এক রাতের সহিংসতায় যে ভয়াবহতা দেখল বাংলাদেশ

Bangladesh Witnesses Night of Unprecedented Violence: ডেইলি স্টারের ক্রীড়া সাংবাদিক একুশ তরফদার ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন, "আমরা এখন নিরাপদ থাকলেও আমরা সবাই ট্রমাটাইজড। আমাদের মানসিক অবস্থা ভালো নেই।"

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশ এক রাতেই প্রত্যক্ষ করল ভয়াবহ অস্থিরতা, সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর সরাসরি আঘাতের দৃশ্য। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, রাজশাহী-সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনায় কার্যত আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়।

এই সহিংসতার সবচেয়ে বড় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় বাংলাদেশের শীর্ষ দু'টি সংবাদমাধ্যম— দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার। ১৮ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার কারওয়ানবাজারে অবস্থিত এই দু'টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে একদল হামলাকারী প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে কার্যালয়ের বিভিন্ন অংশে। পর দিন সকালে দেখা গিয়েছে, প্রথম আলোর চারতলা বিল্ডিং পুরোটাই পুড়ে গিয়েছে। জানালার কাচ ভাঙা, দেওয়াল কালো হয়ে যাওয়া এবং ভেতরের কাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। কিছু অংশ থেকে তখনও ধোঁয়া বেরচ্ছিল। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। এই বিল্ডিংটি প্রথম আলোর একাধিক বিভাগের কার্যালয় ছিল। আগুনে অফিসের আসবাব, নথিপত্র ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন পরিস্থিতির কারণে প্রথম আলোর প্রকাশনা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

একই সময় হামলার শিকার হয় পাশেই অবস্থিত দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়। হামলাকারীদের দেওয়া আগুনে কার্যালয়ের নিচতলা ও দোতলা সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। ভেতরে ঢুকে তারা আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং অফিসের বিভিন্ন সামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে। শুক্রবার সকালে ডেইলি স্টারের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও দেখা যায়। হামলার সময় দু'টি সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ের ভেতরে উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও কর্মী। আগুন ছড়িয়ে পড়ায় তাঁরা কার্যালয়ের ভেতরে আটকা পড়েন। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ক্রেন ব্যবহার করে তাঁদের নিরাপদে উদ্ধার করেন এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। অভিযোগ, হামলাকারীরা শুধু আগুনই নয়, লুটপাটেও জড়িত ছিল। 

ডেইলি স্টারের ক্রীড়া সাংবাদিক একুশ তরফদার ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন,

আমাদের প্রতিষ্ঠানে যখন হামলা হয়, তখন আমরা সবাই সেখানে ছিলাম না। আমাদের কিছু সহকর্মী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ স্পোর্টস সেকশনে যাঁরা কাজ করি, আমরা সবাই আগেই বেরিয়ে এসেছিলাম। তবে আমাদের অন্যান্য সেকশনের প্রায় ২৮ জন সহকর্মী তখন অফিসে ছিলেন। হামলা শুরু হওয়ার পর তাঁরা ডেইলি স্টার ভবনের ছাদে উঠে আশ্রয় নেন। ছাদে থাকা পানির ট্যাংকের উপর উঠে তাঁরা নিজেদের লুকিয়ে রাখেন। এর মধ্যেই ভবনের নিচতলা পুরোপুরি আগুনে ভস্মীভূত করা হয় এবং সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থান থেকে রাজনীতিতে আসা ওসমান হাদি কে?

তিনি আরও বলেন,

আগুন লাগানোর ফলে ভেতরে থাকা অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আমাদের নিউজরুমেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে, এমনকি আমার নিজের ডেস্কও ভাঙা হয়েছে। অনেক কিছু লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছে ওরা। বিভিন্ন সহকর্মীর ক্যামেরা, দামী ল্যাপটপ— যেগুলো পেয়েছে, সবই লুট করে নিয়ে গিয়েছে।

