অযোধ্যা কেন বিজেপিকে তাড়াল? কী বলছেন রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত?
Ayodhya Ram Mandir Votes: বিজেপি জনতাকে ভাবাতে চেয়েছিল “জো রাম কো লায়ে হ্যায়, হাম উনকো লায়েঙ্গে"। কিন্তু জনতা বেছে নিল সমাজবাদী পার্টির অবধেশ প্রসাদকে
ফৈজাবাদ, রামমন্দির যেখানে অবস্থিত সেই লোকসভা কেন্দ্রেই ভারতীয় জনতা পার্টি যাচ্ছেতাই রকমভাবে হেরে গিয়েছে। ২০২৪ সালের গোড়াতেই রাম মন্দিরের তড়িঘড়ি উদ্বোধন করে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছিল লোকসভা ভোটে এটি এক মোক্ষম তাস। তারপর অবশ্য বিজেপি এও বোঝে একা রামমন্দির দিয়ে গড় রক্ষা হবে না। তাই কখনও সিএএ চালু করা, কখনও বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেফতারি, কখনও মুসলিমদের অপমান, আস্তিন থেকে সমস্ত তাস বের করে এনেছে গেরুয়া বাহিনী। তবুও, শেষরক্ষা হয়নি। ফৈজাবাদের মানুষ বিজেপি নয়, বেছে নিয়েছেন বিরোধীদের হিন্দু দলিত প্রার্থীকে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি এই নির্বাচনে রামের নামে ভোট চেয়েছিল নির্বাচনের নির্দেশিকা এবং রাজনৈতিক শালীনতাকে উপেক্ষা করেই। উত্তরপ্রদেশের মতো জায়গাতেই বিপর্যস্ত হয়েছে তারা। ফৈজাবাদে কি রামের ম্যাজিক কাজ করল না? ভোটে হেরে রামকেও কি ত্যাগ করল দল?
পরাজয়ের পরে রামনাম জপতে বিশেষ দেখা যাচ্ছে না বিজেপিকে। বিজেপি গত কয়েক দশক ধরে রামমন্দিরের নামে বিভাজন তৈরিতে কোনও কসরত করতে ছাড়েনি। ১৯৯২ সালে বাবরি ধ্বংসের পর ২০২৪ সালে রামমন্দির তৈরিকে বিজেপি জয় ভেবেছিল ঠিকই, কিন্তু ফৈজাবাদ ভাবেনি। বিজেপি জনতাকে ভাবাতে চেয়েছিল “জো রাম কো লায়ে হ্যায়, হাম উনকো লায়েঙ্গে"। কিন্তু জনতা বেছে নিল সমাজবাদী পার্টির অবধেশ প্রসাদকে, একজন দলিত নেতাকে। বিজেপির লাল্লু সিং রামের নামে ভোট টানতেই পারলেন না। ভোটের ফল বেরোতেই ডানপন্থী ফেসবুক প্রোফাইলগুলি থেকে অযোধ্যার ভোটারদের অপমান করা, অকথ্য গালিগালাজ করা চলতে থাকে। অর্থনৈতিকভাবে এই মানুষদের বয়কট করার ডাকও দিয়েছে ডানপন্থী প্রোফাইলগুলি! মাত্র ছয় মাস আগেই কোটি কোটি ভারতীয়কে এই ডানপন্থীরাই বুঝিয়েছিল অযোধ্যায় মন্দিরের পর্যটন এই জায়গার অর্থনীতিকে নতুন করে গড়ে তুলবে। মোদি এই মন্দিরটিকে বিশ্বের হিন্দুদের তীর্থ করে তুলবেন।
আরও পড়ুন- মণিপুরের দুর্দশার জন্য দায়ি মোদিই? যা বলছেন আরএসএসের মোহন ভাগবত…
১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকের রাম মন্দির আন্দোলন বিজেপিকে কেন্দ্রে এবং অনেক রাজ্যে ক্ষমতায় এনে দিয়েছিল। তখনই বিজেপি রামের জন্য বড় মন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০২৪ সালে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণও হয়। বিজেপি ভেবেছিল হিন্দুত্ববাদ প্রচারের এই শ্রেষ্ঠ অস্ত্রটিই বিপুল ভোট এনে দেবে লোকসভা নির্বাচনে। ভক্তিরস না, রামমন্দির ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের 'শো-পিস' মাত্র।
