৩ দিন ধরে পচেছিল দেহ, লাশ নিতে আসেননি কেউ! ঠিক কী ঘটেছিল পারভীন বাবির সঙ্গে?

Parveen Babi death mystery: পারভীনের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মীয়স্বজনরা কেউ মৃত নায়িকার লাশ নিতে হাসপাতালে অবধি যাননি। শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করেছিলেন মহেশ ভাট।

জুহুর সাত তলায় ফ্ল্যাট। মুম্বইয়ের শীতে শহর জাগছে তখন। তার আগে দিন তিনেক ধরে অত্যন্ত বেশিই শীতল হয়ে আছে এই সাততলার ফ্ল্যাট। মৃত্যুর শীতলতা। বাইরে থেকে টের পাওয়ার জো নেই, অথচ ভেতরে সব কিছু থেমে গেছে, দেওয়াল ঘড়ির শব্দ ছাড়া। বাড়িটির বাসিন্দা প্রাক্তন নায়িকা। মুম্বইয়ের তাবড় তাবড় সিনেমায় অভিনয় করে সাড়া ফেলেছিলেন, পর্দায় তাঁর উপস্থিতি, তাঁর চাহনি, তাঁর লাস্য, মৃদু হাসি ভারতবর্ষের সিনেপ্রেমীদের হৃদয়ে অকালে জোয়ার ডাকত। তিনি শুয়ে আছেন সাততলার ফ্ল্যাটে, যে দেহের সৌন্দর্যে, পেলবতায় বলিউড কাঁপত, পচন ধরেছে তাতে। বাইরে মুম্বই ব্যস্ত, ভেতরে চলে গিয়েছেন ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশকের সাড়া জাগানো অভিনেত্রী পারভীন বাবি। অমিতাভ বচ্চন, শশী কাপুর এবং বিনোদ খান্না সহ তাঁর সময়ের শীর্ষ অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন পারভীন। জওয়ানি জানেমন হাসিন দিলরুবা, জানু মেরি জান এবং রাত বাকি বাত বাকির মতো চিরসবুজ গানগুলিতে পারভীনের উপস্থিতি ছিল ঘাসের উপর শিশির বিন্দুর মতোই উজ্জ্বল, অধরা। অথচ, পচে গলে মরে গেলেন নায়িকা। সাল ২০০৫, দিনটা ২০ জানুয়ারি।

পর্দায়, পার্টিতে যত ভিড়, জীবনে ততটাই একা হয়ে গিয়েছিলেন পারভীন। বয়স যত বেড়েছে ব্রাত্য হয়েছেন। জীবনের শেষ কয়েক বছরে বলিউড তাঁকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। ২০ জানুয়ারি, ২০০৫-এ তাঁর মৃত্যুর সময় একাই ছিলেন তিনি। যে জগতে এককালে রাজকন্যা ছিলেন তিনি, সেখানে দুয়োরানির চেয়েও নির্দয় দশা হয়েছিল পারভীনের। মুম্বইয়ের জুহুতে ওই সাততলার ফ্ল্যাটে পারভীনের লাশ যখন পাওয়া যায় ততক্ষণে ৭২ ঘণ্টা কেটে গেছে। শরীর পচতে শুরু করেছে, দুর্গন্ধ বেরোতে শুরু করেছে পারভীনের বাড়ি থেকে। তিন দিন ধরে অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে খবরের কাগজ এবং দুধের প্যাকেট জমছে তো জমছেই। এমনিতে কেউ কারও খোঁজ রাখেন না ফ্ল্যাটবাড়িতে। যদি না দুর্গন্ধ, শব্দ, চিৎকার এসে ইন্দ্রিয়কে বিরক্ত করে। প্রতিবেশীরা পারভীনের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর থেকে দুর্গন্ধ পেতে শুরু করেছিলেন। পরে, পুলিশকে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হয়। দেখা যায়, বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন পারভীন। খাটের পাশে রাখে একটি হুইলচেয়ার।

দীর্ঘদিন আগেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিলেন পারভীন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকত না তাঁর, দীর্ঘকাল ধরে নিজেকে একা করেছিলেন নিজেই। তার চেয়েও বড় সত্য, পারভীনের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি কেউ। সুস্থ আছেন কিনা খোঁজখবরও নেননি কেউ। একজন নায়িকা, বিগতযৌবনা অভিনেত্রী- আছেন, অথচ নেই! অস্তিত্বই নেই কোথাও, তবু শরীরটুকু রয়েছে। পুলিশ মরদেহ কাটাছেঁড়া করে জানিয়েছিল, পারভীন মারা যাওয়ার আগে তিন থেকে চার দিন না খেয়ে ছিলেন। প্রচণ্ড পরিমাণে ডায়াবেটিক ছিলেন পারভীন, এতটাই যে পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। শেষ দিনগুলিতে হুইলচেয়ার ব্যবহার না করে নড়াচড়া করতে পারতেন না পারভীন। তবে মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন বলাও যায়নি ঠিক। কারণ পারভীনের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মীয়স্বজনরা কেউ মৃত নায়িকার লাশ নিতে হাসপাতালে অবধি যাননি। শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করেছিলেন মহেশ ভাট।

আরও পড়ুন- জনপ্রিয় গানের সুর নকল করেই বাজিমাত? কোন জাদুতে ৫০ বছরেও অমলিন ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে’!

