বাংলায় এসআইআর ২০২৫: বিজেপির অনুপ্রবেশ দাবি আর তথ্য যা বলছে
SIR 2025 in West Bengal: বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছে, সংখ্যালঘু-প্রধান সীমান্ত জেলাগুলিতে বেশি অনথিভুক্ত মানুষ রয়েছেন। কিন্তু এসআইআর-এর তথ্য বলছে ঠিক উল্টো, এই জেলাগুলিতেই বৈধ নথি থাকা মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
ভারতের নির্বাচন কমিশন (ECI) সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR)-এর অধীনে যে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে, তা রাজ্যের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত একটি বহুল প্রচলিত রাজনৈতিক বয়ানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে।
২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে বর্তমান ভোটারদের তথ্য যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। এই প্রক্রিয়ার ফলাফল কার্যত ভেঙে দিচ্ছে বিজেপির দীর্ঘদিনের প্রচার— যেখানে সংখ্যালঘু-প্রধান সীমান্ত এলাকাগুলিকে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বা ‘রোহিঙ্গা’ ভোটারের ঘাঁটি হিসেবে দেখানো হয়।
রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। গ্রামীণ সংখ্যালঘু জনসংখ্যাই রাজ্যের সবচেয়ে বেশি নথিভুক্ত ও প্রামাণ্য নাগরিক গোষ্ঠী। বরং তথাকথিত ‘নাগরিকত্ব সংকট’ এখন কেন্দ্রীভূত হয়েছে হিন্দু শরণার্থী এবং শহুরে শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর উপর।
২০২৫ সালের এসআইআর প্রক্রিয়ায় ভোটারদের নামকে পুরনো নথির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে বলা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে ২০০২ সালের ভোটার তালিকাকেই মূল ভিত্তি ধরা হয়েছে।
যাঁরা পুরনো তালিকার সঙ্গে নিজেদের নাম মিলিয়ে দেখাতে পারছেন না, তাঁদের ‘নো ম্যাপিং’ বিভাগে রাখা হচ্ছে। এতে তাঁদের ভোটার হওয়ার যোগ্যতা প্রমাণ করতে বাড়তি কাগজপত্র জমা দিতে হচ্ছে এবং শুনানিতে হাজির হতে হচ্ছে। একই সঙ্গে যাঁরা অনুপস্থিত, স্থানান্তরিত, মৃত বা একাধিকবার তালিকাভুক্ত— তাঁদের নাম ‘ASD’ বিভাগে আলাদা করে বাদ দেওয়া হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর২০২৫-এর প্রাথমিক বিশ্লেষণ থেকে উঠে আসা পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে তুলে ধরা হলো।
সংখ্যালঘুরাই সবচেয়ে বেশি নথিভুক্ত
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ‘অবৈধ অভিবাসী’ নিয়ে প্রচলিত ধারণাটি পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিলছে না। বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছে, সংখ্যালঘু-প্রধান সীমান্ত জেলাগুলিতে বেশি অনথিভুক্ত মানুষ রয়েছেন। কিন্তু এসআইআর-এর তথ্য বলছে ঠিক উল্টো, এই জেলাগুলিতেই বৈধ নথি থাকা মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন
“আমাদের নাম কি বাদ পড়বে?”: এসআইআর আতঙ্কে উত্তরবঙ্গের রাজবংশীরা
মুর্শিদাবাদ জেলার তথ্যেই বিষয়টি সবচেয়ে পরিষ্কার। বাংলাদেশ সীমান্তে থাকায় এই জেলা রাজনৈতিক আলোচনায় বারবার উঠে আসে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সীমান্তে থাকা বা সংখ্যালঘু জনসংখ্যা বেশি হওয়া—এর কোনোটাই নথির ঘাটতির কারণ নয়। মুসলিম-প্রধান অনেক বিধানসভা কেন্দ্রে ‘নো ম্যাপিং’ হার খুবই কম। যেমন, ডোমকল (৭৭.৬৭% মুসলিম) কেন্দ্রে নো ম্যাপিং মাত্র ০.৪২%, রানিনগরে (৭৫.৪০% মুসলিম) ০.৯১% এবং হরিহরপাড়ায় (৭৪.৯৬% মুসলিম) ০.৬০%।
