১০০ দিনের কাজের আইন বদলে কী হারাল গ্রামীণ ভারত?
MGNREGA Repealed: এই নতুন আইন পাশ হওয়ার পরে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত বহু অর্থনীতিবিদ বলেছেন, যে আইন কোভিডের সময়ে ভারতকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেই আইন বাতিল করা নিজের পায়ে কুড়ুল মারার সমান।
প্রচুর বিরোধিতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতাঁর জোরে, ২০০৫ সালে ইউপিএ সরকারের সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হওয়া ১০০ দিনের কাজের আইন মহাত্মা গান্ধী ন্যাশানাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট বাতিল করল নরেন্দ্র মোদি সরকার। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে নতুন যে বিলটি আনা হয়েছে, তার নাম ‘বিকশিত ভারত গ্যারেন্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন (গ্রামীণ) বিল’। ছোট করে বললে ‘জি রাম জি’ বিল। মধ্যরাত অবধি এই নিয়ে চূড়ান্ত বিতর্ক হলেও, শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের দাবি উড়িয়ে দিয়ে স্থায়ী কমিটিতে পাঠানোর আর্জি খারিজ করে তড়িঘড়ি এই বিল পাশ করানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যে এই বিলে স্বাক্ষরও করে দিয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে এই বিলটি যখন সংসদে পেশ হয়, তখন বিরোধীরা কেন মহাত্মা গান্ধীর নাম সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাই নিয়ে বিতর্ক শুরু করেন, কিন্তু এই ‘জি রাম জি’ বিলটি যে শুধু নাম বদলের উদ্দেশ্যে করা হয়নি, তা বিরোধীরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন। যদিও নাম বদল নিয়েও কথা বলা জরুরি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হয় এই নতুন বিল সংবিধানের বাঁচার অধিকারের যে কথা বলা আছে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবস্থার যে ধারণা আছে, তাকে উলঙ্ঘন করা, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
আজ থেকে ২০ বছর আগে যখন মনরেগা প্রকল্প লাগু হয়েছিল তখন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র, ভূমিহীন এবং সামাজিকভাবে প্রান্তিক গ্রামীণ মজুরি শ্রমিক পরিবারগুলিকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করা, একই সঙ্গে বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উৎপাদনশীল গ্রাম-স্তরের সম্পদ তৈরি করা। পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা না থাকলে, এই নতুন VB–G RAM G ভারতের ইতোমধ্যেই প্রান্তিক কর্মীবাহিনীকে ক্ষমতাহীন শ্রমশক্তির একটি সংরক্ষিত আধারে পরিণত করার ঝুঁকিতে ফেলবে, যেখানে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করবে কী ভাবে, কখন এবং কোথায় তাদের নিয়োগ করা হবে। কেন্দ্র যেখানে চাইবে সেই অনুযায়ী কাজ দেওয়া হবে। আগে যদি গ্রামে একটি পুকুর কাটা হত, বা গ্রামে কোনো রাস্তার প্রয়োজন হত, তখন ওই গ্রামের থেকেই যারা এই কাজ করতে ইচ্ছুক, তাদের ওই কাজে নিযুক্ত করা হত। এর ফলে দু'টো লাভ হত— এক, কোনো একটি গ্রামে কোনো একটি প্রয়োজনীয় ও নির্দিষ্ট কাজও হয়ে যেত; দুই আবার গ্রামের মানুষজনকেও কাজ দেওয়া যেত। চাহিদা যেমন যে কোনো গ্রাম থেকে আসত, তেমনই সেই গ্রামের ইচ্ছুক মানুষের কাজের চাহিদাও পূরণ হতো। কিন্তু নতুন বিলে আন্ত রাজ্য সংঘাত এবং বৈষম্য বাড়তে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন
মনরেগা থেকে শান্তি বিল: যেভাবে লোকসভা হাসির খোরাকে পরিণত হলো
যদি এই VB–G RAM G বিলটি গ্রামীণ শ্রমশক্তির ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকত, তাহলে নতুন বিলের দু'টি মূল বিধান একেবারেই অন্যরকম দেখাত। প্রথমটি, নূন্যতম মজুরি (ধারা ১০) এবং দ্বিতীয়টি, এই টাকা রাজ্যগুলো কী ভাবে পাবে, সেই সংক্রান্ত ধারা নিয়ে কথা বলা উচিত। নতুন যে ১০ নম্বর ধারার কথা বলা হয়েছে, তা আগের ১০০ দিনের কাজের ৬(১) ধারারই প্রতিফলন বলা যায়, যেখানে কেন্দ্র নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করবে। রাজ্যের হাতে সেই ক্ষমতা থাকবে না। সাংবিধানিকভাবে আগের আইনটিতেও যা ছিল, এই আইনেও সেটাই আছে। শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার দু'ক্ষেত্রেই লঙ্ঘিত হয়। সুতরাং, নতুন আইনেও সেই বিষয়ে কোনো পরিবর্তন নেই। ১৯৪৮ সালের ন্যূনতম মজুরি আইনকে বাতিল করে ওই ধারাটি ইউপিএ সরকার এমজিএনআরইজি বিল পেশ করার প্রাক্কালে চালু করেছিল। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শকেও অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ লিখেছিলেন,
“statutorily the wage rate under NREGA is delinked and independent of the provisions of the Minimum Wages Act.”
