চরমে কাগজ সংকট, বই নেই পড়ুয়াদের! পাকিস্তান এগোচ্ছে শ্রীলঙ্কার পথেই?
পাকিস্তানের কাগজ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলির তরফে জানানো হয়েছে, কাগজের সংকট হু হু করে বাড়ছে। দাম এত বেশি যে, তা কিনতেই পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে বইখাতাও তৈরি হচ্ছে না।
ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকট তাড়া করছে এবার ভারতের আর এক পড়শি রাষ্ট্র পাকিস্তানকে। ইসলামাবাদ এতদিন সন্ত্রাসবাদ পুষেছে ও ভারতে তা রপ্তানি করেছে, এমনটা অভিযোগ ছিল। এবার অর্থ-সংকট নিয়ে নাজেহাল শাহবাজ শরিফ। ভয়ানক অবস্থা সেদেশের কাগজ ইন্ডাস্ট্রিগুলোর। শ্রীলঙ্কার কাগজ সংকটের ছায়া এবার গ্রাস করল পাকিস্তানকে। নতুন শিক্ষাবর্ষে পড়ুয়ারা হাতে নাও পেতে পারে নতুন বই।
দেশজুড়ে শুরু হয়েছে কাগজের সংকট। বই ছাপানো আটকে থাকছে কাগজের অভাবে। পরিস্থিতি এমনই, যে আসন্ন সেশনে নতুন ক্লাসে উঠে বইখাতা না-ও পেতে পারে পড়ুয়ারা। এমনই অবস্থা পাকিস্তানের। সরকারি নীতির গাফিলতিতে এই অবস্থায় পৌঁছেছে সে-দেশের কাগজের বাজার।
পাকিস্তানের কাগজ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলির তরফে জানানো হয়েছে, কাগজের সংকট হু হু করে বাড়ছে। দাম এত বেশি যে, তা কিনতেই পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে বইখাতাও তৈরি হচ্ছে না। এই বছরের কোনও টেক্সট বুক এখনও ছাপা শুরুই হয়নি। আগস্ট থেকে নতুন ক্লাসে উঠে বইখাতা পাবে না পড়ুয়ারা।
আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার মতোই অবস্থা হবে পাকিস্তানের! কেন অন্ধকারে ডুবে গোটা দেশ?
পাকিস্তান পেপার অ্যাসোশিয়েসন সতর্ক করে জানিয়েছে, আগস্ট মাসে চলতি বছরের শিক্ষাবর্ষে পাকিস্তানে তীব্র কাগজ সংকটের জেরে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বই সহজলভ্য হবে না। পাকিস্তান সরকারের ভুল নীতির জন্য সেই দেশে তীব্র কাগজ সংকট দেখা দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না বলে চাপানউতোর রাজনৈতিক মহলে।
পাকিস্তানের সকল পেপার মার্চেন্ট অ্যাসোশিয়েসন, পাকিস্তানের প্রিন্টিং গ্রাফিক আর্ট ইন্ডাস্ট্রি এবং পেপার ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত অর্থনীতিবিদ ড. কুইসার পাকিস্তানে তীব্র কাগজ সংকটের কথা জানিয়েছেন। পাকিস্তানে ক্রমশ লাগামছাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে কাগজের দাম। যার প্রভাব সরাসরি বইয়ের ওপর পড়ছে। এই সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়েছে যে, চলতি শিক্ষাবর্ষে আগস্ট মাসে পাকিস্তানে পেপার ক্রাইসিসের জেরে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বই আর সহজলভ্য হবে না। তীব্র কাগজ সংকটের জেরে, সিন্ধ বোর্ড, পাঞ্জাব বোর্ডের টেক্সট বুক চলতি শিক্ষাবর্ষে এবার আর বই ছাপাতে সক্ষম হচ্ছে না।
শ্রীলঙ্কার ছায়া?
