কাঁদতে কাঁদতেই লাইভ গান রেকর্ড! কেন জনপ্রিয়তায় আজও অধরা কেএল সায়গল?
Kundan Lal Saigal: ষোল বছরের ক্যারিয়ারে ১১০ খানা হিট গান গাইবার পর লিভার পচে মারা গেলেন সায়গল।
কেন আজ কুন্দন লাল সায়গল? এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে সায়গল প্রায় অশ্রুত এক গায়ক, যার গান যদি বা শোনা যায়, শুনি প্যারোডি হিসেবে। তাঁর গাওয়া 'এক বাংলা বনে নেয়ারা' নাকি সুরে গেয়ে এখনও মঞ্চ মাতান কত কমেডিয়ান। ধীর লয়ে গাওয়া, একেবারে মর্বিড এসব গানের অ্যাপিল আজকের যুবসমাজে পৌঁছয় না। সায়গলকে বুঝতে হলে তাই আমাদের আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভাবলে চলবে না। চলে যেতে হবে তিরিশের দশকের ভারতে, যেখানে আজকের অরিজিৎ সিং, মিকা, সোনু নিগম মিলিয়ে মিশিয়ে দশ দিয়ে গুণ করলে তবে একজন সায়গলের জনপ্রিয়তা দাঁড়াত। গান, সুর, অভিনয় সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক কমপ্লিট প্যাকেজ। টেকনিক্যালি একেবারে নিখুঁত, সঙ্গে গলার অদ্ভুত মাদকতা আর সিনেমার সিচুয়েশন বুঝে সেই গানেই ঢেলে দেওয়া অভিনয়। নায়ক গায়ক হিসেবে তাঁর ধারেকাছে আজ অবধি আসতে পারেননি অন্য কেউ।
সে এক অদ্ভুত সময়। সিনেমা সবে কথা বলতে শিখেছে। হাঁটছে গুটি গুটি পায়ে। প্লেব্যাক সিঙ্গিং ব্যাপারটাই কেউ সঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। সেই সময় একা হাতে সায়গল গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্লেব্যাকের সংজ্ঞা নিরূপণ করে একেবারে উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা দিয়েই সন্তুষ্ট হলেন না, আস্ত ব্যাকরণ বইটাই যেন লিখে ফেললেন। সেই দ্বিধা থরথর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সায়গল নিজে যে উচ্চতাটা সেট করে দিলেন, সমসাময়িক বাকিরা তার ধারেপাশে ছিল না। ফলত প্রায় গোটা তিরিশের দশকে সূর্যের মতো আলো দিয়ে গেছেন সায়গল। হারিয়ে গেছেন সুরেন্দ্র, জিএম দুরানি বা সি এইচ আতমা-রা। তারা সায়গলের কলিগ না, বরং ফ্যান ছিলেন বলা চলে। পরের প্রজন্মের গায়ক রফি, মুকেশ, তালাত কিংবা কিশোর ছিলেন সায়গলের শিষ্য। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এই রকম ওয়ান ম্যান ইন্ডাস্ট্রি, ওয়ান ম্যান ইন্সটিটিউশন আর একই সঙ্গে সুপারস্টার আর দ্বিতীয় কেউ নেই। ১৯৩২ সালে জৌনপুরী রাগে গাওয়া তাঁর নন ফিল্ম গ্রামাফোন রেকর্ড 'ঝুলনা ঝুলাও রি' এক বছরে বিক্রি হয়েছিল সাড়ে পাঁচ লক্ষ! মজার ব্যাপার, তখন খুব কম ভারতীয়দের বাড়িতেই গ্রামাফোন প্লেয়ার ছিল। যাদের ছিল সেই সংখ্যাটা ছয় লক্ষের কম। সোজা কথা, ভারতের প্রায় সব বাড়ির গ্রামাফোনেই সায়গল সাব বাজতেন। সায়গলের অসামান্য দখল ছিল তানে। উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব অবধি অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন সায়গলের তানের উপরে দখলে। যদি এটা মনে রাখি, সায়গলের প্রথাগত গানের শিক্ষা না ছিল কোনওদিনই, তবে সায়গলকে একেবারে সুপারহিউম্যান বলে মনে হয়। বি এন সরকার জহুরি মানুষ। সায়গলকে নিয়ে এলেন তাঁর নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। শুরু হল অভিনেতা সায়গলের নতুন যাত্রা।
আরও পড়ুন- ডুবন্ত সুরাইয়াকে বাঁচিয়েছিলেন তিনিই, তবু দেব আনন্দকে খুন করতে চেয়েছিল পরিবার…
এক বছরের বাদেই 'ইয়াহুদি কি লড়কি' ছবিতে সায়গল গাইলেন গালিবের গজল 'নুকতা চিন হ্যায় গম-এ-দিল'। ভীমপলশ্রী রাগে গাওয়া এই গান হিন্দি ছবির প্রথম ক্লাসিকাল গজল। পরে যখনই কেউ গালিবের গজলকে পর্দায় এনেছেন, প্রায় সবাই অন্ধভাবে অনুসরণ করেছেন সায়গলের গায়কিকে, যে গায়কি গানের কথাকে নতুন মানে দেয়, কিন্তু কখনই মূল টেক্সটকে ছাপিয়ে যায় না। এই ছবি সায়গলের জন্য সৌভাগ্যের বাতাস বয়ে নিয়ে এলেও অন্য এক গায়কের জন্য খারাপ খবর অপেক্ষা করছিল। তাঁকে দিয়ে বেশ কিছু গান গাওয়ানো হল। সিনেমার গানে সেই তাঁর ডেবিউ। শেষ মুহূর্তে শুনতে পেলেন তাঁর নাকে নাকে উচ্চারণ বড্ড শ্রুতিকটু ঠেকছে। নিউ থিয়েটার্স তাঁর গাওয়া সব গান ফেলে আবার নতুন করে পাহাড়ি সান্যালকে দিয়ে গাইয়েছে। এই তরুণ গায়কের নাম শচীন দেব বর্মন।