প্রাক্তন বিচারপতিরা সেই সময়ে এই নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিলেন, কিন্তু তাঁদের কথায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মনরেগার নূন্যতম মজুরি তখন থেকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জন্য একটি নতুন, অসাংবিধানিক 'স্তর' তৈরি করেছে, কৃষিক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরির নিচে একটি উপ-জীবিকা মজুরি। ২০২৫ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে, ১৩টি প্রধান রাজ্যে এটিই ঘটছে। আজকের VB RAM G এই দিকটি সংশোধন করার কোনো চেষ্টা করেনি। মনরেগার অধীনে শ্রমিকদের জন্য, এটি কার্যকরী ভাবে রাষ্ট্র-অনুমোদিত শোষণ অব্যাহত রাখার সমান। এটি সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় লঙ্ঘন করে যা ন্যূনতম মজুরি না দেওয়াকে জোরপূর্বক শ্রমের শামিল বলে মনে করে, যা সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদের অধীনে নিষিদ্ধ ও অনুচিত। বহু পুরনো কংগ্রেস নেতৃত্ব আজও হয়ত মনরেগার নূন্যতম মজুরি বাড়ানোর কথা বলেন, কিন্তু তাঁরা কখনই বলেন না, যে ওই মজুরি যেন নূন্যতম মজুরি আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এইখানেই বিজেপির বর্তমান নেতৃবৃন্দ জিতে যান, বলেন যদি কংগ্রেস এই বিষয়ে উদাসীনতা না দেখাতেন, তাহলে তাঁরাও বাধ্য হতেন এই VB G RAM G বিলে ওই কথা বলতে।
VB–G RAM G-এর অধীনে তহবিল ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আগে মোট ব্যয় ৯০:১০ ভাগে হত। (কেন্দ্র: রাজ্য), কেন্দ্র শ্রম ও প্রশাসনিক ব্যয়ের ১০০ শতাংশ এবং কাঠামোগত ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ বহন করত এবং রাজ্য সরকার বাকিটুকু ব্যয় বহন করত। নতুন আইনে এই ব্যয়ভার বহনের অনুপাত ৬০:৪০ করা হয়েছে। এই আইন ও ১৮টি রাজ্যের জন্য এবং একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের জন্য প্রযুক্ত। অর্থাৎ এখন রাজ্যগুলোর উপরে দায় বর্তাবে ৪০ শতাংশ ব্যয়ভার বহন করার। এই মূহুর্তে হিসেব করলে দেখা যাবে, ২০২৪-২৫ সালের মনরেগা ব্যয়ের তথ্যের উপর ভিত্তি করে, এই ১৯টি রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের উপর বার্ষিক অতিরিক্ত বোঝার একটি মোটামুটি অনুমান ৩১,৫১৩ কোটি টাকা।
তবে, প্রকৃত পরিসংখ্যান দু'টি কারণে ভিন্ন হতে পারে: প্রথমত, ২০২৪-২৫ সালে গড়ে মাত্র ৫০.২৪ দিন কাজের জন্য ব্যয় করা হয়েছে, যা নিশ্চিত ১০০ দিনের যে কাজের কথা বলা হয়, তার অর্ধেক; দ্বিতীয়ত, চূড়ান্ত পরিমাণ কেন্দ্রের বরাদ্দের উপর নির্ভর করবে। বিলের আর্থিক স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই কর্মসূচির আনুমানিক বার্ষিক ব্যয় ১.৫১ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে ৫৫,০০০ কোটি টাকা রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে বহন করতে হবে, যার মধ্যে ৯৫,৬০০ কোটি টাকা কেন্দ্র বহন করবে। বরাদ্দ করা ব্যয়ের বাইরে যে কোনো ব্যয়, রাজ্যগুলোকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
আরেকটি বড় দিক হলো রাজ্যগুলি মনরেগার অধীনে চাহিদা-ভিত্তিক শ্রম বাজেট থেকে সাধারণ বরাদ্দে পরিবর্তন করা। কেন্দ্র এখন কেন্দ্রীয় আমলাদের দ্বারা ওই পূর্বনির্ধারিত ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা থেকে হিসেব করবে এবং টাকা দেবে। আগে রাজ্যের চাহিদা খতিয়ে দেখে তবে টাকা ছাড়া হত। তাই যতই কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী বলুক না কেন তাঁরা ১০০ দিনের বদলে তাঁরা ১২৫ দিনের কাজের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন, বিষয়টার মধ্যে একটা ‘কিন্তু’ থেকে যাচ্ছে, যা বোঝা জরুরি। শুধুমাত্র প্রকল্পের নাম বদল হয়েছে বলে চিৎকার জুড়েই এই নতুন আইনের বিরোধিতা করা যাবে না। আগের মতো, কাজ খুঁজছেন এমন প্রতিটি গ্রামীণ শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে না এই নতুন VBG RAM G আইনে। শ্রমিকেরা অবশ্যই সঠিক রাজ্য, অঞ্চলের হলে, তাঁরা সহজে টাকা পাবে, বিরোধী শাসিত রাজ্য হলে ওই টাকা দেওয়া নিয়ে নানান টালবাহানা করা হবে।