পশ্চিমবঙ্গে খসড়া ভোটার তালিকা: যে শিক্ষা আমাদের নিতে হবে

West Bengal Draft Voter List: এই খসড়া বিজেপির অতিপ্রিয়  'অবৈধ, অনুপ্রবেশকারী মুসলমান' তত্ত্বের মুখোশ খুলে দিয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে যে মুসলমানরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয় বরং তাদের বেশিরভাগেরই প্রয়োজনীয় নথি আছে।

পশ্চিমবঙ্গে গত তিনমাস ধরে চলা এসআইআর প্রক্রিয়া শেষে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। রাজ্যের মানুষ সব কাজ ফেলে তালিকায় নিজের নাম খুঁজছেন। এই তালিকা প্রকাশের আগেই কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির পক্ষ থেকে এসআইআরের সম্ভাব্য পরিণাম সংক্রান্ত ফলাফল নিয়ে এক আগ্রাসী ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছিল যা মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার সৌজন্যে সর্বত্র প্রচারিত হয়। এই ন্যারেটিভের প্রচারক ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এ রাজ্যে বিজেপির সভাপতি, বিরোধী দলনেতা থেকে শুরু করে চার আনা-আট আনার নেতারা। সেই ন্যারেটিভের মূল কথা ছিল পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে বাংলাদেশ সংলগ্ন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলাগুলো অবৈধ  অনুপ্রবেশকারী/ রোহিঙ্গা/ ঘুসপেটিয়াতে ভরে গিয়েছে। এরা সবাই রাজ্যের সম্পদে ভাগ বসাচ্ছে, এখানে নানান ধরণের অনৈতিক কাজকর্ম করছে সর্বোপরি রাজ্যের শাসকদলের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে কাজ করছে।

এসআইআরের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রমাণ করতে গিয়ে বলা হয়েছিল এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনী শেষে নিদেনপক্ষে এক কোটি রোহিঙ্গা/ ঘুষপেটিয়া বাদ পড়বে, রাজ্য জঞ্জালমুক্ত হবে এবং বিজেপি নিশ্চিতভাবে ক্ষমতায় আসবে। এই ন্যারেটিভে একটা দুর্বল অংশও ছিল। সেটা ছিল দলিত শরনার্থী হিন্দু যারা মতুয়া সম্প্রদায় নামে পরিচিত। এদের অনেকেই ১৯৭০ পরবর্তী সময়ে এদেশে আসেন এবং তাদের নাগরিকত্বের দাবি ছিল একশ শতাংশ ন্যায্য। বিজেপির এই ঘৃণ্য অনুপ্রবেশ তত্ত্বে এই মতুয়াদের পরিণতি কি হবে তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন প্রথম থেকেই ছিল এবং বিজেপির কাছে তা ছিল অস্বস্তিকর। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এসআইআরের অসাংবিধানিক গঠন, পরোক্ষে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নীল নকশার বিরুদ্ধে এ রাজ্যে প্রায় কোনো সংসদীয় দল বিরোধিতা করেনি। তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির এসআইআর বিরোধিতা ছিল আংশিক ও মূলত প্রয়োগবিধির জটিলতা সম্পর্কিত। তাই বলা যায় কোনো কার্যকরী বিরোধিতা ছাড়াই এই রাজ্যে সমীক্ষা শেষ হয়েছে।

আরও পড়ুন

বাংলায় এসআইআর ২০২৫: বিজেপির অনুপ্রবেশ দাবি আর তথ্য যা বলছে

খসড়া তালিকা নিয়ে আলোচনায় প্রবেশের আগে 'নো ম্যাপিং' ক্যাটাগরির অর্থটা বুঝে নেওয়া দরকার। নির্বাচন কমিশনের ভাষায় তাদের ঐতিহাসিক ডাটাবেস হলো ২০০২ সালের ভোটার তালিকা। এই তালিকার সঙ্গে সম্পর্কহীন (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) মানুষদের নাম এই তালিকায় নেই। আর ভোটের নিয়ম সম্পর্কে সামান্য ধারণা আছে এমন মানুষরা জানেন যে ভোটার তালিকায় এএসডি ক্যাটাগরি থাকে যাদের মধ্যে আছে অনুপস্থিত/ মৃত/ ডুপ্লিকেট ভোটারদের নাম। পশ্চিমবঙ্গে খসড়া তালিকা অনুযায়ী ৫৮,২০,৮৯৮ জনের নাম বাদ গিয়েছে। এর মধ্যে মৃত ভোটার ২৪,১৫,৮৫২ জন। স্থানান্তরিত ভোটার ১৯,১৫,৮৫২ জন। নিখোঁজ ভোটার ১২,২০,২৩৮ জন। ডুপ্লিকেট এবং অন্যান্য ভোটার ১,৯৫,৯৩৪ জন।

