনার পর দু'জনে মিলে ঠিক করে তারা ব্যাঙ্কে ডাকাতি করবে। বিভিন্ন ব্যাঙ্কে রেইকি করার পর তারা কেরল গ্রামীণ ব্যাঙ্কের চেলেম্ব্র ব্রাঞ্চে ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ব্যাঙ্ক ডাকাতি করার পুরো ছকটা তাদের মাথায় আসে ‘ধুম’ সিনেমা দেখে।

আরও পড়ুন- মুখ না ঢেকেই ডাকাতি! বেপরোয়া ডাকাত ধরতে কলকাতা পুলিশের সঙ্গী ছিলেন বার ডান্সার?

চেলেম্ব্রর সেই কেরল গ্রামীণ ব্যাঙ্ক

চেলেম্ব্র গ্রামের এই ব্যাঙ্কটি নির্বাচনের পিছনে দু'টি মূল কারণ ছিল। প্রথমত, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক হওয়ায় সন্ধ্যের পর এই ব্যাঙ্কে কোনও নিরাপত্তারক্ষী থাকত না। দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্কটি একটি বিল্ডিংয়ের দোতালায়, যার একতলায় একটি প্রায় ডুবতে থাকা রেস্তোরাঁ। এই রেস্তোরাঁ দিয়েই তৈরি হল ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক ডাকাতির ভিত! বাবু এবং শিবু নিজেদের পরিকল্পনায় জুড়ে নেয়, শিবুর পূর্বপরিচিত রাধাকৃষ্ণণ এবং তার স্ত্রী কনকেশ্বরীকে। একতলার রেস্তোরাঁটি যখন বন্ধ হতে বসেছে, সেই সময় রেস্তোরাঁর মালিকের কাছে যায় শিবু। মালিককে সে জানায় মাসে ৯০০০ টাকা এবং অগ্রিম ৫০০০০ টাকা দিয়ে সে রেস্তোরাঁটি ভাড়া নিতে চায়। ব্যবসা এমনিই ডুবছিল, তাই রেস্তোরাঁর মালিক আর 'না' করেননি। কয়েকদিনের মধ্যেই সেখানে নতুন চেয়ার-টেবিল আনিয়ে নেওয়া হয়। জায়গাটির খোল নলচে বদলে যায়। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, রেস্তোরাঁটিকে নতুন রূপ দিতে প্রতিনিয়ত কাজ চলছে সেখানে। কয়েক মাস এভাবেই কাজ চলতে থাকে। বাইরে থেকে সব ঠিকঠাক মনে হলেও ভেতরে হচ্ছিল অন্য ঘটনা। বাবু এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা রেস্তোরাঁর সিলিংয়ে একটি গর্ত করছিল। সেই গর্ত দিয়ে সোজাসুজি ব্যাঙ্কের মেঝে ফুঁড়ে উঠে যাওয়া যাবে।

ব্যাঙ্কের মেঝের সেই গর্ত

৩০ ডিসেম্বর ছিল রবিবার। সেদিনই গর্ত খোঁড়া সম্পন্ন করে তারা। এই গর্তের মধ্যে দিয়ে তারা ঢুকে যায় ব্যাঙ্কের লকারে। সেদিনই ব্যাঙ্ক থেকে ৮ কোটি টাকা নগদ এবং ৮০ কেজি সোনা নিয়ে চম্পট দেয় তারা। পরদিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর সকালবেলা, ব্যাঙ্ক খুললে কর্মীদের চোখ কপালে উঠে যায়! ব্যাঙ্কের সব লকার ফাঁকা, মেঝেতে গর্ত এবং দেওয়ালে লেখা ‘জয় মাও’। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশে ছয়লাপ হয়ে যায় জায়গাটি। ভিড় বাড়াতে থাকে মিডিয়া। জানা যায়, এটিই ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক ডাকাতি। এর আগে ১৯৮৭ সালে খালিস্তানি জঙ্গিরা পুলিশের ছদ্মবেশে এসে জলন্ধরের পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে ৬ কোটি টাকা ডাকাতি করেছিল। সেই রেকর্ড ভেঙে যায় এই ঘটনায়। যথারীতি কেরল পুলিশের উপর চাপ বাড়তে থাকে অপরাধীদের ধরার জন্য। মালাপ্পুরামের এসআই পি বিজয়নের উপর দায়িত্ব পড়ে অপরাধীদের ধরার। দেওয়ালে লেখা ওই স্লোগানের জন্য প্রথম সন্দেহ গিয়ে পড়ে নকশালদের উপর। সেই সময় মালাপ্পুরামে নকশালদের ভালোই আনাগোনা ছিল। সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে পুলিশের তদন্তকে বিপথে চালিত করতে সচেষ্ট হয় বাবু।

