ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় ছাড়! যেভাবে বছরের পর বছর গান্ধী পরিবারকে হেনস্থা করা হয়েছে

National Herald Case: এই মামলায় ইডির অভিযোগের উৎস ছিল একটি private complaint, অর্থাৎ ব্যক্তিগত অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি আদালতে এসেছে। কিন্তু সেই অভিযোগের সঙ্গে সরাসরি কোনো এফআইআর যুক্ত ছিল না।

ভারতীয় রাজনীতিতে এমন কিছু মামলা আছে, যা কেবল আইনের পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বিতর্ক, ক্ষমতার সংঘাত এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থার ভূমিকা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে ধরে। ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা তেমনই এক দীর্ঘস্থায়ী ও বহুমাত্রিক বিতর্কের নাম। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এই মামলাটি আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতের এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ের পর।

ন্যাশনাল হেরাল্ড ঘিরে একের পর এক সমন, জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে হাজিরা এবং সম্পত্তি সংযুক্তির মতো পদক্ষেপ নিতে দেখা গিয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে। প্রতিবারই এই পদক্ষেপগুলির সঙ্গে রাজনৈতিক আবহে একটি বার্তা স্পষ্ট ছিল— দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল ও তার নেতৃত্ব ‘দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত’। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে অভিযোগের আইনি ভিত্তি কতটা মজবুত, সেই প্রশ্নটি বারবারই অনালোচিত থেকে গিয়েছে।

এই মামলার সূচনা হয় ২০১২ সালে। সেই সময় বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী আদালতের দ্বারস্থ হয়ে একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন, যার কেন্দ্রে ছিল অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেড (Associated Journals Limited) নামে একটি সংস্থা। এই সংস্থাই একসময় ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকা প্রকাশ করত, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। অভিযোগে বলা হয়, অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেডের বিপুল সম্পত্তি ও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে এবং সেই অনিয়মের সুবিধাভোগী হিসেবে উঠে আসে আরেকটি সংস্থার নাম— ইয়ং ইন্ডিয়ান প্রাইভেট লিমিটেড (Young Indian Private Limited)।

আরও পড়ুন

নেহরু-নৈতিকতার বিসর্জন! ভারতের বিদেশনীতিতে দ্বিচারিতার যে ছায়া

সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর অভিযোগ অনুযায়ী, কংগ্রেস দল অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেডকে আর্থিক সহায়তা হিসেবে ঋণ দিয়েছিল। পরে সেই ঋণের বিনিময়ে অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেডের নিয়ন্ত্রণ কার্যত চলে যায় ইয়ং ইন্ডিয়ানের হাতে। এই ইয়ং ইন্ডিয়ান সংস্থার প্রধান শেয়ারহোল্ডার ছিলেন কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী। অভিযোগ ছিল, নামমাত্র মূল্যে বিপুল সম্পত্তি হাতবদল হয়েছে এবং সেই প্রক্রিয়া আইনি ভাবে স্বচ্ছ ছিল না। সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর দাবি, এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত আর্থিক কৌশল, যার মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়েছে বেআইনি পথে।

২০১৪ সালে দিল্লির একটি আদালত এই অভিযোগ গ্রহণ করে। এখান থেকেই মামলাটি আনুষ্ঠানিক আইনি যাত্রা শুরু করে। প্রাথমিক শুনানির পাশাপাশি বিভিন্ন নথি ও লেনদেনের খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখতে শুরু করে তদন্তকারী সংস্থাগুলি। এই পর্যায়ে বিষয়টি মূলত আদালতের সীমার মধ্যেই ছিল এবং তখনও কোনো মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত মামলা আনুষ্ঠানিক ভাবে সামনে আসেনি।

২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মামলাটি নতুন গতি পায়। ইডি (Enforcement Directorate) এবং অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেড ও ইয়ং ইন্ডিয়ান প্রাইভেট লিমিটেডের আর্থিক লেনদেন, সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এবং শেয়ার কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে। যদিও এই সময়ে মামলাটি এখনও তদন্ত স্তরেই ছিল এবং বিচার প্রক্রিয়া কার্যত শুরু হয়নি, তবু রাজনৈতিক অঙ্গনে বিষয়টি ক্রমশ বড় ইস্যুতে পরিণত হতে থাকে।

২০২১ সালকে এই মামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হিসেবে ধরা হয়। এই বছর থেকেই ইডি আনুষ্ঠানিক ভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন (PMLA)-এর আওতায় বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু করে। তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্য ছিল, অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেড ও ইয়ং ইন্ডিয়ান প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যকার আর্থিক লেনদেনের মধ্যে মানি লন্ডারিং-এর প্রাথমিক ইঙ্গিত রয়েছে। বিপুল অঙ্কের সম্পত্তি ও অর্থের গতিপথ নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইডি দাবি করে, এটি কেবল একটি কর্পোরেট পুনর্গঠন নয়, বরং সম্ভাব্য আর্থিক অপরাধ।

এই তদন্ত দীর্ঘ সময় ধরে চলার পর ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বড় পদক্ষেপ নেয় ইডি। ১৫ এপ্রিল আদালতে একটি চার্জশিট দাখিল করা হয়, যেখানে সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী ছাড়াও স্যাম পিত্রোদা ও সুমন দুবের নাম উল্লেখ করা হয়। চার্জশিটে বলা হয়, অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেডের সম্পত্তি ইয়ং ইন্ডিয়ানের মাধ্যমে কম দামে অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং সেই প্রক্রিয়াটি মানি লন্ডারিং-এর আওতাভুক্ত। ইডির দাবি অনুযায়ী, এই সম্পত্তি হস্তান্তরের ফলে গান্ধী পরিবারের আর্থিক লাভ হয়েছে।