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন। কিছুদিন আগে শোনা গিয়েছিল, বাংলায় ১০০ দিনের কাজে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে। বাংলার প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এই সংক্রান্ত অভিযোগ করা হয়েছিল। যদিও প্রমাণ করা যায়নি, দুর্নীতি কত টাকার হয়েছে, কারা দুর্নীতি করেছে, কিন্তু সেই অজুহাতে বাংলার ১০০ দিনের টাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওদিকে বাংলার শাসকদলের তরফে বারংবার বলা হয়, যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে তার তদন্ত হয় হোক, কিন্তু সেই অজুহাতে বাংলার মানুষদের ভাতে মারার চক্রান্ত হলে তা মেনে নেওয়া হবে না। এই নিয়ে দিল্লিতে ধর্না থেকে শুরু করে আদালতে মামলা অবধি হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানান সংগঠন এই সংক্রান্ত অন্দোলন অবধি গড়ে তোলে। সারা বাংলা খেতমজুর সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, কেন্দ্র রাজ্য বুঝি না, কাজ চাই কাজ দাও, বকেয়া টাকা মিটিয়ে দাও। বিভিন্ন স্তরের আন্দোলন গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আদালত রায় দেয়, বাংলাকে তার প্রাপ্য টাকা দিতে হবে। যখন সবাই ভেবেছিল বাংলাকে এবার কেন্দ্র টাকা দিতে বাধ্য হবে, ঠিক সেই সময়েই এই নতুন VB G RAM G বিল আনা হয়েছে। নতুন বিলের ৩৭ (১) ধারার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে, কেন্দ্র সরকার আগের আইন সংক্রান্ত সমস্ত কিছু বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ আগের MGNREGA আইনের সমস্ত আদেশ বাতিল হয়েছে। সুতরাং, আদালত বললেও বাংলাকে আর আগের টাকা দিতে বাধ্য নয়।
আরও পড়ুন
কেন ‘শান্তি বিল’ নিয়ে লোকসভায় উত্তেজনা?
এই নতুন আইন পাশ হওয়ার পরে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত বহু অর্থনীতিবিদ বলেছেন, যে আইন কোভিডের সময়ে ভারতকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেই আইন বাতিল করা নিজের পায়ে কুড়ুল মারার সমান। এই তালিকায় যেমন আছেন জঁ দ্রেজ, তেমন আছেন টমাস পিকেটি, নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত জোসেফ স্টিগলিটজ-সহ আরও বহু অর্থনীতিবিদ। তাঁদের বক্তব্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাহিদার দ্বারা নির্ধারিত কাজের অধিকার সুনিশ্চিত করার যে আইন, তা বন্ধ করলে এই ২০ বছর ধরে যে ভারতের মানুষের কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে, সেই ভিত নড়ে যাবে। ইতোমধ্যেই এই আইন ফেরত নেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন আন্দোলনও শুরু হয়েছে। দিল্লির যন্তরমন্তরে সিপিআই (এম-এল)-র সাংসদ রাজারাম সিং-সহ প্রাক্তন আমলা শশীকান্ত সেন্টিল-সহ বেশ কিছু সাংসদ এবং সাধারণ মানুষ যখন বিক্ষোভ দেখাতে যান, তখন তাঁদের বাধা দেয় দিল্লি পুলিশ। তবে আজকে সরকার সংখ্যার জোরে হয়ত বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু একইরকম ভাবে তো কৃষি আইন ও পাশ হয়েছিল; পরে কিন্তু সেই বিলও ফেরত নিতে হয়েছে আন্দোলনের জোরে। এই আইনও পাশ হয়ত হয়েছে, কিন্তু মানুষের আন্দোলনের যদি জোর বাড়ে, এই আইনও ফেরত নিতে বাধ্য হবে সরকার।
১৯৪৮ সালে ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী একবার খুন হয়েছিলেন আততায়ীদের হাতে, আর আজকে ২০২৫ সালে মহাত্মাকে আবার খুন করা হলো মানুষের অধিকারের বঞ্চিত করে। যদিও বিতর্কটা শুধু নাম বদল করা নিয়ে নয়, কিন্তু তাও মানুষের অধিকার বঞ্চিত করার এই আইন নিয়ে আগামীদিন ভারতের রাজনীতি আন্দোলিত হবে তা বলে দেওয়া যায়, কারণ এই নতুন আইন ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর বড় একটা আঘাত।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Whatsapp
