মুখ না ঢেকেই ডাকাতি! বেপরোয়া ডাকাত ধরতে কলকাতা পুলিশের সঙ্গী ছিলেন বার ডান্সার?
Kolkata Police Crime Case: রাত আড়াইটে। শুনশান হাউজিং কমপ্লেক্স। দরজার এপারে পয়েন্ট ৩২ রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে ৮ জন অফিসার। ভেতর থেকে গান ভেসে আসছে “আ দেখে জারা, কিস মে কিতনা হ্যায় দম”।
"তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত, তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত’, জানুয়ারির শীতের রাতেও বারে আলাদাই আমেজ তৈরি করছিল এই গানটি। পরিবেশে উষ্ণতা ছড়াচ্ছিল এই গানের সঙ্গে নাচতে থাকা লাস্যময়ী তরুণীও। বারে উপস্থিত সব পুরুষই তাঁর জন্য ফিদা। তবে তাঁদের থেকে আলাদা হয়ে, এক কোণায় বসেছিল এক বছর তিরিশের যুবক। গ্লাস হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে সিপ্। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে সে, তারপর হাতের ইশারায় ম্যানেজারকে ডেকে পাঠায়। ম্যানেজার এলে তাঁর কানে কিছু কথা বলে যুবকটি যা শুনে মুখের রং উড়ে যায় ম্যানেজারের। ম্যানেজার তড়িঘড়ি গিয়ে মেয়েটির কানেও কিছু বলেন। ফর্সা-উজ্জ্বল মুখে হঠাৎ করে আঁধার ঘনিয়ে আসে মেয়েটির। কোনওমতে নাচ শেষ করে, ড্রেস না পাল্টেই তাড়াতাড়ি এক্সিটের দিকে এগোয় তরুণী। কিন্তু তার আগেই তাঁর রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পড়েন সেই যুবক। হিমশীতল কণ্ঠে বলে ওঠেন, “পালাবার চেষ্টা করবেন না ম্যাডাম। বিপদে পড়বেন।”
ডিসেম্বর, ১৯৯৭। হাই প্রোফাইল বৈঠক চলছে লালবাজারে। বৈঠক না বলে বকাঝকাই বলা ভালো। ডিসি ডিডি বেজায় ক্ষেপে রয়েছেন অধস্তন অফিসারদের ওপর। “আর ক'টা ডাকাতি হলে তোমাদের ঘুম ভাঙবে! পাঁচটা তো হল, ছয় নম্বরে ভাঙবে না সাত নম্বরে ভাঙবে!”, টেবিল চাপড়িয়ে বলে উঠলেন ডিসি ডিডি। কমিশনার সাহেবকে ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। উপস্থিত অফিসাররাও একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। এই নিয়ে পাঁচ নম্বর ডাকাতি হলে শহরে। এবার তো চিত্তরঞ্জন সরণিতে দিনে দুপুরে সিইএসসির গাড়ি থামিয়ে ২৬ লাখ টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা! ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯ জুলাই। সেবার ট্যাংরার ফেডারেল ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে আট লক্ষ টাকা নিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। সেই থেকে পাঁচটা ডাকাতি হল, মোট চুরি গিয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা। উপরমহলের থেকে বেশ চাপ আসছে এবার। ব্যাংক ডাকাতি করা, ট্রেডিং কোম্পানির টাকা তুলে নিয়ে যাওয়া বা সিইএসসির টাকা বোঝাই গাড়ি হাতিয়ে নেওয়া এগুলো কাঁচা খেলোয়াড়দের কাজ নয়। অবশ্য খেলোয়াড় পাকা তো বটেই সঙ্গে বড় বেশি সাহসীও। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, একজন দুষ্কৃতীও মুখ ঢাকেনি বা ঢাকার চেষ্টাও করেনি। তখনও তো সিসিটিভি চালু হয়নি, সুতরাং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের ভিত্তিতেই স্কেচ তৈরি করা হয় অভিযুক্তদের। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মোট ছয়জন দুষ্কৃতী ছিল। সুতরাং এটা মনে করাই যায় যে একই দল শহরের বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতিগুলি করছিল।
