ধূপগুড়ির আকাশে রহস্যময় উল্কাপিণ্ড! কীভাবে তৈরি হয় মহাজাগতিক আলো?
Mysterious Fireball Over North Bengal: সাধারণত, মহাজাগতিক কোনো ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্টাংশ যখন পৃথিবীর পৃষ্ঠে বা অন্য গ্রহে পৌঁছায় তাকে উল্কাপিণ্ড বলা হয়।
১৮ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি এলাকার কয়েকজন মহাকাশ প্রেমী ভাই জানালো, গাধিয়ার কুটি (অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ যথাক্রমে 26.64° N ও 88.91° E ) নামক জায়গায় সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ, ধূমকেতুর উল্টানো লেজের মতো উজ্জ্বল আলো দেখতে পাওয়া গিয়েছে, সেই সঙ্গে বিকট শব্দও শুনতে পায় তাঁরা। প্রথমে অতটা আমল না দিলেও পরে তাঁদের পাঠানো ছবি ও ভিডিও দেখে অনুমান করতে পারি যে বেচারিদের দাবি অমূলক নয়।
এমনিতেই গত কয়েক মাস ধরে মহাকাশ প্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল 3I/ ATLAS নামের আন্তনাক্ষত্রিক ধূমকেতু (যদিও এটি ধূমকেতু কিনা সে বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে সংশয় রয়েছে); এদিকে নাসা জানিয়েছে, ১৯ ডিসেম্বর পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে (আনুমানিক ২৭০ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে) অবস্থান করবে এই মহাজাগতিক বস্তুটি; সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসার আগেই, পূর্ব থেকে উত্তর-পূর্ব দিগন্তে দেখা মিলতে পারে সেটির। কী এই 3I/ATLAS?

ধূপগুড়ির গাধিয়ার কুটি এলাকায় দেখা মিলল ধূমকেতুর উল্টানো লেজের মতো উজ্জ্বল আলো
এটি সাধারণত কঠিন বরফ (জল, কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদি) এবং ধুলো ও পাথরের সমন্বয়ে গঠিত এক মহাজাগতিক বস্তু, যার কেন্দ্রে থাকে ০.৬ থেকে ৫.৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত একটি নিউক্লিয়াস, যাকে কেন্দ্র করে গ্যাস ও ধুলোর মেঘ প্রতিনিয়ত আবর্তিত হচ্ছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ল্যারি ডেননিউ ২০২৫ সালের ১ জুলাই রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এই মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধান পান।
আরও পড়ুন
১১ বছর ধরে মহাকাশ স্ক্যান করে মানচিত্র! গায়া যেভাবে বদলে দিচ্ছে বিজ্ঞানীদের ধারণাও
এসবের মাঝে উত্তরবঙ্গের আকাশে হঠাৎ অগ্নিপিণ্ডের দেখা মেলায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সাধারণত এত কম উচ্চতায় উল্কার মতো মহাজাগতিক বস্তুর উপস্থিতির সম্ভাবনা প্রবল। অবশ্য কৃত্রিম উপগ্রহের ধ্বংসাবশেষ থেকে নির্গত টুকরোও এর জন্য দায়ী হতে পারে, তবে সে সম্ভাবনা এক্ষেত্রে ক্ষীণ বলেই ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। সাধারণত, মহাজাগতিক কোনো ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্টাংশ যখন পৃথিবীর পৃষ্ঠে বা অন্য গ্রহে পৌঁছায় তাকে উল্কাপিণ্ড বলা হয়। এগুলোর ভর খুব বেশি না হলেও গতিবেগ মারাত্মক (সেকেন্ডে প্রায় ১১ থেকে ৭২ কিলোমিটার) বেশি হওয়ার কারণে বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় জ্বলে ওঠে। আমরা জানি, মহাশূন্যে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই, সেজন্য এরা বাধাহীন ভাবে ঘুরতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় তীব্র ঘর্ষণের মুখোমুখি হয়। বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন এই ঘর্ষণের ফলে উল্কাপিণ্ডের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা পৌঁছায় প্রায় ৩,০০০° ফারেনহাইট (যা পৃষ্ঠের স্ফুটনাঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি) এবং উল্কাপিণ্ডটি স্তরে স্তরে বাস্পীভূত হতে শুরু করে।
আবার এই ঘর্ষণের কারণে উল্কাপিণ্ডের উপাদান এবং বায়ুমণ্ডলের অণুগুলি ভেঙে আয়নে পরিণত হয়, যাদের পুনরমিলনে তৈরি হয় একটি উজ্জ্বল উল্টানো লেজ, যেমনটি গতকাল ধুপগুড়িতে দেখা গিয়েছে। ধুমকেতু বা উল্কা বা কোনো মহাজাগতিক বস্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলে এরকম উল্টানো লেজ দেখা যায় কেন?

ধূপগুড়িতে মহাজাগতিক আলো
আমরা জানি, সূর্য থেকে প্রতি মুহূর্তে অজস্র আহিত কণা তীব্র বেগে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, যাদের ধাক্কায় মহাজাগতিক বস্তুটিকে ঘিরে থাকা ধোঁয়া ও ধুলোর আস্তরণ সরে উল্টো দিকে চলে যায়। দেখলে মনে হবে যেন উল্টানো ঝাঁটা, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন ‘আন্টি টেইল’।
আরও পড়ুন
মহাকাশে কীসের হৃদস্পন্দন? কোন রহস্যের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা?
ধূমকেতুর ক্ষেত্রে তো আনেক সময় দু'টি লেজ দেখা যায়– একটি ধুলোর লেজ (dust tail) আর একটি আয়ন লেজ বা গ্যাসীয় লেজ (Ion Tail or Gas Tail)। সূর্যের বিকিরণের ঠেলায় ধূমকেতুকে ঘিরে থাকা বাষ্পরাশি ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নে ভেঙে যায়। অপরদিকে, সূর্যের বিকিরণেও আহিত কণা থাকে। এদের মধ্যেকার আকর্ষণ ও বিকর্ষণের জন্য অনেক দু-দুটো লেজ দেখতে পাওয়া যায়। আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, ঘর্ষণের কারণে, একটি গমের মতো আকারের উল্কাপিণ্ডের লেজ কয়েক ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। যে মহাজাগতিক ধ্বংসাবশেষের জন্য উল্কাপিণ্ডের জন্ম হয়, তার বেগ আরও বেশি হলে এই লেজ কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে।
আমাদের মনে হতে পারে, পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছানোর জন্য একটি উল্কাপিণ্ডকে ঠিক কত বড় হতে হবে? বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন, একটি ফুটবলের সাইজের উল্কাপিণ্ড বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষমেষ পৃথিবী পৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে; আর কোনোভাবে এর আকার যদি ২৫ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট মাঠের চেয়ে বড় হয়, তাহলে পৃথিবী পৃষ্ঠে সাংঘাতিক ক্ষতের সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। যদিও সচরাচর সেরকম উল্কার দেখা মেলে না। সাধারণত, অধিকাংশ উল্কাপিণ্ড আকারে ছোট হওয়ায় বায়ুমণ্ডলের মেসোস্ফিয়ারেই (৮০ কিলোমিটারের মধ্যে) জ্বলে শেষ হয়ে যায়। আকারে একটু বড় হলে (ওই মার্বেলের মতো), বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে ধেয়ে আসা উল্কাপিণ্ডকে আমরা আমাদের দৃশ্যমান পরিমণ্ডলে দেখতে পাই— যেমন গতকাল এই রকম এক অপার্থিব আলোর দর্শন মিলেছিল জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ির আকাশে।

Whatsapp