এই সময়েই ইডি বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেডের সম্পত্তি সংযুক্ত করে এবং আদালতে জানায় যে এগুলি ‘অপরাধ থেকে পাওয়া টাকা' (proceeds of crime) হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মে মাসে আদালতে এই চার্জশিট নিয়ে শুনানি শুরু হয়। ইডি জোর দিয়ে বলে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের অধীনে এই মামলার বিচার হওয়া উচিত। তবে এখানেই আইনি জটিলতা সামনে আসে। কারণ, মানি লন্ডারিং মামলার ক্ষেত্রে যে ‘predicate offence’ বা মূল অপরাধের ভিত্তিতে এফআইআর থাকা জরুরি, তা এই ক্ষেত্রে স্পষ্ট ছিল না। মামলাটি মূলত একটি ব্যক্তিগত অভিযোগের উপর দাঁড়িয়ে ছিল।

দীর্ঘ শুনানির পর ২০২৫ সালের জুলাই মাসে আদালত রায় সংরক্ষণ করে। রাজনৈতিক মহলে তখন থেকেই জল্পনা শুরু হয়, আদালতের সিদ্ধান্ত কোন দিকে যাবে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫-এ দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালত রায় ঘোষণা করে। আদালত জানায়, ইডির দাখিল করা মানি লন্ডারিং চার্জশিটের উপর এই মুহূর্তে ‘cognisance’ নেওয়া সম্ভব নয় অর্থাৎ আদালতের মামলাটি গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

কেন ইডির অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়?

আদালতের প্রথম এবং প্রধান যুক্তি ছিল মানি লন্ডারিং-এর আইনের মৌলিক শর্ত ঘিরে। বিচারকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মানি লন্ডারিংয়ের মামলা শুরু করার জন্য অবশ্যই একটি ‘predicate offence’ বা মূল অপরাধ থাকতে হবে, যার ভিত্তিতে একটি বৈধ এফআইআর নথিভুক্ত হওয়া জরুরি। এই মামলায় ইডির অভিযোগের উৎস ছিল একটি private complaint, অর্থাৎ ব্যক্তিগত অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি আদালতে এসেছে। কিন্তু সেই অভিযোগের সঙ্গে সরাসরি কোনো এফআইআর যুক্ত ছিল না। আদালতের মতে, এই পরিস্থিতিতে মানি লন্ডারিং-এর আওতায় মামলা গ্রহণ করা আইনত সম্ভব নয়। ফলে ইডির দাখিল করা অভিযোগকে এই পর্যায়ে ‘maintainable’ (গ্রহণযোগ্য) বলা যায় না। প্রশ্ন থাকছেই, এই অভিযোগ যেভাবে দাখিল করা হয়েছে, তা যদি গ্রহণ করা সম্ভব নাই হয়, তবে এত বছর ধরে এই মামলার ভার বহন করতে হলো কেন?

আরও পড়ুন

কেন পিকের সঙ্গে বৈঠক প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর?

দ্বিতীয়ত, আদালত বিশেষভাবে জোর দিয়ে জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মামলার বিষয়বস্তুর সত্যতা বা অভিযোগের নৈতিকতা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা হচ্ছে না। অর্থাৎ, সনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী দোষী না নির্দোষ এই প্রশ্নে আদালত এখনও কোনো অবস্থান নেয়নি। বিচারক স্পষ্ট করেছেন, বর্তমান রায় কেবলমাত্র আইনি গ্রহণযোগ্যতা বা procedural validity সংক্রান্ত। ইডির অভিযোগ আইনগত কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেই বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না, কিন্তু এতে অভিযোগের সারবত্তা নিয়ে কোনো চূড়ান্ত মত দেওয়া হয়নি।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিতে আদালত আরও একটি দিক তুলে ধরে। বিচারকের নজরে আনা হয়, দিল্লি পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ দমন শাখা (Economic Offences Wing) ইতোমধ্যেই একই আর্থিক লেনদেন ও সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে একটি এফআইআর নথিভুক্ত করেছে। অর্থাৎ, যে অপরাধকে ‘predicate offence’ বা মূল অপরাধ হিসেবে ধরা যেতে পারে, তার একটি আইনি ভিত্তি ইতোমধ্যেই বিদ্যমান। আদালতের মতে, ইডি চাইলে সেই এফআইআরের উপর ভিত্তি করেই মানি লন্ডারিং অনুযায়ী তদন্ত চালাতে পারে। আইন অনুযায়ী সেই পথ খোলা রয়েছে, কিন্তু বর্তমান অভিযোগ যেভাবে দাখিল করা হয়েছে, তা গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

প্রসঙ্গত, এই রায়ের আইনি তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। মানি লন্ডারিং-এর মতো কঠোর আইনের ক্ষেত্রেও প্রক্রিয়াগত সঠিকতার প্রশ্নে আদালত আপস করতে রাজি নয়, এই বার্তাই উঠে এসেছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দিক থেকেও এই মামলা দীর্ঘদিন ধরেই কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে সংঘাতের অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠেছে। কংগ্রেস এই রায়কে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে আইনি জয় হিসেবে দেখছে, অন্যদিকে বিজেপির বক্তব্য, এটি মামলার শেষ নয়, বরং একটি পর্যায় মাত্র। ভবিষ্যতে এই মামলা কোন দিকে মোড় নেয়, তা নির্ভর করবে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ ও উচ্চ আদালতের অবস্থানের উপর। কিন্তু আপাতত এটুকু স্পষ্ট, ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় ‘ছাড়’ শুধু একটি আইনি সিদ্ধান্ত নয়, এটি বছরের পর বছর ধরে চলা রাজনৈতিক হেনস্থার অভিযোগকে নতুন করে সামনে এনে দিয়েছে।

More Articles