তাঁর কথায়,

ফায়ার সার্ভিস আসার পর আগুন নেভানো হয়। কিন্তু আগুন নেভানোর পরও আমাদের যে সহকর্মীরা ছাদের উপর আটকে ছিলেন, তাঁরা নিচে নামতে পারছিলেন না। কারণ নিচে তখনও মব উপস্থিত ছিল। সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও মব ছিল, আর তাদের ভয়েই নামা যাচ্ছিল না। মবের লোকজন বারবার বলছিল, ‘এদের নামিয়ে দিলে পুরো বিল্ডিংটা আমরা ধ্বংস করে ফেলব।’ এই হুমকির কারণে আমাদের সহকর্মীরা দীর্ঘ সময় ছাদেই আটকে ছিলেন। ভোর পাঁচটায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আমাদের সহকর্মীরা নিরাপদে নিচে নামতে পারেন এবং পরে একটি নিরাপদ সেফ হাউসে যেতে সক্ষম হন। এর পরদিন শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর ) আমাদের পত্রিকা প্রকাশ হয়নি, বিকাল পর্যন্ত সব কিছু বন্ধ ছিল। পরে বিকাল থেকে অনলাইনে রিমোটলি কাজ শুরু করা হয়।

একুশ তরফদার বলেন,

শুধু এটুকুই নয়, আমাদের সহকর্মীদের উদ্ধারের জন্য আরেকটি পত্রিকা দ্য নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর ঘটনাস্থলে গেলে তাঁকেও হেনস্তা করা হয়। তাঁকে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করা হয়।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন,

এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক মনে হলেও কখন কী ঘটে, সেই শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। 

সংবাদমাধ্যমের উপর হামলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনও রেহাই পায়নি। রাত একটার দিকে ধানমন্ডিতে অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রাচীন সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বিল্ডিং-এও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয় এবং সেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে বিল্ডিং-এর বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলার কয়েক ঘণ্টা পর, রাত সাড়ে তিনটার দিকে ছায়ানটের ফেসবুক পেজ থেকে একটি ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে জানানো হয়, নিরাপত্তাজনিত কারণে ‘ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তন’-এর সব ক্লাস-সহ সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।

ডেইলি স্টারের ওই সাংবাদিক বলেন,

বাংলাদেশের অন্যতম বড় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বিভিন্ন মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

শেষে তিনি বলেন,

আমরা এখন নিরাপদ থাকলেও আমরা সবাই ট্রমাটাইজড। আমাদের মানসিক অবস্থা ভালো নেই। আমাদের পরিবারের সদস্যরাও উদ্বিগ্ন।

এদিন (১৮ ডিসেম্বর) রাতে আবারও হামলার শিকার হয় ধানমন্ডি-৩২-এ অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়ির অবশিষ্ট কাঠামো। আগেও দু’বার গুঁড়িয়ে দেওয়া এই স্থাপনায় ফের আগুন লাগানো হয়। শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের লাইভ সম্প্রচারে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি ইট দিয়ে বাড়িটির অবশিষ্ট দেওয়াল ভাঙছে। সহিংসতার বিস্তার রাজধানীর বাইরে গিয়েও ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে অবস্থিত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ও হামলার শিকার হয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করলে হামলাকারীরা পাল্টা ইট ছোড়ে। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

একই রাতে চট্টগ্রামে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনের বাসভবনেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের একটি পার্টি অফিস ভাঙচুর করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সারারাত ধরে এসব ঘটনার পর, রাত সাড়ে চারটার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজ থেকে একটি বার্তা প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়,

ওসমান হাদীকে যারা খুন করেছে তাদের হাতে দেশকে তুলে দিয়েন না।

আরও পড়ুন

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন টানাপোড়েন! শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ কোন পথে?

একই বার্তায় আরও লেখা হয়,

ভাঙচুর আর আগুন সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে তারা মূলত বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। তারা এই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করতে চায়। ৩২ আর ৩৬ এক জিনিস না এইটা আপনাদের বুঝতে হবে।

এই সহিংস ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেও বক্তব্য আসে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ‌সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেশে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরির ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র নিহত হওয়ার ঘটনাকে সেই অপচেষ্টার অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া বার্তায় দেশবাসীর প্রতি ধৈর্য ও সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই সংকটময় সময়ে উত্তেজনার বদলে প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়াই সবচেয়ে জরুরি।

এক রাতের এই সহিংসতা বাংলাদেশকে দাঁড় করিয়েছে গভীর প্রশ্নের মুখে। সংবাদমাধ্যম, সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক স্মৃতি ও কূটনৈতিক স্থাপনায় একযোগে হামলার ঘটনা শুধু আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতাই নয়, বরং গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর সরাসরি আঘাত হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। যে দৃশ্য বাংলাদেশ দেখল, তা কেবল ধ্বংসস্তূপের নয়; এটি সহনশীলতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার উপর নেমে আসা এক ভয়াবহ অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি।

More Articles