দীর্ঘ বিশ্লেষণ এবং নিজেদের ‘সূত্র’ মারফত অভিযুক্তদের মোটামুটি একটা অবস্থান জানতে পারে কলকাতা পুলিশ। অবস্থান বলছি ঠিকই, কিন্তু এই 'লোকেশন' কয়েকশো কিলোমিটার বিস্তৃত। উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগড়, নোয়াপাড়া, জগদ্দল থেকে বারাসাত এবং বসিরহাট পর্যন্ত সেই লোকেশন। আরও কিছুদিন জিজ্ঞাসাবাদ করার ফলে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর, ক্যানিং, গোসাবা, ধামাখালি প্রভৃতি এলাকাও পুলিশের র্যাডারে আসে। এত বড় জায়গায় দুষ্কৃতীদের খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল ছিল। পাঁচটি কেসের জন্য পাঁচজন আলাদা অফিসার নিয়োগ করা হয়েছিল। আর এই অফিসারদের মধ্যে কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অ্যান্টি ডেকোইটি সেলের ওসি বিমল সাহা এবং অ্যাডিশনাল ওসি আমিনুল হককে। জায়গার বিস্তৃতি এতটাই ছিল যে বাধ্য হয়ে ‘সোর্স মানি’ অ্যাপ্রুভ করাতে হয় লালবাজারকে। একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তাঁর সোর্সের সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক গভীর হয়ে যায়। দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক ছাড়াও দু'জনে দু'জনের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে পারেন নির্দ্বিধায়। এই কেসের জন্য প্রয়োজন ছিল এমনই কয়েকজন সোর্সের। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, সব জেলা মিলিয়ে প্রায় ১৫ জন খোঁচড়কে নিযুক্ত করে কলকাতা পুলিশ। এই কেসের তদন্তের সঙ্গে জড়িত এক অফিসার পরবর্তীকালে বলেছিলেন,
“আমরা আক্ষরিক অর্থেই নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়েছিলাম। এই খবর এল নৈহাটিতে ৬-৭ টা নতুন ছেলে মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। আমরা সেখানে ছুটলাম তাদের সম্বন্ধে খবর নিতে। সকালে নৈহাটিতে ছিলাম, বিকেলে খবর এল আন্দুলে কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দেখা গেছে। আমরা বিকেলে ছুটলাম আন্দুল। কোথাওই সুরাহা হচ্ছিল না। আমরা এতটাই ডেসপারেট হয়ে গিয়েছিলাম যে খবর ভেরিফাই করার প্রয়োজনও মনে করতাম না। সোজা ছুটতাম সেখানে।”
আরও পড়ুন-রেসকোর্স থেকে জ্যোতিষ চেম্বার! কলকাতা পুলিশের রহস্যভেদ হার মানাবে ওয়েব সিরিজকেও!
প্রায় ছ'মাস দক্ষিণবঙ্গের সব জেলা চষে ফেলার পর মিনাখাঁ থেকে একটি 'টিপ' পাওয়া গেল। ওসি আমিনুল হকের নেতৃত্বে বাসন্তী হাইওয়ে ধরে একটি দল রওনা দিল মিনাখাঁর উদ্দেশ্যে। পথে ভোজেরহাটের কাছে চা খেতে দাঁড়ালেন তারা। সেখানে এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেন আমিনুল। প্রায় ১৫-২০টা ইট বোঝাই ট্রাক চলেছে বাসন্তীর দিকে। অদ্ভুত কারণ দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোনও বাড়ি তৈরি হচ্ছে না, বা কোনও ইঁটভাটাও নেই। তাহলে ট্রাকগুলো যাচ্ছে কোথায়? চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করেন আমিনুল। সেখান থেকে জানা যায় ট্রাকগুলি যাচ্ছে ধামাখালি। বেশ কয়েকদিন ধরেই সেগুলি যাচ্ছে সেখানে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, "যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।" তাই ঠিক হল, এবার ধামাখালির ছাই ওড়ানো যাক! আমিনুল সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন লালবাজারে। এরা ঠিক কোথায় যাচ্ছে? কীসের জন্য যাচ্ছে? কে এর জন্য টাকা দিচ্ছে? সব খবর চাই। খবর মিললও। জানা গেল, ইঁটগুলি যাচ্ছে ধামাখালির আকুঞ্জিবাজারে। আকুঞ্জিবাজারের আকুঞ্জিদের চেনেনা এমন কেউ নেই। বিশাল মাছের আড়ৎ তাদের। পরিবারের কর্তা হলেন আব্দুল কাদের আকুঞ্জি (৫৫)। তাঁর চার ছেলে, মাজেদ (৩০), ওয়াজেদ (২৮), ওয়াহেদ (২৪) এবং ওহিদ (১৮)। স্থানীয় এলাকায় জিজ্ঞেস করে জানতে পারা যায়, বাজার চত্বরে একটি মসজিদ বানাচ্ছেন আকুঞ্জিরা। সব টাকা ওয়াজেদই দিচ্ছে, কলকাতায় বিশাল কারবার তার। ছোট ছেলে ওহিদ স্কুলে পড়ে এবং বাকি ভাইয়েরা বাবার সঙ্গে মাছের আড়ৎ দেখে। মসজিদ বানাচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু এক মাসেরও কম সময় এত বড় মসজিদ কীভাবে তৈরি হয়ে গেল তা ভেবে পান না ওসি আমিনুল হক। লালমোহন বাবুর ভাষায়, “হাইলি সাসপিশাস”।
সন্দেহের তির ওয়াজেদ আকুঞ্জির দিকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের ভিত্তিতে যে স্কেচ তৈরি হয়েছিল তা দেখানো হলো স্থানীয়দের। জানা গেল, সেই ওয়াজেদ আকুঞ্জি। এরপর একদিন সকালে, রেইড করা হল আকুঞ্জি নিবাসে। ২৫০০ স্কোয়ার মিটারের উপর নির্মিত বাড়িটিকে ছোটখাটো গ্রাম বলা যায়। দুটো পুকুর, ৭-৮ টা কুঁড়েঘর, গো-শালা কী নেই! সবের মাঝখানে আকুঞ্জিদের প্রাসাদোপম বাড়ি। বাড়ির লোকেদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, ‘কাজের সূত্রে’ প্রায় সময়ই কলকাতায় থাকে ওয়াজেদ। দু'মাসে দু' তিনবার বাড়ি আসে মাত্র। তবে ডাকাতির কথা শুনে বেজায় চটে গেলেন পরিবারের কর্তা আব্দুল কাদের আকুঞ্জি। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করেও খুঁজেও ব্যাঙ্ক থেকে লুট করা টাকা বা অন্যান্য হাতিয়ার কিছু পাওয়া গেল না। তবে আব্দুল কাদের আকুঞ্জির আপত্তি সত্ত্বেও মাজেদ এবং ওয়াহেদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো কলকাতায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। তারা ভাঙা রেকর্ডের মতো একই কথা বাজিয়ে গেল, “বিশ্বাস করুন স্যার, আমরা ডাকাতি সম্বন্ধে কিছু জানি না! ওয়াজেদ কোথায় জানিনা।” তবে এর আগে যে বিশাল এলাকা জুড়ে নেটওয়ার্ক ছড়ানো হয়েছিল তা এবার একটু গুটিয়ে আনা হলো। ভোজেরহাট-ঘটকপুর থেকে মিনাখাঁ-মালঞ্চ হয়ে ধামাখালি পর্যন্ত নিজেদের সোর্স এবং নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিল পুলিশ। সব চায়ের দোকানে ওয়াজেদ আকুঞ্জির ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হল। ফল মিলল হাতেনাতে। কয়েকদিনের মধ্যেই জানা গেল, ঘটকপুরে দেখা গেছে ওয়াজেদকে। স্থানীয় এক চা-ওয়ালা খবর দিয়েছে পুলিশকে। আমিনুল সেই চাওয়ালার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, ওয়াজেদ একা ছিল না, সঙ্গে ছিল এক বছর বাইশের তরুণীও। চায়ের দোকানে এসে একজন স্বাস্থ্যবান লোকের সঙ্গে কথা বলছিল ওয়াজেদ। সেই লোকটির নাম আবু গায়েন। সেও জড়িত ছিল এই ডাকাতিগুলির সঙ্গে। তাদের কথা শুনে চা-ওয়ালা বুঝতে পারে মেয়েটি একজন বার ডান্সার। এখন কলকাতা পুলিশের কাজ সেই বার ডান্সার মেয়েটিকে খুঁজে বার করা যাকে সম্প্রতি ধামাখালিতে দেখা গেছে। মেয়েটির খবর জানতে বেশি বেগ পেতে হলো না কলকাতা পুলিশকে। মেয়েটির নাম জয়শ্রী, এলিয়ট রোডের একটি নাইট ক্লাবে বার ডান্সার। বাড়ি হাতিবাগান এবং সেই পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। অতএব পুলিশের গন্তব্য এলিয়ট রোড।
