"আমি আপনার স্ত্রীকে বিয়ে করতে চাই" : নির্ভীক প্রেমিক জগজিৎ সিং রইলেন আড়ালেই
Jagjit Singh Chitra Singh Love Story: জগজিৎ আর চিত্রার সন্তানের মৃত্যুর পর ভেস্তে গিয়েছিল জীবনের বাগিচা।
উনসে নজরে ক্যায়া মিলি, রওশন ফিজায়ে হো গ্যয়ি
আজ জানা প্যায়ার কি, জাদুগরি ক্যায়া চিজ হ্যায়
প্রেমের 'নরমিয়ৎ'-কে তিনি ছুঁয়েছিলেন কণ্ঠের স্পর্শে। একইসঙ্গে কী অপূর্ব বিষণ্ণতা তাঁর গলায়, আবার কী তীব্র সমর্পণ। প্রেমের জাদুগরিকে শান্ত করে বসিয়েছিলেন নিজস্ব বৈঠকখানায়। আর বিষাদকে রেখেছিলেন ব্যক্তিগত সিন্দুকে। একটি মৃত্যু এসে এলোমেলো করে দিয়েছিল সেই সিন্দুক, খাঁ-খাঁ করে দিয়েছিল বৈঠকখানা। গজল শিল্পী জগজিৎ সিং সেই বিষণ্ণতার পেয়েলায় তবু সুর ঢেলেছেন, প্রাণকে খুঁজেছেন সুরের আলেখ্যেই। সংসার জানেনি, "ক্যায় গম হ্যায় জিসকো...” লুকিয়ে রেখেছিলেন জগজিৎ। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। সেই জমানাতে 'প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া'-কে বাস্তব করে ফেলেছিলেন তিনি। সামাজিকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে ভালোবেসেছিলেন 'পরস্ত্রী'-কে। চিত্রা সিংকে বিয়ে করেছিলেন জগজিৎ। দু'জনেই গানের খনি, সুরের আকর। নিজ নিজ কর্মজীবনের শীর্ষে ছিলেন তাঁরা। শুধু একটি মৃত্যু এসে...
জগজিৎ আর চিত্রার সন্তানের মৃত্যুর পর ভেস্তে গিয়েছিল জীবনের বাগিচা। এই ব্যক্তিগত শোক তাঁদের সঙ্গীতযাত্রাকে থমকে দেয়। চিত্রা চিরতরে গান গাওয়া ছেড়ে দেন। জগজিৎ সিং বেশ কিছুকাল থমকে থাকার পরে ফিরে আসেন। একাধিক শোক সয়ে, বিষাদ মেখে ২০১১ সালে চলে যান তিনিও।
১৯৬৭ সালে প্রথম দেখা চিত্রা আর জগজিতের। খানিক 'উনসে নজরে ক্যায়া মিলি...'-র মতোই! একজন সঙ্গীত পরিচালকের রেকর্ডিংয়ে গিয়ে প্রথম দেখা চিত্রা আর জগজিতের। বিভিন্ন গায়কদের নিয়ে একসঙ্গে একটি কাজ করতে চেয়েছিলেন ওই পরিচালক। কিন্তু চিত্রা নারাজ। জগজিৎ সিংয়ের সঙ্গে গান গাইতে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না তিনি। চিত্রা ভেবেছিলেন জগজিতের গলা খুব ভারী। তাঁর সঙ্গে ডুয়েট গাইতে গেলে ব্যাপারটা মোটেও সুখশ্রাব্য হবে না। এমন এক সময়ে চিত্রার সঙ্গে জগজিতের আলাপ যখন তিনি ইতিমধ্যেই বিবাহিত। যদিও স্বামী দেব প্রসাদ দত্তের সঙ্গে সম্পর্ক ঠেকেছিল তলানিতে। দেব প্রসাদ আর চিত্রার এক কন্যাও ছিল, মনিকা। স্বামীর সঙ্গে চিত্রা থাকছিলেন না সেই সময়। জগজিৎ সিং চিত্রাকে ভালোবেসে ফেলেছেন ততদিনে। বিয়ের প্রস্তাব দিলেন সরাসরি। চিত্রা নাকচ করে দিলেন নিজের পরিস্থিতি জানিয়ে। জগজিৎ নাছোড়। সটান চলে গেলেন চিত্রার তৎকালীন স্বামী দেব প্রসাদ দত্তের কাছে! জগজিৎ সিং সোজা প্রস্তাব পাড়লেন দেব প্রসাদের কাছে, "আমি আপনার স্ত্রীকে বিয়ে করতে চাই।" বাকিটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন- ‘হামে কাশ তুমসে মোহব্বত…’, কেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল মধুবালা-দিলীপকুমারের প্রেম?
