আরাবল্লী প্রশ্নে কেন হঠাৎ সুর বদলালেন অর্ণব গোস্বামী?
Arnab Goswami: অর্ণব গোস্বামী কটাক্ষের সুরে বলেন, যাঁকে সরকারের তরফ থেকে বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা বেতন দেওয়া হয়, সেই অ্যাঙ্করের পক্ষে কি আদৌ এই ধরনের প্রশ্ন তোলা সম্ভব?
ভারতীয় টেলিভিশন সংবাদমাধ্যমে অর্ণব গোস্বামী এমন এক নাম, যাঁকে নিয়ে আলাদা করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এমন এক সাংবাদিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন, যাঁর প্রাইমটাইম শো মানেই সরকারের পক্ষে সওয়াল, বিরোধীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ এবং জাতীয়তাবাদী উত্তেজনার উচ্চস্বরে উপস্থাপনা। সেই অর্ণব গোস্বামীই হঠাৎ করে যখন কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, পরিবেশ ধ্বংসের প্রসঙ্গে কর্পোরেট-রাষ্ট্র আঁতাতের অভিযোগ করেন এবং এই নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ‘মৌনতা’কে নিশানা করেন— তখন তা স্বাভাবিকভাবেই আলোড়ন তোলে।
সম্প্রতি রিপাবলিক টিভির এক প্রাইমটাইম শো-তে অর্ণব গোস্বামী আরাবল্লী পাহাড় প্রসঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা তাঁর পরিচিত সাংবাদিকতার ধাঁচ থেকে স্পষ্টভাবেই আলাদা। আরাবল্লী ভারতের অন্যতম প্রাচীন পর্বতমালা, এর ভূ-পরিবেশগত গুরুত্ব অপরিসীম। দিল্লি-এনসিআর অঞ্চলের আবহাওয়া ঠিক রাখা, মাটির নীচের জল ধরে রাখা এবং এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচাতে এই পর্বতমালার ভূমিকা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। সেই আরাবল্লীর বিস্তীর্ণ অংশকে নতুন সংজ্ঞার মাধ্যমে আইনি সুরক্ষা থেকে কার্যত বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন।
অর্ণবের বক্তব্যের কেন্দ্রে ছিল একটি মৌলিক প্রশ্ন, রাষ্ট্র যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক হয়, তবে কোটি কোটি বছরের পুরনো এই প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া নিয়ে কেন মূলধারার সংবাদমাধ্যম নীরব? তিনি অভিযোগ করেন, সরকার একটি সংকীর্ণ আইনি সংজ্ঞা ব্যবহার করে আরাবল্লী বৃহৎ অংশকে ‘পর্বত’ হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে খনন ও নির্মাণের পথ খুলে দিচ্ছে। এর ফলাফল হবে পরিবেশগত বিপর্যয়, যা আগামী প্রজন্মকে বহন করতে হবে।
আরও পড়ুন
ইন্ডিগো-বিপর্যয়: কেন ভোলবদলে গেল অর্ণব গোস্বামীর?
এই প্রশ্ন তুলতে গিয়েই অর্ণব গোস্বামী আরও এক সংবেদনশীল প্রসঙ্গ তুলে আনেন— সংবাদমাধ্যমের আর্থিক ও রাজনৈতিক নির্ভরতা। তিনি কটাক্ষের সুরে বলেন, যাঁকে সরকারের তরফ থেকে বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা বেতন দেওয়া হয়, সেই অ্যাঙ্করের পক্ষে কি আদৌ এই ধরনের প্রশ্ন তোলা সম্ভব? তাঁর কথায়, এমন আর্থিক নির্ভরতার কারণে অনেকেই মুখ খুলতে পারছেন না। তাঁর এই মন্তব্য সরাসরি ইঙ্গিত করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকে। ভারতীয় মিডিয়ায় এই সম্পর্ক নতুন নয়, কিন্তু আর্ণবের মুখে এমন অভিযোগ শোনা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী।
আরাবল্লী প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে এই বক্তব্য এক বৃহত্তর প্রশ্নের জন্ম দেয়— ভারতের টেলিভিশনে সাংবাদিকতা কি আদৌ স্বাধীন? না কি তা কর্পোরেট স্বার্থ, সরকারি বিজ্ঞাপন এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের বেড়াজালে বন্দি? অর্ণব তাঁর বক্তব্যে দাবি করেন, পরিবেশ ধ্বংসের মতো গুরুতর ইস্যুতে প্রশ্ন না তোলা মানে জাতির ভবিষ্যতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।
এই শো-তে তিনি পরিবেশ মন্ত্রকের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে ফেলেন। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের কাঁধে, তাঁদের নীরবতা কেন? প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় কেন হস্তক্ষেপ করছে না? ‘বিকশিত ভারত’ যদি সরকারের স্বপ্ন হয়, তবে সেই উন্নয়ন কি প্রকৃতি ধ্বংসের বিনিময়ে হবে— এই প্রশ্নটিও তিনি তুলেছেন।
তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাম না করলেও পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবের উদ্দেশে একের পর একের পর এক কঠিন প্রশ্ন তোলেন। সরকারের তরফ থেকে এই বিষয়ে স্পষ্ট জবাব না আসায় তিনি প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এছাড়া দিল্লির বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবে পূরণ হয়নি বলেও তিনি সরাসরি আক্রমণ করেন।
অর্ণবের এই বক্তব্যের সময়কালও গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লির বায়ুদূষণ, শিল্পোন্নয়নের নামে বনাঞ্চল ধ্বংস, এবং নির্মাণ প্রকল্পের আড়ালে পরিবেশগত ছাড়পত্রের দ্রুত অনুমোদনের মতো বিষয়গুলি নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। এমন এক সময়ে অর্ণবের এই অবস্থান পরিবর্তন অনেককেই অবাক করেছে।
সম্প্রতি ইন্ডিগো বিমানের একাধিক ফ্লাইট বাতিলের বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেন। এই ঘটনায় কেন্দ্র সরকারের ভূমিকা কী, তা জানতে চেয়ে তিনি বলেন,
ভারত জানতে চাইছে, এই বিষয়ে মোদি সরকার কী করছে?
