সাধারণ অটোচালক থেকে নৃশংসতম খুনি, তিলে তিলে যেভাবে ত্রাস হয়ে উঠল অটো শঙ্কর?
গৌরীশঙ্কর থেকে অটো শঙ্কর হয়ে ওঠার পিছনে কারণ খুঁজতে গেলেই নানা মুনির নানা মত। বাবার বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে প্রচণ্ড দারিদ্র, মানসিক বিকার থেকে লোভ, সমাজের অবহেলা থেকে কিছু স্বার্থপর হোমরাচোমরা ব্যক্তিদের প্রভাব, সবকি...
ব্যর্থ চিত্রকর, মিষ্টভাষী, প্রতিবেশীদের বিপদে পাশে দাঁড়ানো মানুষ, রিকশাচালক, অটোচালক, বেআইনি মদের কারবারি, দেহব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী, বেশ্যালয়ের মালিক, অপহরণকারী, ধর্ষক, ডন, নৃশংস খুনি। একাধিক মানুষ না কি একই মানুষের বিভিন্ন রূপ? অবশ্য যে মানুষ কাউকে খুন করে মাটিতে পুঁতে রেখে সেই বাড়ি এক বৃদ্ধা বিধবাকে ভাড়া দিয়ে অম্লানবদনে মাসে মাসে দেড়শো টাকা ভাড়া নিতে পারে, তার যে অনেক রূপ হতে পারে সেটা বলা বাহুল্য।
১৯৫৪ সালে ২১ জানুয়ারি তামিলনাড়ুর ভেলোর জেলার কাঙ্গেয়ানাল্লুর গ্রামে গৌরীশঙ্করের জন্ম হয়। ছোটবেলায় তার বাবা পরিবারের জমানো বেশিরভাগ টাকা নিয়ে অন্য এক মহিলার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। সাতের দশকে গৌরীশঙ্কর চেন্নাই গিয়ে প্রথমে মায়লাপুর এলাকার এক বস্তিতে বসবাস শুরু করলেও পরে পাকাপাকিভাবে পেরিয়ার নগরে বসবাস শুরু করেছিল। প্রথমে সিনেমার পোস্টার আঁকা এবং অন্যান্য উপার্জনের পথ খুঁজলেও ক্রমে সেই রিকশা এবং পরে মহাবলীপুরম থেকে থিরুভানমিয়ুর অবধি বিভিন্ন এলাকায় সে অটো চালিয়ে পয়সা উপার্জন করত।
মহাবলীপুরমের আশপাশে সমুদ্রের ধারে কিছু গ্রামের মানুষ সেই সময় বেআইনিভাবে দেশি মদ তৈরি করত। গৌরীশঙ্কর সেই খবর পেয়ে অটোর মধ্যে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে দেশি মদ চালান করা শুরু করেছিল। এই একই সময় তার অটোতে যাতায়াত করা বহু যৌনকর্মীর মাধ্যমে সে এই পেশা নিয়ন্ত্রণকারীদের লাভের পরিমাণ জানতে পেরেছিল। যৌনকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় থাকার সুযোগে সে নিজে কয়েকটা বস্তির ঘরকে বেশ্যালয়ে পরিণত করে তার মালিক হয়ে বসেছিল। সমাজবিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকা কিছু মানুষকে নিয়ে গৌরীশঙ্কর একটা দল তৈরি করেছিল। এই সময় তার নতুন নামকরণ হয়। মানুষ তাকে গৌরীশঙ্করের বদলে 'অটো শঙ্কর' বলে ডাকতে শুরু করেছিল। লোকমুখে শোনা যায় যে, 'অটো শঙ্কর' খুব ভালো করেই জানত, সমাজের কোন মানুষকে কীভাবে নিজের পক্ষে রাখলে সে নির্বিঘ্নে তার বেআইনি কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। তার পেরিয়ার নগরের বাড়ির গৃহপ্রবেশের সময় বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এইসব গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সান্নিধ্য তাকে একরোখা এবং নৃশংস করে তুলেছিল।
আরও পড়ুন: সন্ধের পর স্তব্ধ হয়ে যেত কলকাতা, আজও অধরা ঘাতক স্টোনম্যান
অটো শঙ্করের নৃশংসতা এবং মানসিকতা তার খুন করার পদ্ধতির মধ্যে প্রকাশ পায়। তার প্রিয়তমা ললিতাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে মাটিতে পুঁতে রেখে সেই বাড়ি এক বৃদ্ধা বিধবাকে ভাড়া দেওয়া থেকে তার সহচর এবং বেশ্যালয়ের দালাল সুদলাইমুথুকে জীবন্ত জ্বালিয়ে তার অবশিষ্টাংশ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার সময় তার মধ্যে রাগ এবং ঘেন্না ছাড়া আর কোনও আবেগ প্রকাশ পায়নি। ক্যাবারে ডান্সার ললিতা তার প্রেমে সাড়া না দিয়ে সুদলাইমুথুর সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করেছিল বলেই তাদের এই পরিণতি হয়।
যদিও অটো শঙ্করের চরম পরিণতির শুরু হয় এল. বি রোডের বেশ্যালয়ে এক যৌনকর্মী-সংক্রান্ত ঝামেলায়। রাগের বশে অটো শঙ্কর পুরো দল নিয়ে বিপক্ষের তিনজনের ওপর চড়াও হয়েছিল। বেদম প্রহার করে তিনজনকে খুন করার পর অটো শঙ্কর তার দলবল-সমেত মৃতদেহগুলো মাটিতে এবং বাড়ির দেওয়ালে পুঁতে রেখেছিল। এই তিনজনের মধ্যে একজনের পরিবারের কাতর আবেদনে তৎকালীন রাজ্যপাল পি.সি আলেকজান্ডার পুলিশকে সঠিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদন্ত চলাকালীন একে একে মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। অটো শঙ্কর তার দল সমেত ধরা পড়ে। পুলিশের তদন্তের ফলে অটো শঙ্করের সঙ্গে বেশ কিছু পুলিশকর্মীর যোগসাজশের কথা সবার সামনে আসে। সেই সব পুলিশকর্মীকে তাদের কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তদন্ত চলাকালীন অটো শঙ্করের এক স্বীকারোক্তি পুলিশকেও চমকে দিয়েছিল। অটো শঙ্কর স্বীকার করে যে, সে ন'জন মেয়েকে অপহরণ, ধর্ষণ এবং খুন করেছে। যদিও সেছাড়াও সমাজের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং নেতা-মন্ত্রীরা তার সঙ্গে এই কাজে যুক্ত ছিল। যদিও এই ঘটনায় নতুন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, কিন্তু অনেকেই মনে করে এটা আসলে অটো শঙ্করের একটা চাল ছিল।
গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও অটো শঙ্কর আশা ছেড়ে দেয়নি, কারারক্ষী এবং জেলের ওয়ার্ডেনের সঙ্গে যোগসাজশ করে জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে। জেল থেকে পালানোর কিছুদিন পর তাকে রাউরকেল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার আচরণ, খুনের প্রকৃতি, মানসিকতা দেখে আদালত তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেয়। ২৭ এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে তামিলনাড়ুর সালেম জেলে তার ফাঁসি হয়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অটো শঙ্করের পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, সমাজের কোনও গণ্যমান্য ব্যক্তি ফোন করে তার ফাঁসি রদ করার আদেশ দেবেন। যদিও সেই ফোন কোনওদিন আসেনি।
গৌরীশঙ্কর থেকে অটো শঙ্কর হয়ে ওঠার পিছনে কারণ খুঁজতে গেলেই নানা মুনির নানা মত। বাবার বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে প্রচণ্ড দারিদ্র, মানসিক বিকার থেকে লোভ, সমাজের অবহেলা থেকে কিছু স্বার্থপর হোমরাচোমরা ব্যক্তিদের প্রভাব, সবকিছুই সেখানে পাওয়া যায়। এই সবকিছুর কোনও একটাই কি অটো শঙ্করের জন্ম দিয়েছিল, না কি সবকিছু মিলেই তৈরি হয়েছিল অটো শঙ্কর? প্রসঙ্গত, 'রামন রাঘব ২.০'-র পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের জীবনের সর্বপ্রথম চিত্রনাট্য হতে পারত এই ঘাতককে নিয়েই।