এই খসড়া তালিকায় প্রথমে আমাদের খোঁজা দরকার ঘৃণার কারবারীদের মুখে বারংবার উচ্চারিত এক কোটি রোহিঙ্গাদের। এই তালিকায় উদাহরণ হিসাবে এমন সাতটি  বিধানসভা কেন্দ্র বেছে নেওয়া হচ্ছে যেখানে ভোটারদের ৭৫% মুসলমান। আমরা এই কেন্দ্রগুলোতে নো ম্যাপিং বা আন ম্যাপড ভোটারদের শতাংশগুলি দেখব— ডোমকল (০.৪২%), রানিনগর (০.৯১%), হরিহরপাড়া (০.৬%), সুজাপুর (০.৫%), রঘুনাথগঞ্জ (০.৭%), সামসেরগঞ্জ (১%) এবং লালগোলা (১.১%)। এই পরিসংখ্যান শুধু এক কোটি রোহিঙ্গার গাঁজাখুরি তত্ত্বের মুখোশ খুলছে না, একই সঙ্গে বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের লক্ষ্যকেও উন্মোচিত করছে। কোনোরকম তথ্য প্রমাণ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের সীমান্ত জেলাগুলিতে জনবিন্যাস পাল্টে যাবার যে অভিযোগ তুলেছিলেন, তার অসারতা প্রমাণ করছে।

এই ভোটার তালিকায় সবচেয়ে বেশি যাদের নাম বাদ পড়েছে তারা হলেন হিন্দু দলিত অর্থাৎ মতুয়া সম্প্রদায়। এক কথায় বলতে গেলে মতুয়ারা বিজেপির নাগরিকত্বের ফাঁদে ধরা পড়লেন। আমরা এবার দেখে নেব মতুয়া অধ্যুষিত বিধানসভা কেন্দ্র গুলোর অবস্থা— গাইঘাটা তফসিলি (১৪.৫১%), বাগদা তফসিলি ( ১২.৬৯%), কল্যাণী তফসিলি (১১.৯২%), বনগাঁ উত্তর তফসিলি (১১.৩%), রানাঘাট উত্তর-পূর্ব তফসিলি (১১.১৯%), বনগাঁ দক্ষিণ তফসিলি (১০.৮৩%), কৃষ্ণনগর তফসিলি (১০.৪৩%), রানাঘাট উত্তর পশ্চিম (১০.৪৮%), রানাঘাট দক্ষিণ তফসিলি (৯.৩২), স্বরূপনগর তফসিলি ( ৬.৮৭%)। সারা রাজ্যে নো ম্যাপিং এর গড় ৩.৯৯%, সেখানে মতুয়া প্রভাবিত এলাকাতেই রয়েছে গড় ৯.৪৩%। এককথায় এই খসড়া তালিকা মতুয়াদের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

মতুয়াদের এই বিপর্যয়ের আশঙ্কা কিন্তু আগেই ছিল। এই খসড়া তালিকা, লক্ষ্য ভিন্ন হলেও আসামের এনআরসিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ৫ বছর আগে সেই প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত তালিকায় ৩.২৯ কোটি আবেদনকারীদের মধ্যে ১৯ লাখ লোকের নাম বাদ যায়। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেই ১৯ লাখের মধ্যে ৭ লক্ষ মানুষ মুসলিম ও ১২ লক্ষ মানুষ হিন্দু। সেই হিন্দুদের মধ্যে আবার সংখ্যাগরিষ্ট হলো দলিত। সেখানেও বাংলাদেশ সংলগ্ন জেলাগুলোতে বাদ যাওয়ার শতাংশ ছিল তুলনায় কম যেমন শালমারা (৭.২২%), ধুবুরী (৮.২৫%), করিমগঞ্জ (৭.৬৭%)।  নাম বাদ পড়া মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল হোজাই (৩২.৯৯%) এবং দারাং (৩০.৯০%)। অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে হিন্দুদের মসিহা বলে দাবি করা বিজেপি সিএএ আদতে নাগরিকত্বের প্রশ্নটিকে জটিল করবে। বাস্তবে হলোও তাই। এসআইআরের ২০০২-এর শর্তটি ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে আসা হিন্দু শরণার্থীদের জন্য একটি কাঠামোগত বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। কারণ সব হারানো প্রান্তিক মানুষদের কাছে কাগজ ছিল না। এদের নাগরিকত্ব আইন সিএএ দিয়ে রক্ষা করার কথা বলা হচ্ছিল। অথচ আমরা দেখলাম এসআইআর ও সিএএ পরস্পর বিরোধী পক্ষ হয়ে মতুয়াদের বিশ বাঁও জলে ডুবিয়ে দিল।