এই তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, কৃষিভিত্তিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বহু পুরনো বসবাসের ইতিহাস ও প্রয়োজনীয় নথি রয়েছে। তাই ২০০২ সালের তালিকার সঙ্গে তাঁদের নাম মিলিয়ে নেওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, যেখানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা বেশি, সেখানে নথির অভাবে বাদ পড়ার হার আরও কম। ফলে ‘অবৈধ অভিবাসী’ বলে যে ধারণা ছড়ানো হয়, তার কোনও সংখ্যাগত ভিত্তি নেই।
মতুয়া: শরণার্থীদের ভোটাধিকার সংকট
সবচেয়ে বেশি ‘নো ম্যাপিং’ দেখা যাচ্ছে মতুয়া-প্রধান বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে। সীমান্ত এলাকার এই দলিত শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করেই বিজেপির রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হয়েছে।
নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার ১৭টি মতুয়া-প্রধান আসনের তথ্য বলছে, এখানে গড় নো ম্যাপিং হার ৯.৪৭%, যা রাজ্যের গড় হার ৪.০৫%-এর তুলনায় অনেক বেশি। এই কেন্দ্রগুলিতে তফসিলি জাতির জনসংখ্যা বেশি (গড়ে ৩৬.৩৯%), কিন্তু সংখ্যালঘু জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম (মাত্র ১৩.৬৬%)।
তথ্য থেকে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা, যা মতুয়া সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, সেখানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা মাত্র ৭.৬১% হলেও নো ম্যাপিং হার ১৪.৫১%, অর্থাৎ ৩৮,৪৯০ জন ভোটারের নাম মিলছে না। পাশের বাগদা তফসিলি জাতি আসনেও একই চিত্র, সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ১১.৯৭%, কিন্তু নো ম্যাপিং ১২.৬৯% (৩৬,৫৬৭ ভোটার)।
এর কারণ হলো, ২০০২ সালের কাট-অফের পরে আসা বা পরে নির্যাতনের কারণে দেশ ছেড়ে আসা বহু হিন্দু শরণার্থীর কাছে প্রয়োজনীয় পুরনো নথি নেই। ফলে এসআইআর প্রক্রিয়া শরণার্থী জীবনকেই এক ধরনের পরীক্ষার মধ্যে ফেলছে। এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন সেই মানুষরাই, যাঁদের সুরক্ষার কথা বলে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) আনা হয়েছিল।
এই তথ্য থেকে একটি বড় রাজনৈতিক অসংগতি সামনে আসে। বিজেপি যাঁদের ‘বহিরাগত মুসলিম অনুপ্রবেশকারী’ বলে থাকে, বাস্তবে তারা নয়, বরং ১৯৭১-এর পর আসা হিন্দু শরণার্থীরাই এসআইআরের পুরনো নথির শর্তে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন। মতুয়া শরণার্থীদের ক্ষেত্রে ২০০২ সালের তালিকার সঙ্গে নাম মেলানোর নিয়ম কার্যত নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা তৈরি করছে, যা বিজেপির CAA দিয়ে সুরক্ষা দেওয়ার দাবির সঙ্গে মেলে না।
ভুয়ো ভোটার বাতিলের অভিযান
সীমান্ত এলাকার বাইরে, পশ্চিমবঙ্গের শহর ও শিল্পাঞ্চলে বড় শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক কারণে মানুষের আসা-যাওয়া, নাগরিকত্ব নয়। তথ্য বলছে, কলকাতায় ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ার হার গ্রামীণ জেলার তুলনায় অনেক বেশি।
কলকাতার বাণিজ্যিক এলাকা জোড়াসাঁকোতে ৩৬.৮৫% ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। চৌরঙ্গীতেও একই চিত্র, সেখানে ৩৫.৪৬% ভোটারের নাম বাদ গিয়েছে, অর্থাৎ দুই এলাকাতেই এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভোটার আর তালিকায় নেই।