সায়গলে ফিরি। ১৯৩৫ সালে নিউ থিয়েটার্সের দেবদাস ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয়ের পর থেকে সায়গল জাতীয় ক্রাশে পরিণত হলেন (যদিও শব্দটা তখন ছিল না)। গান ছাপিয়ে তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা মুখে মুখে ফিরতে লাগল। সিনেমায় মাত্র দুটো গান 'বালম আয়ে বসো' আর 'দুখ কে আব দিন বিতত নাহি'। দেশ রাগে গাওয়া পরের গানটা এখনও যে কোনও ধ্রুপদী সঙ্গীত ছাত্রের টেমপ্লেট হতে পারে। গানের মধ্যে অভিনয়কে মিলিয়ে দিয়ে সায়গল যেটা করেছেন সেটা গান না, অভিনয়ও না, একমাত্র ম্যাজিক বলা চলে। গায়ক সায়গলের সেরা কাজ অবশ্যই আর সি বড়ালের সুর করা ভৈরবী ঠুমরী 'বাবুল মোরা নৈহার ছুট কি যায়'। ওয়াজেদ আলি শাহের লেখা। স্ট্রিট সিঙ্গার ছবির এই গান রেকর্ডও এক ইতিহাস। পরিচালক ফণী মজুমদারকে সায়গল বলেন, অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে লাইভ তিনি এই গানের রেকর্ড করবেন। দৃশ্যে সায়গল কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন। গলায় হারমোনিয়াম। তাঁর মধ্যেই তিনি গান গাইবেন। অভিনয় করবেন। এও সম্ভব! ফণী মজুমদার চ্যালেঞ্জ নিলেন। যে পথে সায়গল হাঁটবেন তার আশেপাশে সাউন্ড ক্যাচার লুকিয়ে রাখা হল। অর্কেস্ট্রা বাজল পুরো দমে। এক টেকে ওইরকম একটা আইকনিক গান নামালেন কে এল সায়গল। হিন্দি সিনেমায় এত নিবিড়ভাবে ভৈরবী রাগের ব্যবহার আগে হয়নি।
আরও পড়ুন- জোর করে ঠোঁটে চুমু খান নায়ক, বাধ্য হতে হয় নগ্ন চরিত্রে, কানন দেবী এক অজানা ‘বনফুল’
১৯৩০-এর শেষের দিকে নিউ থিয়েটার্স যখন প্রায় অস্তাচলে, তখন অনেকের মতো সায়গলও বোম্বের রঞ্জিত মুভিটোন স্টুডিওতে যোগ দেন। যাবার ঠিক আগে পঙ্কজ মল্লিকের সুরে 'ম্যায় ক্যায়া জানু ক্যায়া জাদু হ্যায়'-র জাদুতে মাতিয়ে বোম্বে চলে এলেন সায়গল। বোম্বেতে খেমচাঁদ প্রকাশ, জ্ঞান দত্ত, নৌসাদের সঙ্গে একের পর এক কালজয়ী গানের জন্ম দিলেন সায়গল। তবে সায়গলের গায়কির গুণে প্রতিটাই দিনের শেষে সায়গলের গান হয়ে উঠত। 'দিয়া জ্বলাও', 'বাগ লগা দুঁ সজনী', 'কাহেঁ গুমান করে' কিংবা 'মধুকরে শ্যাম হমারে চোর' গেয়ে বোম্বের মন জয় করে নিলেন কুন্দললাল। নৌশাদের সুরে শাহজাহান ছবির গান তো এখন কাল্ট স্ট্যাটাস পেয়ে গেছে।
এই শাহজাহানের পর থেকেই সায়গলের শরীর ভাঙতে থাকে। মদে আসক্তি মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। মদকে আদর করে ডাকতেন কালি পাঁচ। প্রতিটা গানের আগে-পরে এক বোতল কালি পাঁচ ছাড়া নাকি তার গলা খুলত না। তখন সায়গলের শরীর খুব খারাপ। নৌশাদ তাঁর হাতে পায়ে ধরার দশা। একটা গান অন্তত একটু সুস্থ হয়ে গেয়ে দেখুন। কিন্তু ভবি ভোলার নয়। অবশেষে নৌশাদের অনুরোধে শাহজাহান ছবির একটা গান দুইবার গাইলেন। একবার মদ না খেয়ে। একবার মদে চুর হয়ে। রেকর্ডিং হয়ে গেলে সায়গল স্বাভাবিক হওয়ার পর তাঁকে দুটোই শোনানো হল। তিনি একটা বেছে নিলেন। নৌশাদ সবিনয়ে জানালেন, এটা মদ না খেয়ে রেকর্ড করা। আর তাই মদের সঙ্গে গানের কোনও সম্পর্কই নেই। সায়গল অবাক। বললেন “এমন করে আগে কেউ আমায় বলেনি! সবাই শুধু আমি যা বলেছি বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নিয়েছে। কাশ তুম পহলে আতে মেরে জিন্দেগি মে”। তখন আর ফেরার পথ নেই। মদ আর তাঁকে ছাড়ল না। কিছুদিন পরেই ষোল বছরের ক্যারিয়ারে ১১০ খানা হিট গান গাইবার পর লিভার পচে মারা গেলেন সায়গল। আর সেই দুইবার গাওয়া গান 'যব দিল হি টুট গয়া, হাম জিকে ক্যায়া করেঙ্গে' ভারতীয় ছবির মাইলফলক হয়ে রয়ে গেল।