“তু চিজ বড়ি হে মস্ত মস্ত” থেমে গিয়ে বাইরে চালু হয়েছে “গোরে গোরে মুখরে পে, কালা কালা চশমা”। গ্রিন রুমে বসে ফোঁপাচ্ছে জয়শ্রী। ৭-৮ জন অফিসার মিলে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কিন্তু বড্ড ঘাবড়ে গেছে মেয়েটি। বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে, “ওয়াজেদ আমায় মেরে ফেলবে”। অবশেষে জয়শ্রীকে ওসি আমিনুল হক আশ্বস্ত করেন যে তার নাম অফ দ্য রেকর্ড থাকবে। ধাতস্থ হতে প্রায় আধঘণ্টা সময় কেটে যায় জয়শ্রীর। সে জানায়, এলিয়ট রোডের ওই ক্লাবেই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ওয়াজেদের। বিগত কয়েক মাস ধরেই ওয়াজেদ তাকে দামী দামী ঘড়ি এবং পারফিউম উপহার দিচ্ছিল। সঙ্গে চার হাজার টাকা মাসোহারাও দিত। বদলে ওয়াজেদের সঙ্গে কখনও কখনও সময় কাটাতে হতো। একই সঙ্গে লেকটাউনে ওয়াজেদের গোপন আস্তানার কথাও পুলিশদের জানায় জয়শ্রী। ওসি আমিনুল হক দু'জন লেডি অফিসার, দু'জন সাদা পোশাকের পুলিশ-সহ ১৬ জন অফিসারকে নিয়ে রওনা দেন লেকটাউনের উদ্দেশ্যে। পকেটে গোঁজা পয়েন্ট ৩২ রিভলভার এবং দরজা ভাঙার জন্য ক্রোবার। রাতের অন্ধকারে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, গিরিশ পার্ক, বিবেকানন্দ রোড হয়ে লেকটাউনের উদ্দেশ্যে ছুটে চলল পুলিশের চারটি গাড়ি। উল্টোডাঙা ক্রসিংয়ে একটি গাড়িকে অপেক্ষা করতে বলে তিনটি গাড়ি গেল লেকটাউনের সেই হাউজিং কমপ্লেক্সে। হাউজিং কমপ্লেক্সের যে ফ্ল্যাটে ওয়াজেদ এবং তার গ্যাং গা ঢাকা দিয়েছিল, সেগুলি পুলিশকে চিনিয়ে দেয় জয়শ্রী। এরপর দু'জন লেডি কনস্টেবল এবং সিভিল পুলিশের সঙ্গে তাকে হাতিবাগানের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
রাত আড়াইটে। শুনশান হাউজিং কমপ্লেক্স। দরজার এপারে পয়েন্ট ৩২ রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে ৮ জন অফিসার। ভেতর থেকে গান ভেসে আসছে “আ দেখে জারা, কিস মে কিতনা হ্যায় দম”। পরপর দু'বার বেল বাজালেন ওসি আমিনুল হক। ওপার থেকে বাজখাঁই গলায় ভেসে এল, “এত রাতে কে রে!”। “কলকাতা পুলিশ! দরজা খোল”, সমস্বরে চেঁচিয়ে বললেন আমিনুল। কিছুক্ষণের স্তব্ধতা, তারপর ওপার থেকে ভেসে এল হুমকি, “আমাদের কাছে অটোমেটিক আছে। এক্ষুনি ফিরে না গেলে বাড়ির লোক তোদের বডি দেখে চিনতে পারবে না।” জানুয়ারির শীতেও আমিনুল হক বেশ বুঝতে পারছেন ঘাম ঝরছে তার কপাল দিয়ে। বাকি অফিসাররাও কিছুটা ঘাবড়ে গেছেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ দরজায় লাথি মারলেন মনোজ নামের এক তরুণ অফিসার। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় লাথিটাও। হঠাৎ করেই দরজাটা গেল খুলে আর কয়েক রাউন্ড গুলি ভেসে এল অফিসারদের দিকে। কারও কিছু না হলেও একটা গুলি মনোজের কাঁধ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। দ্বিতীয় রাউন্ড গুলি চলার আগেই গুলি চালিয়ে দিলেন আমিনুল এবং তাঁর অফিসাররা। একটা গুলি গিয়ে লাগল ওয়াজিদের কোমরে এবং আরেকটা গুলি লাগল উরুতে। তার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিটি ওয়াজেদের বন্দুক তুলতে গিয়েই এক অফিসারের লাথি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হলো কলকাতার উদীয়মান ‘সুলতানা ডাকু’ ওয়াজেদ আকুঞ্জিকে। গোলাগুলির শব্দ ততক্ষণে জেগে গিয়েছে গোটা হাউজিং কমপ্লেক্স। ওয়াজেদ এবং তার সঙ্গে থাকা বছর পঁচিশের ছেলেটিকে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজার। লেকটাউনের সেই হাউজিং কমপ্লেক্স থেকে উদ্ধার হয়েছিল কুড়ি লক্ষ টাকা! পরেরদিন সূর্যোদয়ের আগেই কড়েয়া রোড, এন্টালি, ট্যাংরা প্রভৃতি জায়গার হাইড-আউট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় গোটা গ্যাংকে। আবু গায়েনকে ঘটকপুর থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় পরদিন। প্রথম ডাকাতির ছ'মাসের মাথায় গোটা গ্যাং ছিল জেলের ভেতর।