বিজয় ভাষণে, মোদি রাম বা উত্তরপ্রদেশের কোনও উল্লেখ করেননি। অথচ এই রাজ্যটির থেকেই লোকসভায় ৮০ জন সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে বিজেপির বিপুল জয়ের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল উত্তরপ্রদেশের। মোদি নিজেই বারাণসীর সাংসদ। অথচ ভোটের ফল বেরোতেই রামের থেকে সোজা জগন্নাথ ভক্ত হয়ে গেলেন মোদি কারণ বিজেপি ওড়িশা বিধানসভার দখল নিয়েছে নবীন পট্টনায়েকের ২৪ বছরের সরকারের পতন ঘটিয়ে। এনডিএ-র বৈঠকে এক ভাষণে মোদি জগন্নাথকে 'গরিবের দেবতা' বলেন। রামের কোনও উল্লেখই করলেন না তিনি।
বিজেপি রাম মন্দির নির্মাণের জন্য যে শুধু পুরস্কার হিসাবে হিন্দু ভোট চেয়েছিল তাই নয়, রামের প্রাণ প্রতিষ্টা অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার জন্য বিরোধী নেতাদের তুলোধোনাও করেছিল। ২০২৪ সালের নির্বাচনকে 'রামভক্ত এবং রামদ্রোহী'দের মধ্যেকার লড়াই করে তোলেন যোগীও।
কিন্তু উত্তরপ্রদেশে হারের পরে, রামের নামে প্রচার চালানো আদিত্যনাথ রাম নিয়েও চুপ, ফল নিয়েও চুপ। বিজেপি কেন অযোধ্যা এবং আশেপাশের আসন আম্বেদকর নগর, বাস্তি এবং বারাবাঁকিতে হেরেছে, এই কারণ এখনও জনসাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেনি বিজেপি। ১৯৮০-৯০ এর দশকে রাম মন্দির আন্দোলনে বিজেপির ওবিসি মাসকট কল্যাণ সিংয়ের ছেলে রাজবীর সিং-এর দখলে থাকা ইটাহ আসনেও কীভাবে হারল বিজেপি, তারও সদুত্তর নেই। ফৈজাবাদে বিজেপির হারের একাধিক কারণ আছে। সাধারণ আসনে একজন পাসি দলিতকে প্রার্থী করা ছিল বিরোধীদের বড় পদক্ষেপ। জনগণ সরকার ও বর্তমান সাংসদের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে মাথায় রেখেই ধর্মের রাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে।
আরও পড়ুন- উত্তরপ্রদেশই উলটে গেল! কে গিলে ফেলল রাম মন্দিরের সাফল্য?
৪ জুন ভোটের ফল প্রকাশ্যে আসতেই মোদি 'জয় জগন্নাথ' স্লোগান দিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন। করতেই হতো, ওড়িশায় বিজেপির নির্বাচনী পারফরম্যান্সের ছিল চমকে দেওয়ার মতোই। রাজ্যের ২১টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২০টিই জিতেছে বিজেপি এবং বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকারও গড়েছে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ এবং রামকে উপেক্ষা করে, জয় শ্রী রাম ভুলে রাতারাতি জয় জগন্নাথ হয়ে যাওয়া বুঝিয়ে দেয় রাম এবং হিন্দুত্বপ্রীতি নয়, আসলে সবটাই ক্ষমতার খেল! জগন্নাথ লাভ দিয়েছেন, রাম লোকসান। সাক্ষী মহারাজ, উন্নাওয়ের বিজেপির সাংসদ স্পষ্টই বলে দিয়েছেন অযোধ্যার ভোটাররা অকৃতজ্ঞ। ফেসবুক জুড়ে বিজেপির তরফে চলছে ভোটারদের গালাগালি দেওয়ার সমস্ত চেষ্টাই।
রামমন্দিরের প্রধান পুরোহিত আচার্য সত্যেন্দ্র দাস বলেছেন, যারা অযোধ্যার মানুষকে অপমান করছে এবং নির্বাচনের ফলাফলের জন্য তাদের দোষারোপ করছে তারা তাদের 'মূর্খতা'ই প্রকাশ করছে। “তারা স্পষ্টতই ভগবান রামের ভক্তি বোঝে না। এই ধরনের লোকেরা, যারা রামকে শুধুমাত্র নির্বাচনী ইস্যু হিসাবে দেখেন তারা তুচ্ছ এবং ঘৃণ্য,” দ্য ওয়্যারকে বলেছেন সত্যেন্দ্র।
অযোধ্যা এবং রাম কখনই অযোধ্যায় আরএসএস-বিজেপির বিশ্বাসের এজেন্ডা ছিল না। রাম মন্দির একেবারেই ভোট অর্জনের হাতিয়ার ছিল। অযোধ্যার মানুষ এই হাতিয়ারকে ভোঁতা করে দিয়েছেন।