জেলাস্তরেও একই চিত্র, কলকাতা উত্তরে ২৫.৯৩% এবং কলকাতা দক্ষিণে ২৩.৮৩% ভোটার বাদ পড়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, এখানে ধর্মের কোনো ভূমিকা নেই। সংখ্যালঘু কম থাকা এলাকা যেমন শ্যামপুকুর বা রাসবিহারী হোক, কিংবা সংখ্যালঘু বেশি থাকা কলকাতা পোর্ট ও বালিগঞ্জ, সব জায়গাতেই অনেক ভোটারের নাম বাদ পড়ছে। এতে বোঝা যায়, সমস্যার মূল কারণ ধর্ম নয়, শহরের মানুষের ঘন ঘন স্থানবদল।
এর প্রভাব আসন্ন নির্বাচনেও পড়তে পারে। যদি অনেক অনুপস্থিত বা ডুপ্লিকেট নাম একসঙ্গে বাদ যায়, তাহলে শহরের আসনগুলিতে প্রকৃত ভোটার সংখ্যা অনেক কমে যাবে। এর ফলে ভোটের হার এবং জয়ের ব্যবধানও বড়ভাবে বদলে যেতে পারে।
শিল্পাঞ্চলে উল্টো অভিবাসনের ছাপ
শিল্পাঞ্চলগুলিতে, বিশেষ করে যেখানে হিন্দিভাষী পরিযায়ী শ্রমিক বেশি, সেখানে উল্টো অভিবাসনের স্পষ্ট ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব এলাকায় একদিকে নো ম্যাপিং হার মাঝারি থেকে বেশি, আবার অন্যদিকে অনেক ভোটারের নাম তালিকা থেকেও বাদ পড়ছে। এতে বোঝা যায়, এটি সীমান্ত বা নাগরিকত্বের সমস্যা নয়, বরং কাজের খোঁজে মানুষের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাওয়ার ফল।
আরও পড়ুন
‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন আজও | টোটোপাড়ায় এসআইআর যে প্রশ্ন তুলছে
ব্যারাকপুর-হাওড়া শিল্প অঞ্চলে এই চিত্র সবচেয়ে স্পষ্ট। এখানে পাটকল, ছোট কারখানা, নির্মাণ শ্রম আর ভাড়াবাড়ির সংখ্যা বেশি। বালিতে প্রায় ১৯.৫১% ভোটারের নাম বাদ পড়েছে এবং ১৭.৮১% নো ম্যাপিংয়ে পড়েছে। হাওড়া উত্তরে এই হার ২৬.৯৫% ও ১২.৪২%। ভাটপাড়ায় ২০.৩৮% ও ৯.৩%, আর আসানসোল উত্তরে ১৪.৭১% ও ৮.৭৪%, সব এলাকাতেই পরিসংখ্যানের একই রকম ওঠানামা দেখা যাচ্ছে।
কলকারখানা বন্ধ হওয়া, নির্মাণ প্রকল্প শেষ হওয়া ও বাড়তি ভাড়ার চাপে শ্রমিক পরিবারগুলি এলাকা ছাড়ছে। ফলে বহু ভোটার ‘স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে একাধিক ঠিকানায় বসবাসের কারণে বহু পুরনো ভোটার ২০০২ সালের তালিকার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারছেন না। এর ফলেই শিল্প ও যাতায়াত-নির্ভর এলাকাগুলি এসআইআর প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক ধাক্কার মুখে পড়েছে।
ধর্ম নয়, লক্ষ্য ‘অবৈধ নাগরিক’ চিহ্নিতকরণ
সব মিলিয়ে এসআইআর— ২০২৫ ধর্মের পরীক্ষা নয়, স্থায়িত্বের পরীক্ষা। তথ্য স্পষ্ট জানাচ্ছে, নো ম্যাপিং বেশি হচ্ছে শহরের মানুষ ও শরণার্থীদের ক্ষেত্রে, সংখ্যালঘু জনসংখ্যার কারণে নয়। বরং সংখ্যালঘু-প্রধান এলাকাতেই নথির সমস্যা সবচেয়ে কম। যাঁরা বাস্তুচ্যুত হয়ে নথি হারিয়েছেন বা ঘন ঘন স্থানান্তরিত হন, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি চিহ্নিত হচ্ছেন। অন্যদিকে, স্থিতিশীল গ্রামের মানুষদের নাগরিকত্ব আরও দৃঢ়ভাবে বৈধতা পাচ্ছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাই লড়াইয়ের চেহারা বদলে গিয়েছে। প্রশ্ন আর শুধু কে ভোট দেবে, তা নয়, কে নিজেকে ভোটার হিসেবে প্রমাণ করতে পারবে, সেটাই মূল বিষয়। আর তথ্য বলছে, যাঁদের ‘বহিরাগত’ বলা হয়, তাঁরা এরাজ্যেরই দীর্ঘদিনের স্থায়ী বাসিন্দা।
(মূল প্রতিবেদনটি প্রাথমিক ভাবে দ্য ওয়্যার-এ প্রকাশিত হয়েছিল।)
Whatsapp