আরও পড়ুন- কলকাতা ভোলেনি বন্দরের ‘গ্যাংযুদ্ধ’! সেকালের হত্যাকাণ্ডের সমাধানে ঘুম উড়েছিল পুলিশের
জেরায় জানা যায়, গ্যাংয়ের লিডার ছিল ওয়াজেদ আকুঞ্জিই। ডাকাতির পর পালানোর জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করার দায়িত্বে ছিল আবু গায়েন। কলকাতাকে আবু গায়েন হাতের তালুর মতো চিনত। এমনকী বছর পাঁচেক কলকাতার বড়বাজারে একটি চালের গোডাউনে কাজও করেছে সে। হাতিয়ার তোলা থেকে রেইকি করা, দলের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট কাজ বরাদ্দ করা ছিল। আরজি করে চিকিৎসা করে গুলি বার করা হয় ওয়াজেদের। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে আসা হয় লালবাজারে। শুরু হয় জেরা। আমিনুল ওয়াজেদকে জিজ্ঞেস করেন, এত বড় বাড়ির ছেলে হওয়া সত্বেও এই অসৎ পথে কেন নামতে হলো তাকে। জবাবে ওয়াজেদ জানায়, শুধুমাত্র আকুঞ্জিবাজার বা ধামাখালিতেই সে নিজের জীবন কাটাতে চায়নি। সে চেয়েছিল জীবনে বড় কিছু করতে, নিজের বাবা-দাদার থেকেও বেশি টাকা রোজগার করতে, বাড়ি-গাড়ি করতে। তখনই তার মাথায় আসে ডাকাতির ছক। তবে পরিষ্কার করে সে জানিয়ে দেয়, বাড়ির লোকে কিছুই জানত না এবিষয়ে। জেরায় ওয়াজেদ জানায়, তার ‘টার্গেট’ ছিল পাঁচ ছয় মাসের মধ্যে ১ কোটি টাকা ডাকাতি করা। এমনকী এর পরে বৌবাজার মেট্রোর কাছে একটি জায়গা থেকে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা ডাকাতির ছকও সারা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই পুলিশের হাতে পড়ে গেল। এরপর ওয়াজেদকে নিয়ে ফের আকুঞ্জিদের বাড়ি যায় পুলিশ। সেখানে মাটির নিচ থেকে উদ্ধার হয় প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। ওয়াজেদ জানিয়েছিল, চুরির পর দলের প্রত্যেককে সে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দিয়ে বাকিটা নিজের কাছেই রাখতো। বলতো হাওয়া ঠান্ডা হলে সবার মধ্যে টাকা ভাগ করে দেবে। ওয়াজেদের মুখের উপর কেউ কথা বলতে পারত না। কিন্তু আসলে সেই টাকা ফুর্তি করে উড়িয়ে দিয়েছিল সে। ওয়াজেদ আকুঞ্জি, আবু গায়েনদের বয়ানের উপর ভিত্তি করে চার্জশিট পেশ করে কলকাতা পুলিশ। প্রায় দু'বছর মামলা চলার পর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় আসামিদের।
আলিপুর কোর্টে পুলিশের হাত থেকে পালাতে চেয়েছিল ওয়াজেদ। কিন্তু ১০০ মিটারও যেতে পারেনি, তার আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। যথারীতি জেলেই স্থান হয় তার। তবে জেলে যেতেই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় ওয়াজেদের মধ্যে। ক্রমশ চুপচাপ হয়ে যায় সে। সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ধীরে ধীরে অবসাদে চলে যায়। এক কোটি টাকার 'টার্গেট' পুরো করতে না পারার অবসাদ নাকি পালানোর চেষ্টা করেও বিফল হওয়ায় বিষণ্ণতা, তা বোঝা যায়নি। এক সময় খাওয়া কমতে কমতে প্রায় বন্ধই হয়ে যায় ওয়াজেদের। জেলে ঢোকার কয়েক মাসের মধ্যেই হাট্টা-কাট্টা শরীর কঙ্কালসার হয়ে যায়। কোনও চিকিৎসাই আর কাজ করছিল না। বাড়ির লোক এলে তাদের সঙ্গেও কথা বলত না ওয়াজেদ। একে একে সব কঠিন রোগ ধরা পড়তে শুরু করে ওয়াজেদের শরীরে। জেলে যাওয়ার এক বছরেরও কম সময়ে ইহলোক ত্যাগ করে ওয়াজেদ।
তথ্যসূত্র-
কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজ