মনরেগা থেকে শান্তি বিল: যেভাবে লোকসভা হাসির খোরাকে পরিণত হলো
Winter Session 2025: মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (MNREGA)-এর জায়গায় আনা বিকশিত ভারত-জি রাম জি (VB-G RAM G) বিলটি প্রকল্পটির চরিত্রই বদলে দেয়।
লোকসভার ১৮তম শীতকালীন অধিবেশন ১৯ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। দিনটি আলোচনা বা বিতর্কের জন্য নয়, বরং সংসদের নিয়মকানুন ভেঙে দ্রুত আইন পাশ করানোর জন্যই বেশি মনে থাকবে। মাত্র ১৯ দিনের মধ্যে সংসদ আইনপ্রণেতাদের আলোচনার মঞ্চ থেকে বদলে গিয়ে শুধু বিল পাশ করানোর জায়গায় পরিণত হয়। এই অধিবেশনে বিতর্কিত আইন জোর করে পাশ করানো হয়েছে এবং নেতৃত্বের অভাবে সংসদের মর্যাদা কার্যত প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
১৯ ডিসেম্বর পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। দেশের রাজধানীর বাসিন্দাদের বায়ুদূষণে হাঁসফাঁস করা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বিরোধী সাংসদরা অধিবেশন মুলতবি প্রস্তাব আনলেও তা মানা হয়নি। সংসদের দুই কক্ষের ভেতরে তখন এমন এক পরিবেশ তৈরি হয় যে আলোচনা করা বা খতিয়ে দেখার বদলে দ্রুত আইন পাশ করাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই হট্টগোলের মধ্যেই সরকার ভয়েস ভোটের মাধ্যমে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করিয়ে নেয়— বিকশিত ভারত গ্যারান্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন (গ্রামীণ) (VB-G RAM G) বিল এবং শান্তি (SHANTI) বিল। ভয়েস ভোট এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে বিশৃঙ্খলার সুযোগে কারা পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিলেন তার কোনো লিখিত রেকর্ড থাকে না, ফলে পৃথক সাংসদদের জবাবদিহিতা কার্যত এড়িয়ে যাওয়া যায়।
সরকার ১২ ঘণ্টারও কম সময়ে নোটিস দিয়ে আচমকাই এই দু'টি বিল সংসদে তোলে। বিরোধীদের জোরালো দাবি সত্ত্বেও সরকার বিল দু’টিকে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠাতে রাজি হয়নি। ফলে ভারতের গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা কর্মসূচির মূল কাঠামো বদলে দেওয়া এবং দেশের পরমাণু দায়বদ্ধতার নিয়মে বড় পরিবর্তন আনার মতো গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলি নিয়ে কোনো বিস্তারিত আলোচনা বা খতিয়ে দেখা ছাড়াই পাশ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
কেন ‘শান্তি বিল’ নিয়ে লোকসভায় উত্তেজনা?
মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (MNREGA)-এর জায়গায় আনা বিকশিত ভারত-জি রাম জি (VB-G RAM G) বিলটি প্রকল্পটির চরিত্রই বদলে দেয়। এতে কাজের অধিকার হিসেবে প্রকল্পটি না রেখে একে একটি ‘মিশন’-এ পরিণত করা হয়েছে। নতুন বিলে ফসল কাটার মরসুমে ৬০ দিনের একটি বিতর্কিত ‘কৃষি বিরতি’ রাখার কথা বলা হয়েছে, এর ফলে কৃষকদের দর কষাকষির ক্ষমতা কমে যেতে পারে, যা মূল্য দেওয়া হবে তাতেই সায় দিতে হবে। পাশাপাশি, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে খরচের অনুপাত ৬০:৪০ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত গরিব রাজ্যগুলি কর্মসংস্থানে জোর ধাক্কা খাবে। এছাড়া বিলের নাম থেকে মহাত্মা গান্ধীর নাম বাদ দিয়ে ‘রাম’ (RAM) সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করায় সংসদে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়, এবং ক্ষুব্ধ সাংসদরা বিলের কপি ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানান।
বিরোধী সাংসদদের অভিযোগ, বিলের হিন্দি সংক্ষিপ্ত রূপে ‘রাম’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে সচেতনভাবে, যাতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ কল্যাণমূলক প্রকল্পকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়া যায়। তবে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান এই অভিযোগ খারিজ করে বলেন, ২০০৫ সালের মূল আইনে মহাত্মা গান্ধীর নাম ছিল না; তা ২০০৯ সালে পরে যুক্ত করা হয়।
অন্যদিকে, শান্তি বিলটি ১৯৬২ সালের পারমাণবিক শক্তি আইন সংশোধন করে বেসরকারি খাতকে এই ক্ষেত্রে ঢোকার সুযোগ দেয়। সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হলো, ১৯৮৪ সালের ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার পর চালু হওয়া ‘সরবরাহকারীর দায়বদ্ধতা’ সংক্রান্ত ধারাকে দুর্বল করা। সমালোচকদের মতে, এটি এক ধরনের ‘তেজস্ক্রিয় ঝুঁকি’, যেখানে লাভ বেসরকারি সংস্থার হাতে যায় আর ঝুঁকি চাপানো হয় সাধারণ মানুষের উপর। অনেকের দাবি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমি দেশগুলির চাপেই এই বিল আনা হয়েছে। এই বিলে বেসরকারি অপারেটরদের তথ্য জানার অধিকার আইন (RTI)-এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে, ফলে পারমাণবিক নিরাপত্তা নিয়ে স্বচ্ছতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শান্তি বিলের সবচেয়ে বিতর্কিত দিকটি হলো, ২০১০ সালের সিভিল লাইয়াবিলিটি ফর নিউক্লিয়ার ড্যামেজ (CLND) আইনে পরিবর্তন। এই আইনটি দীর্ঘ বিতর্কের পর পাশ হয়েছিল এবং এতে একটি কঠোর ‘সরবরাহকারীর দায়’ ধারা (ধারা ১৭(খ)) ছিল। এই ধারার ফলে ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে অপারেটর সরবরাহকারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারত। এটি ছিল ভোপাল গ্যাস বিপর্যয় থেকে নেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