আরও পড়ুন

‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন আজও | টোটোপাড়ায় এসআইআর যে প্রশ্ন তুলছে

এবারের খসড়া তালিকার একটি বড় বিষয় হলো হিন্দিভাষীদের নাম বাদ পড়া। একই সঙ্গে নো ম্যাপিং-এর সংখ্যাটাও যথেষ্ট বড়। হিন্দিভাষী মানুষ যে সব বিধানসভায় বেশি তাদের কিছু উদাহরণ দেখা যেতে পারে— ভাটপাড়া (বাদ ২০.৩৮% ,নো ম্যাপিং ৯.৩%), আসানসোল উত্তর (১৪.৭১%,৮.৭৪%), বালি (১৯.৫১%,১৭.৮১%), হাওড়া উত্তর (২৬.৯৫%,১২.৪২%)। আবার কলকাতার তিনটি আসনে বাদ পড়ার সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ— জোড়াসাঁকো (৩৬.৬৬%), চৌরঙ্গি (৩৫.৪৫%), কলকাতা পোর্ট (২৬.০৯%), কলকাতা উত্তর (২৫.১৩%) এবং কলকাতা দক্ষিণ (২৩.৮৬%)। গড়ে হিন্দিভাষী প্রবণ এলাকায় বাদ পড়ছে ১৫%-৩৬%। এই ঘটনার কারণ প্রধানত অর্থনৈতিক। তুলনায় অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ এলাকায় কাজের সন্ধানে যাওয়ার ফলে এই রিভার্স মাইগ্রেশনের কারণ হতে পারে। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ডেটা কারোর কাছে নেই।

এই খসড়া তালিকা বিশ্লেষণ করে কতগুলি প্রাথমিক ট্রেন্ড বেরিয়ে আসছে যা আগামী দিনে রাজ্য তথা দেশের রাজনীতিতে নিশ্চিত প্রভাব ফেলবে। প্রথমত, এই খসড়া বিজেপির অতিপ্রিয়  'অবৈধ, অনুপ্রবেশকারী মুসলমান' তত্ত্বের মুখোশ খুলে দিয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে যে মুসলমানরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয় বরং তাদের বেশিরভাগেরই প্রয়োজনীয় নথি আছে। দ্বিতীয়ত, দলিত হিন্দুদের (মতুয়া) অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। একই সঙ্গে মতুয়া সমাজের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আচরিত রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।নির্বাচনী রাজনীতিতে কেউই চূড়ান্ত মিত্র নয় বরং নিজের সম্প্রদায়ের স্বার্থকে নিশ্চিত করার জন্য কখনও বাম, কখনও তৃণমূল, কখনও বিজেপির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন তাদের নাগরিকত্বের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করতে গিয়ে তারা নিজেরাই ব্যবহৃত হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, হিন্দিভাষীরা প্রকৃত অর্থে বিজেপির মানদন্ডে বহিরাগত প্রমাণিত হয়েছে।চতুর্থত, যদিও বিধানসভা নির্বাচন কয়েক মাস দূরে, এসআইআরকে ঘিরে বিজেপির রাজনৈতিক পরিকল্পনা অনেকটাই ঘেঁটে গিয়েছে। মুসলমানদের ভোটার তালিকায় থেকে যাওয়া, মতুয়াদের নাম বাদ পড়া এবং একটা বড় অংশের হিন্দিভাষীদের তালিকায় না থাকা বিজেপিকে প্রকারান্তরে দুর্বল করবে। পঞ্চমত, সংখ্যার বিচারে কম হলেও কিছু নাগরিক সংগঠন, সমাজকর্মী বলছিলেন এসআইআর একটি নিরামিষ সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নয় বরং মানুষের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার রাজনৈতিক কৌশল—  এই খসড়া সেই বক্তব্যকে বৈধতা দিল।

মনে রাখতে হবে, এই তালিকা খসড়া মাত্র, চূড়ান্ত ভোটার তালিকা তৈরি করার আগে এই দলদাস নির্বাচন কমিশন আরও কিছু কৌশল নেবে। তাই এসআইআরকে বিরোধ করার, তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে প্রশ্ন করার কাজটা জারি রাখতে হবে।

More Articles