চলতি বছরের মার্চ মাসে একই ছবি উঠে এসেছিল শ্রীলঙ্কায়। তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেখা গিয়েছিল সে-দেশে। ছিল না প্রিন্টিং পেপার। আর যার জেরে পরীক্ষা বাতিল করতে হয় শ্রীলঙ্কার সরকারকে। পেপার কিনতে না পেরে সারা দেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। কবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা।
সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়ে দেন, বাইরে থেকে কাগজ কেনার মতো ডলার দেশে নেই। চলতি বছরে মার্চে স্কুল-শিক্ষার্থীদের জন্য মেয়াদি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও দেশে কাগজের তীব্র সংকট। সেই কারণে পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়।
শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যায়। পশ্চিমাঞ্চল প্রদেশের শিক্ষা বিভাগ বলেছে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের কারণে বাইরে থেকে কাগজ ও কালি আমদানি করা যায়নি। সেই কারণে কোনও স্কুলেই পরীক্ষা পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।
সরকারের এই পদক্ষেপে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনুমান, শ্রীলঙ্কায় ৪.৫ মিলিয়ন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। শ্রীলঙ্কায় টার্ম টেস্ট হল এক ধরনের চূড়ান্ত পরীক্ষা, যেখানে শিক্ষার্থী পরবর্তী ক্লাসে যেতে পারবে কি না, তা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার দ্বারা নির্ধারিত হয়। এটি বছরের শেষ পরীক্ষা। ফলে কাগজের সংকটে পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় তলিয়ে যায় লাখ লাখ পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ। সেই সঙ্কটের ভূত এবার তাড়া করছে পাকিস্তানকেও।
শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের এত ঘাটতি দেখা দিয়েছে যে, প্রয়োজনীয় আমদানির জন্য টাকাও তোলা যায়নি। এই অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নিত্য-প্রয়োজনীয় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ আমদানিও বন্ধ হয়ে যায়। এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় মহাজন চিনকে অনুরোধ করলেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তানের পাশে চিন
পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা— দুই দেশেই দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট এক প্রাথমিক সমস্যা। যা তাদের কোভিড অতিমারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কালে আরও বেশি সংকটাপন্ন করে তোলে। পাকিস্তান তিন দশকেরও কিছু বেশি সময় ১৩ বার আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেয় (যার বেশিরভাগই ঋণের শর্তপূরণে অক্ষমতার কারণে মাঝপথে পরিত্যক্ত হয়) এবং সেই দেশ এক বেপথু অর্থনীতির রাষ্ট্রে পর্যবসিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ৬ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের আইএমএফ ঋণ স্থগিত রাখা হয়েছে এবং চিন পাকিস্তানের অনুরোধে এই বিপদে উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
আর্থিক সংকটের হাত থেকে পাকিস্তানকে বাঁচাতে এগিয়ে এল চিন। চিনের একাধিক ব্যাঙ্কের কনসর্টিয়াম পাকিস্তানকে ২৩০ কোটি ডলার দিচ্ছে। পাকিস্তানের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ের অবস্থা খুবই খারাপ জায়গায় এসে পৌঁছেছে। পাকিস্তানের মুদ্রার মূল্যও ভয়ংকরভাবে কমে গিয়েছে। এই সংকট থেকে ইসলামাবাদকে উদ্ধার করতে চিনের একাধিক ব্যাঙ্কের কনর্সটিয়াম ২৩০ কোটি ডলার দিচ্ছে।
পাক অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইল চিনকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছেন, আর দিন দুই-তিনের মধ্যেই অর্থ হাতে এসে যাবে। এর ফলে দেশের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারে কিছু অর্থ জমা পড়বে এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নও ঠেকানো যাবে বলে তিনি জানিয়েছেন। বর্তমান আর্থিক বছরে পাকিস্তানে রুপির দাম ডলারের তুলনায় ৩৪ শতাংশ কমেছে।
গত ১০ জুনের হিসেব হলো, পাকিস্তানের স্টেট ব্যাঙ্কের কাছে ৯০০ কোটি ডলার আছে, তা দিয়ে মাত্র ছয় সপ্তাহের আমদানির খরচ মেটানো সম্ভব। তাই পাকিস্তানের কাছে চিনের থেকে পাওয়া ২৩০ কোটি ডলারের খুবই প্রয়োজন ছিল।
এরপরও একটি মহলের প্রশ্ন, আর্থিক সংকটে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কার মতো হাল হবে না তো পাকিস্তানের?
সবদিক বিচার করলে শ্রীলঙ্কার কাহিনিটিই সব থেকে মর্মান্তিক। সেখানে কর এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে গত তিন বছরে এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ অবনমন ঘটে। অবশ্যম্ভাবীভাবে দেশের ঋণের হারে তার ছায়াপাত ঘটে, বাজেট-ঘাটতি বিস্ময়করভাবে বেড়ে জিডিপি-র ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। বৈদেশিক ঋণ (যা মূলত রাজকোষের ঘাটতি মেটাতেই ব্যয় হয়ে গিয়েছে) শোধের বিষয়টি দুরূহ থেকে ক্রমে অসম্ভবের দিকে ঢলে পড়েছিল, যার ফল বৈদেশিক বিনিময়ের সংকট এবং দেশের মুদ্রার মানের অপ্রতিরোধ্য পতন। কৃষিক্ষেত্রেরও সংকট দেখা যায়, যার জেরে খাবারের আকাল দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে জাহাজবোঝাই খাদ্যশস্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। এখন পাকিস্তানের আকাশে সেই সংকটের মেঘ ঘনীভূত।