কেন 'শান্তি বিল' নিয়ে লোকসভায় উত্তেজনা?
SHANTI Bill Explained: বিরোধীদের মতে, বেসরকারি সংস্থার প্রবেশের সুযোগ বাড়ানো হলেও পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বায়ত্তশাসন ও শক্তি বাড়ানোর বিষয়টি বিলে যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
ভারতের পারমাণবিক শক্তি নীতিতে বড়সড় পরিবর্তনের পথে হাঁটতে চাইছে মোদি সরকার। সেই লক্ষ্যেই সংসদে আনা হয়েছে বহুল আলোচিত ‘শান্তি বিল’ (SHANTI Bill)। কিন্তু এই বিল ঘিরেই তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পারমাণবিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা বা ‘নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি’ সংক্রান্ত একটি ধারাকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধীদের সংঘাত আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে। কংগ্রেসের অভিযোগ, এই বিলের আড়ালে কর্পোরেট স্বার্থকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে।
কংগ্রেসের দাবি অনুযায়ী, কংগ্রেসের মতে, শান্তি বিল আসলে ২০১০ সালের Civil Liability for Nuclear Damage Act-এর মূল উদ্দেশ্য ও কঠোরতা অনেকটাই কমিয়ে দিচ্ছে। ওই আইনে স্পষ্টভাবে বলা ছিল, পারমাণবিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী নয়, প্রয়োজনে সরঞ্জাম সরবরাহকারী সংস্থাকেও দায়ী করা যাবে। এর ফলে কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা নির্মাণগত গাফিলতির জন্য বিদেশি বা দেশীয় সরবরাহকারী সংস্থার বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পথ খোলা ছিল। কিন্তু নতুন শান্তি বিলে সেই ‘রাইট টু রিকোর্স’ বা সরবরাহকারীর বিরুদ্ধে দায় চাপানোর অধিকার কার্যত সীমিত করে দেওয়া হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
লোকসভায় বিল নিয়ে বিতর্কে কংগ্রেস স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, এটি একটি 'কর্পোরেটপন্থী আইন', যা বড় শিল্পগোষ্ঠী ও বিদেশি পারমাণবিক সংস্থাগুলিকে সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়েছে। কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারির প্রশ্ন, যদি কোনো পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে এবং তার কারণ হয় সরঞ্জামের ত্রুটি বা নকশাগত ভুল, তাহলে কেন সেই সরবরাহকারী সংস্থাকে দায়মুক্ত রাখা হবে? তাঁর মতে, এই বিলের মাধ্যমে সরকার আসলে সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণের দায় রাষ্ট্রের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে, আর কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে আইনি ঝুঁকি থেকে বাঁচাচ্ছে।
আরও পড়ুন
হিন্দু মানেই বিজেপি নয়, অযোধ্যা শিক্ষা দিয়েছে, লোকসভায় রাহুল
শান্তি বিলের আরেকটি বিতর্কিত দিক হলো ক্ষতিপূরণের সর্বোচ্চ সীমা। প্রস্তাবিত আইনে অপারেটরের দায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। এই সীমার বেশি ক্ষতির ক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে। কংগ্রেসের বক্তব্য, একটি বড়সড় পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর এই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ একেবারেই অপ্রতুল। তারা ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার উদাহরণ টেনে বলেছে, কয়েক দশক আগে ঘটে যাওয়া সেই শিল্প বিপর্যয়ের ক্ষতিপূরণের অঙ্কই ছিল এর চেয়েও বেশি। সেখানে পারমাণবিক দুর্ঘটনার মতো মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে এমন বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে এত কম ক্ষতিপূরণ কীভাবে ন্যায্য হতে পারে, সেই প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী শিবির।
কেন্দ্র সরকারের যুক্তি অবশ্য ভিন্ন। সরকারের দাবি, ভারতের পারমাণবিক শক্তি খাতকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে হলে এবং ভবিষ্যতের শক্তি চাহিদা মেটাতে হলে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। বর্তমান দায়বদ্ধতা আইন এতটাই কঠোর ছিল যে বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা ভারতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায়নি। শান্তি বিল সেই জট খুলে দেবে এবং দেশে নতুন পারমাণবিক প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াবে বলে সরকারের আশা। সরকারের মতে, এতে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে, তেমনই কম কার্বন নির্গমনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাতেও সাহায্য করবে পারমাণবিক শক্তি।
তবে বিরোধীরা সরকারের এই যুক্তিকে পুরোপুরি খারিজ করে দিয়েছে। কংগ্রেসের অভিযোগ, নিরাপত্তা ও জনস্বার্থের প্রশ্নে কোনো আপস করা যায় না। পারমাণবিক শক্তি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে একবার দুর্ঘটনা ঘটলে তার প্রভাব প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহন করতে হয়। সেই কারণে এই খাতে আইনি দায়বদ্ধতা যতটা সম্ভব কঠোর হওয়া উচিত, শিথিল নয়। শান্তি বিল সেই দায়বদ্ধতাকেই দুর্বল করছে বলে তাদের দাবি।
বিল নিয়ে বিতর্কের আরেকটি বড় দিক হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা। বিরোধীদের মতে, বেসরকারি সংস্থার প্রবেশের সুযোগ বাড়ানো হলেও পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বায়ত্তশাসন ও শক্তি বাড়ানোর বিষয়টি বিলে যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কংগ্রেসের প্রশ্ন, যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে বড় কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া আদৌ সম্ভব হবে কি না।
আরও পড়ুন
কেন শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনেই অচল লোকসভা?
এই সমস্ত কারণ দেখিয়ে কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দল শান্তি বিলকে যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানোর দাবি জানায়। তাদের বক্তব্য ছিল, এমন সংবেদনশীল একটি বিষয় নিয়ে তড়িঘড়ি আইন পাশ না করে বিশেষজ্ঞ মতামত, জনমত ও বিস্তারিত পর্যালোচনা প্রয়োজন। কিন্তু সরকার সেই দাবি মানেনি। শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের ওয়াকআউটের মধ্যেই লোকসভায় বিলটি পাশ হয়ে যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শান্তি বিল শুধু একটি আইন নয়। এটি আসলে দেশের উন্নয়নের পথ নিয়ে চলা বড় বিতর্কের অংশ। একদিকে দ্রুত শিল্প গড়ে তোলা, বিদেশি বিনিয়োগ আনা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চাপ রয়েছে। অন্যদিকে মানুষের নিরাপত্তা, পরিবেশের ক্ষতি এবং দায়িত্ব নির্ধারণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শান্তি বিল এই দু'দিকে ঠিকমতো ভারসাম্য রাখতে পেরেছে কি না, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।
এখন দেখার বিষয়, এই বিল কার্যকর হওয়ার পর বাস্তবে কীভাবে তার প্রয়োগ হয়। পারমাণবিক প্রকল্পে বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণ বাড়লেও, কোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্য বিচার ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা যায় কি না, সেটাই হবে আসল পরীক্ষা। আপাতত শান্তি বিল ভারতের পারমাণবিক নীতিতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হলেও, তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

Whatsapp