জগজিৎ সিং এবং চিত্রা সিংয়ের সম্পর্কের বুনন ছিল ভীষণ গভীর। প্রেম এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের শিকড় চাড়িয়ে গিয়েছিল নির্ভরতার গহিনে। বাইরের জগতে জগজিৎ চিত্রা হলেও, নিজস্ব সময়ে একে অপরকে 'বিশেষ' নামে ডাকতেন তারা। চিত্রাই একবার বলেছিলেন, জগজিৎ 'মাম্মি' বলে ডাকতেন তাঁকে, আর চিত্রা তাঁকে ডাকতেন 'পাপা' বলে! আসলে যখন বাবু (তাঁদের প্রয়াত পুত্র বিবেক) বেঁচে ছিলেন, চিত্রা প্রায়ই বলতেন 'যাও, পাপাকো বুলাও’। সেই থেকে একে অপরকে সন্তানের ডাকেই ডাকতেন তাঁরা। অথচ দু' চোখে হারাতেন যাকে, সেই সন্তান হারিয়ে গেল চিরতরে।
আরও পড়ুন- স্পাই নাকি প্রেমিক? পারমাণবিক বোমার সূত্র ‘পাচারের অভিযোগে’ মরতে হয়েছিল যাঁদের
১৯৯০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে একমাত্র ছেলের মৃত্যু জগজিৎ সিং এবং চিত্রা সিংকে ভেঙে দেয় ভেতরে ভেতরে। সেই বছরের জুলাই মাসে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান বিবেক। সন্তানের মৃত্যুর পরে গান গাওয়া ছেড়ে দেন চিত্রা। আর বাবা? এক বছরের বিরতি নিয়েছিলেন জগজিৎ। ব্যক্তিগত দুঃখকে প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে বেছেনিলেন সঙ্গীতকেই। ১৯৯১ সালে, জগজিৎ সিং একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন 'হোপ' নামে। 'আব খুশি হ্যায় না কোই গম', 'খুদা হাম কো অ্যাইসি খুদাই না দে' এবং 'তানহা তানহা হাম রো লেঙ্গে'-র মতো গানগুলিতে সন্তানহারা এক বাবাকে খুঁজে পেলেন শ্রোতারা। পেলেন দুঃখকে কণ্ঠে ধারণ করা এক শিল্পীকে। ২০০৩ সালে পদ্মভূষণে ভূষিত হলেন জগজিৎ সিং।
তবে বিশ্বস্ত শোক যাকে ভালোবাসে, তাঁকে ছেড়ে যায় না। ছেলের মৃত্যুর যন্ত্রণা কাটতে কাটতেই ২০০৯ সালের মে মাসে আরেকটি মৃত্যু। চিত্রার মেয়ে মনিকা আত্মহত্যা করেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে মনিকাকে দেখেছেন জগজিৎ! তাঁর কন্যাসমই ছিলেন মনিকা। মনিকার মৃত্যুর দুই বছর পর জগজিৎ সিংও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২০১১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, মুম্বইয়ের শানমুখানন্দ হলে একটি অনুষ্ঠানে গাওয়ার কথা ছিল। শুরুর ঠিক আগে জ্ঞান হারান। ২ সপ্তাহ পর লীলাবতী হাসপাতালে মারা যান জগজিৎ। শোকের সুর নিয়ে চিরতরে চলে যান এক শান্ত স্থিতধী শিল্পী, চিরতরে।