আরও পড়ুন- ছিঁচকে চুরি থেকে মুম্বই হামলা, নৃশংস ঘাতক কাসভকে যেভাবে সবক শিখিয়েছিল ভারত

তবে কয়েক দিনের মধ্যেই হায়দরাবাদের একটি হোটেল থেকে তাদের কাছে ফোন আসে। ফোনে জানা যায়, হোটেলের ঘর থেকে বেশ কিছু সোনা উদ্ধার হয়েছে। কেরল পুলিশ সেখানে গিয়ে জানতে পারে উদ্ধার হওয়া ওই সোনা, চুরি যাওয়া সোনারই অংশ। সেই সোনা নিয়ে ফিরতেই, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের কাছে ফোন আসা শুরু হয়। বেশ কয়েকটি জায়গায় গিয়ে পুলিশ খালি হাতে ফিরে আসে। বিজয়ন বুঝতে পারেন, তাদের ঘোল খাওয়াচ্ছে বাবু এবং তার গ্যাং। তিনি চেলেম্রর ওই ব্যাঙ্কের নিকটবর্তী টেলিফোন টাওয়ারের ৩০ ডিসেম্বরের কল রেকর্ড চেয়ে পাঠান। এরপর কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় কুড়ি হাজার কল রেকর্ড খতিয়ে দেখে পুলিশ। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে একটি কল ট্র্যাক করেন, যেখানে বাবু নামক এক ব্যক্তি কথা বলছিল। তদন্ত করে দেখা যায় নম্বরের মালিকের পরিচয় পত্র ভুয়ো। বাবু আসলে এই সময় একটি সিডিএমএ ফোন ব্যবহার করত। এই ধরনের ফোনে কোনও সিম কার্ড লাগে না। এই ফোনই বাবুর ধরা পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পি বিজয়ন এবং তাঁর দল

পুলিশ এই ফোনের নেটওয়ার্ক খোঁজা শুরু করে। খুঁজতে খুঁজতেই পুলিশ পৌঁছে যায় কোঝিকোড়ে, অর্থাৎ বাবুর ডেরায়। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় বাবুকে। ধরা পড়েই শিবুর ঠিকানাও বলে দেয় সে। জানা যায় রাধাকৃষ্ণণের বউ কনকেশ্বরী, তাকে ছেড়ে শিবুর সঙ্গে থাকছে! ডাকাতির ৫৭ দিনের মাথায় গ্যাংয়ের সকলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। চুরি যাওয়া আমানতের প্রায় ৮০ শতাংশ উদ্ধার করে পুলিশ। পাঁচ বছর চলা মামলার পর কনকেশ্বরীর ৫ এবং বাকিদের ১০ বছরের জেল হয়। তবে এক মাসের মধ্যেই জামানত পেয়ে যায় বাবু। জেল থেকে বেরিয়েই আবার একটি গয়নার দোকানে চুরি করে সে। কিন্তু সিসিটিভির দৌলতে এবারও ধরা পড়ে যায় বাবু। এবার তার শাস্তি বাড়িয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করে দেওয়া হয়। শোনা যাচ্ছে, এই ব্যাঙ্ক ডাকাতির উপর একটি সিনেমাও করতে চলেছেন দক্ষিণি পরিচালক মিসকিন, যাতে মুখ্য ভূমিকায় দেখা যাবে মোহনলাল (পি বিজয়ন) এবং ফাহাদ ফাসিলকে (বাবু)।

 

More Articles