বিদেশি সংস্থাগুলিকে আকৃষ্ট করতে শান্তি বিল কার্যত এই ‘প্রতিকারের অধিকার’ বা রাইট অব রিকোর্স (right of recourse) তুলে দেয়, অথবা খুব দুর্বল করে দেয়। দায়বদ্ধতার ঝুঁকির কারণে ওয়েস্টিংহাউস (Westinghouse) বা ইলেক্ট্রিসিটি দ্য ফ্রান্সের (Electricite de France) মতো সংস্থাগুলি এতদিন ভারতীয় বাজারে আসতে রাজি ছিল না। নতুন আইনে কোনো পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে বিদেশি সরবরাহকারী দায়মুক্ত থেকে যাবে, আর ক্ষতিপূরণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার খরচ বহন করবেন ভারতীয় করদাতারা। এই ক্ষতিপূরণের সর্বোচ্চ সীমা ধরা হয়েছে মাত্র ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ কোটি টাকা, যা জাপানের ফুকুশিমা দুর্ঘটনার আনুমানিক ১৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতির তুলনায় খুবই সামান্য।
এই দু'টি আলোচিত বিল ছাড়াও, শীতকালীন অধিবেশনে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ হয়, যা সংসদীয় প্রক্রিয়াকে কীভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে তা স্পষ্ট করে। সংসদ পাশ করে 'সবকা বিমা সবকি রক্ষা' (বিমা আইন সংশোধন) বিল, ২০২৫, যার মাধ্যমে বিমা ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়। বিরোধী সাংসদরা দাবি করেছিলেন, এই বিলটি সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হোক, কারণ এতে ভারতীয় সঞ্চয়ের উপর বিদেশি পুঁজির দখল বাড়তে পারে। কিন্তু সেই দাবি নাকচ করে দিয়ে বিলটি পাশ করানো হয়। এর ফলে সংসদীয় পর্যালোচনা ছাড়াই আর্থিক উদারীকরণের ধারা বজায় থাকে।
আরও পড়ুন
কেন শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনেই অচল লোকসভা?
লোকসভায় আরও পাশ করানো হয় অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন (নং ৪) বিল, ২০২৫ এবং অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন (নং ৫) বিল, ২০২৫, যার মাধ্যমে বিপুল সরকারি ব্যয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। পুরো শীতকালীন অধিবেশন শেষ হয়ে যায় দিল্লির বিপজ্জনক মাত্রার বায়ুদূষণ নিয়ে কোনো আলোচনা ছাড়াই।
গণতন্ত্র টিকে থাকার জন্য নেতাদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জরুরি। তবে শীতকালীন অধিবেশনটি চিহ্নিত হয় দেশের দুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতার দায়িত্ব এড়ানোর মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের বাইরে ছিলেন, যখন সংসদে মনরেগা বাতিল নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এই প্রকল্পকে তিনি ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে লোকসভায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের ব্যর্থতার প্রতীক (asafalta ka pratik) হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। পরে মোদি সরকার এই প্রকল্পে আরও অর্থ বরাদ্দ করে, এবং ২০২০ সালের মার্চে করোনা লকডাউনের সময় গ্রামে দারিদ্র্য কমাতে এর গুরুত্ব স্পষ্ট হয়।
প্রসঙ্গত, যদি প্রধানমন্ত্রী অনুপস্থিত থাকাটা পরিকল্পিতও হয়, তবে বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর অনুপস্থিতিও ছিল একটি বড় ভুল। তিনি তখন জার্মানির একটি গাড়ি কারখানা পরিদর্শন করছিলেন এবং পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় (X) বিলটিকে 'গ্রামবিরোধী' বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি শারীরিক ভাবে অনুপস্থিতি থাকায় শাসক দলের সাংসদরা আরও সুবিধা পান। কারণ, রাহুল গান্ধীর সাংসদরা লোকসভার ওই পরিস্থিতি ঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারছিলেন না, এতে বিরোধী দল আরও দুর্বল হয়ে যায়।
এটি ছিল একটি অদ্ভুত দৃশ্য— 'গণতন্ত্রের মন্দিরে' দেশের দুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ আইন বাতিল হয় এবং নতুন আইন পাশ হয়। 'বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র'-এর সংসদ এখন আর স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেন্দ্র নয়; বরং এটি রাজনীতির একটি সেকেন্ডারি মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
লেখক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা এবং আয়ূষ যোশী স্বাধীন সাংবাদিক
(মূল প্রতিবেদনটি প্রাথমিক ভাবে নিউজ ক্লিক-এ প্রকাশিত হয়েছিল।)

Whatsapp
