বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থান থেকে রাজনীতিতে আসা ওসমান হাদি কে?
Osman Hadi: ব্যক্তিগত জীবনে শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন একজন শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন।
রাজনীতির মঞ্চে উত্থান যেমন আকস্মিক ছিল, তেমনই নাটকীয়ভাবে থেমে গেল জীবন। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ছয় দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারালেন শরিফ ওসমান হাদি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে যাঁর নাম খুব অল্প সময়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছিল— কখনও তীব্র সমর্থনে, কখনও প্রবল বিতর্কে। কে ছিলেন এই তরুণ নেতা? কীভাবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির দৃশ্যে দ্রুত পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেন তিনি? আর কেন তাঁর বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড একদিকে তৈরি করেছিল অনুসারীদের শক্ত বলয়, অন্যদিকে জন্ম দিয়েছিল বিরোধিতা ও শত্রুতার?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। বক্তৃতার তীক্ষ্ণতা, সামাজিক মাধ্যমে সরব উপস্থিতি এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে আগ্রাসী অবস্থান তাঁকে পরিচিত করে তোলে স্বল্প সময়েই। সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন আপসহীন ও স্পষ্টভাষী এক কণ্ঠস্বর, আবার সমালোচকদের চোখে ছিলেন উসকানিমূলক ও বিতর্কপ্রবণ এক রাজনৈতিক চরিত্র।
১২ ডিসেম্বর দুপুর। রাজধানীর বিজয়নগরের কালভার্ট রোডে নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণাদাতা শরিফ ওসমান হাদি। ঠিক সেই সময়েই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। একটি গুলি তাঁর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই গুরুতর আহত হন তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই বদলে যায় পরিস্থিতি, নির্বাচনী প্রচার রূপ নেয় রক্তাক্ত সহিংসতায়।
আরও পড়ুন
আসিফ, মাহফুজদের পদত্যাগ: বিএনপির দিকে ঝুঁকছেন তরুণ নেতারা?
আহত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসকদের প্রাথমিক চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর অবস্থা দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য তাঁকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের কোথায়, মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তাঁর অবস্থা ছিল ‘অত্যন্ত জটিল ও সংকটজনক’।
তিন দিন পর, ১৫ ডিসেম্বর, আরও উন্নত চিকিৎসার আশায় তাঁকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখানকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চললেও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত ছয় দিনের লড়াই থেমে যায়। বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
মৃত্যুর খবর প্রথম জানানো হয় তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে। সেখানে তাঁকে ‘শহিদ’ আখ্যা দিয়ে একটি আবেগঘন বার্তা পোস্ট করা হয়। একই সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চের অফিসিয়াল পেজ থেকেও মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। মুহূর্তের মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে শোক, ক্ষোভ ও নানা প্রতিক্রিয়ার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে।
শরীফ ওসমান হাদির রাজনৈতিক উত্থান ছিল মূলত ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর। তার আগে পর্যন্ত তিনি মূলধারার কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় নেতা ছিলেন না। শিক্ষাজীবন থেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকলেও দলীয় রাজনীতিতে তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততা চোখে পড়েনি। তবে জুলাই অভ্যুত্থান তাঁকে নতুন পরিচয়ে সামনে নিয়ে আসে।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তিনি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ নামে একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন। এই প্ল্যাটফর্মের মূল লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়— আধিপত্যবাদের বিরোধিতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবি। এখান থেকেই তিনি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগসহ নানা ইস্যুতে সোচ্চার বক্তব্য রাখতে শুরু করেন।
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনায় তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি তাঁকে ব্যাপক আলোচনায় নিয়ে আসে। একইভাবে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের উপর হামলার পর তাঁর প্রতিক্রিয়াও নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর বক্তব্যে ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সমালোচকরা একে অশালীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বললেও সমর্থকদের একাংশ তাঁকে দেখেছেন নির্ভীক ও আপসহীন হিসেবে।
সামাজিক মাধ্যম ছিল শরিফ ওসমান হাদির সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। ফেসবুক লাইভ, পোস্ট ও ভিডিওর মাধ্যমে তিনি নিয়মিত নিজের অবস্থান তুলে ধরতেন। নির্বাচনী প্রচারণার নানা মুহূর্ত— লিফলেট বিতরণ, ভোররাতে মসজিদের সামনে উপস্থিতি, অর্থ সংগ্রহ কিংবা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথোপকথন; সবই তিনি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করতেন। এর অনেকগুলোই ভাইরাল হয়েছে, তৈরি করেছে সমর্থন ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের একটি বড় পদক্ষেপ। মতিঝিল, পল্টন, রমনা ও শাহজাহানপুর এলাকা নিয়ে গঠিত এই আসনে তিনি প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তির বাইরে একটি বিকল্প কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। প্রচারণার সময় বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে তাঁর মন্তব্যও আলোচনায় আসে।
আরও পড়ুন
ভোট প্রচারের সময় আহত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র! কী ঘটেছিল ওসমান হাদির সঙ্গে?
তবে এই উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে হুমকির অভিযোগ। তিনি নিজেই বিভিন্ন সময় দাবি করেছিলেন, দেশি-বিদেশি নম্বর থেকে তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া একাধিক পোস্টে তিনি পরিবারের সদস্যদের ক্ষতির আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তাঁর উপর এই হামলা সেই অভিযোগগুলোকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসে।
ব্যক্তিগত জীবনে শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন একজন শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার কোচিংয়েও ক্লাস নিতেন। বরিশালের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থেকে উঠে আসা এই তরুণের শিক্ষাজীবনের শুরু হয়েছিল স্থানীয় একটি কামিল মাদ্রাসায়। সেখান থেকে আলিম পাস করে তিনি ঢাকায় পাড়ি জমান।
রাজনীতিতে তাঁর উপস্থিতি যেমন নতুন আশার কথা বলেছিল, তেমনি বিতর্কও কম ছিল না। মুড়ি-বাতাসা বিতরণ থেকে শুরু করে প্রচারণার কৌশল, সবকিছুই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ তাঁকে দেখেছেন প্রচলিত রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক তরুণ কণ্ঠস্বর হিসেবে, আবার কেউ মনে করেছেন তাঁর বক্তব্য ও আচরণ ছিল অতিরিক্ত উসকানিমূলক ও দায়িত্বহীন।
গুলিবিদ্ধ হয়ে শরিফ ওসমান হাদির জীবন থেমে গেলেও তাঁকে ঘিরে প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে অনেক। নিরাপত্তা, রাজনৈতিক সহিংসতা, মত প্রকাশের পরিণতি— সব মিলিয়ে তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে অস্বস্তিকর বাস্তবতাকেই সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। ছয় দিনের লড়াইয়ের শেষে থেমে যাওয়া এই জীবন রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, সেই মূল্যায়নই এখন সময়ের অপেক্ষা।

Whatsapp