তবে প্রশ্ন উঠছে, এই পরিবর্তন কতটা আদর্শগত, আর কতটা কৌশলগত? সমালোচকদের একাংশ মনে করছেন, অর্ণব গোস্বামী এখনও পর্যন্ত সরকারের মূল রাজনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধে মৌলিক কোনো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেননি। বরং নির্দিষ্ট কিছু ইস্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি নিজের সাংবাদিকসত্তাকে নতুনভাবে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন। আবার অন্য অংশের মতে, মূলধারার এক প্রভাবশালী অ্যাঙ্করের মুখে এমন প্রশ্ন উঠে আসাটাই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে অন্তত কিছু আলোচনা শুরু হচ্ছে।
আরও একটি দিক উল্লেখযোগ্য, তিনি এই শো-তে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন বা প্রান্তিক কণ্ঠস্বরের বদলে ক্ষমতাবানদের সুবিধাজনক বয়ানকে তুলে ধরা এবং তথাকথিত এলিট সাংবাদিকদেরও আক্রমণ করেন। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট, তিনি নিজেকে এখনও সেই ব্যবস্থার বাইরে থাকা প্রশ্নকারী হিসেবেই তুলে ধরতে চান, যদিও তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ওই ব্যবস্থারই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন।
আরও পড়ুন
একটি সংবাদ জীবন | কথাবার্তায় সুমন চট্টোপাধ্যায়-শুভাশিস মৈত্র
অর্ণবের বক্তব্যের পর সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়ার বন্যা বয়ে যায়। কেউ বলছেন,
অর্ণব অবশেষে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন।
আবার কেউ বলছেন,
এটা নিছক নাটক।
এই বিভাজনই দেখিয়ে দেয় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের উপর সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট কতটা গভীর।
আসল প্রশ্নটি হয়ত আর্ণব গোস্বামীকে ঘিরে নয়। প্রশ্নটি হলো, ভারতের সংবাদমাধ্যম কি পরিবেশ, গণতন্ত্র ও জনস্বার্থের মতো মৌলিক ইস্যুতে নির্ভীকভাবে প্রশ্ন তুলতে পারবে? নাকি মাঝে-সাঝে কিছু উচ্চস্বরে বক্তব্যই ‘সাহসী সাংবাদিকতা’ বলে চালানো হবে?
আরাবল্লী নিয়ে অর্ণবের প্রশ্ন দেখিয়ে দিয়েছে যে রাষ্ট্র, কর্পোরেট ও মিডিয়ার মধ্যে সম্পর্ক কতটা জটিল এবং কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই প্রশ্ন যদি শুধু একটি টেলিভিশন শো-তেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা নিছক শব্দদূষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যদি এই প্রশ্নের ধারাবাহিকতা থাকে, যদি আরও মিডিয়া হাউস এগিয়ে আসে, তবেই হয়ত ভারতীয় সাংবাদিকতা নতুন করে নিজের ভূমিকা খুঁজে পেতে পারে।
তবে অর্ণব গোস্বামীর এই অবস্থান পরিবর্তন কীভাবে মনে রাখা হবে, তা নির্ভর করবে তাঁর পরবর্তী ভূমিকার উপর। তিনি কি সত্যিই প্রশ্ন করবেন, না কি এই পর্বও অন্য অনেক টেলিভিশন বিতর্কের মতোই দ্রুত চাপা পড়ে যাবে— সেই উত্তর এখনও অজানা। তবে এটুকু স্পষ্ট, আরাবল্লী নিয়ে অর্ণবের এই তীব্র প্রশ্ন ভারতীয় মিডিয়া রাজনীতিতে এমন এক বাস্তবতা তুলে ধরেছে, যা সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

Whatsapp