দীর্ঘদিন আগে পারভীনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন মহেশ ও পারভীন। শুধু মহেশ নন, কবির বেদি, ড্যানি ডেনজংপার সঙ্গেও তাঁর প্রেম সেই সময়ে খবরের শিরোনাম ছিল। এত ভিড় যার জীবনে, সেও পারভীনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় লোক গোনার জন্য আঙুলের করগোনাও ছিল বাহুল্য। খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন অভিনেত্রী। চেয়েছিলেন খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ীই তাঁকে সমাহিত করা হোক, কিন্তু তাও জোটেনি। দেহ নিতে না এলেও, মুসলিম আত্মীয়রা ইসলামের ঐতিহ্য মেনেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন।

সুন্দর চেহারা, নম্রতা এবং যৌন আবেদন পারভীন বাবির ওড়ার জন্য এক আকাশ বন্দোবস্ত করে রেখেছিল। অথচ শেষের দিনগুলিতে একাকীত্ব এবং স্কিজোফ্রেনিয়া বদলে দেয় পারভীনের দুনিয়া। সত্তরের দশকে নতুন যুগের নায়িকা হয়ে মাঠে নামেন পারভীন! যশ চোপড়া তাঁর দিওয়ার সিনেমাতে পারভীনকে নিয়ে এলেন একজন স্বাধীন কর্মজীবী মেয়ের ভূমিকায়। সে মেয়ে সিগারেট খায়, মদ্যপান করে, প্রেমিকের সঙ্গে যৌনতায় সহজেই লিপ্ত হয়- হিন্দি ছবির 'স্টিরিওটাইপ' নায়িকার সমস্ত দেওয়াল ভেঙে পারভীন এলেন স্বতন্ত্র, স্বাধীন হয়ে। অথচ এই একই সময়ে, জে ওম প্রকাশের অর্পণ সিনেমায় জিতেন্দ্রের বিপরীতে শাড়ি পরা শান্ত মেয়েটির চরিত্রেও কী সাবলীল পারভীন। ১৯৭৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ তারকা হয়ে ওঠেন পারভীন।

হঠাৎ করেই এই আকাশছোঁয়া উড়ান নিচে নামতে শুরু করে। পারভীনের তৎকালীন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মতে, পারভীন অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। অনুভূতি প্রকাশ করতে পারতেন না পারভীন। ধীরে ধীরে ইঁদুর দৌড় থেকে এমনভাবে নিজেকে সরালেন পারভীন যে কেউ তাঁর খোঁজ পেল না। এও কি সম্ভব? একজন খ্যাতিমান নায়িকার কেউ খোঁজ পেল না? বলিউডের অন্দর বলে, একজন বিশেষ অভিনেতার সঙ্গে তাঁর চূড়ান্ত সম্পর্ক পারভীনের আত্মবিশ্বাসকে শেষ করে দিয়েছিল।

১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে, মহেশ ভাটের সঙ্গে পারভীন বাবির সম্পর্ক ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৮২ সালে, মহেশ ভাট পারভীন বাবির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে একটি চাঞ্চল্যকর চলচ্চিত্র তৈরি করেন, অর্থ। স্মিতা পাটিল পারভীন বাবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই সিনেমাটি পারভীনের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেন পারভীন, যদিও শেষ করেননি। পারভীন বাবিকে গ্রাস করে নিরাপত্তাহীনতা এবং প্যারানয়িয়া। অমিতাভ বচ্চনকে সুযোগ পেলেই আক্রমণ করতেন পারভীন। সন্ত্রাসবাদীদের গুপ্তচর হওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের অপরাধ এবং অপকর্মের অভিযোগ এনেছিলেন পারভীন বচ্চনের বিরুদ্ধে। ক্রমশ পারভীনের আক্রমণগুলি ভয়ঙ্কর এবং অযৌক্তিক হয়ে গেলেও বিষয়টি পাত্তা দেননি অমিতাভ। পারভীনের সমস্যা এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় যে শেখর সুমনের সঙ্গে তাঁর জীবনের এক শেষ সাক্ষাত্কার তিনি দেন নিজের বাড়িতেই। কারণ পারভীন মনে করতেন বাইরে বেরোলেই তাঁকে খুন করে ফেলা হবে। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে, যখনই সাংবাদিকরা সাক্ষাত্কার নিতে আসতেন প্রায়ই তাঁদের খাবার খেতে এবং নিজের জলটিই খেতে দিতেন, যাতে তিনি নিশ্চিত হতে পারেন যে তাঁর খাবারে বিষ নেই। পারভীনের অসুস্থতা এমন পর্যায়ে যায় যে তিনি মনে করতেন তাঁর মেকআপেও বিষ মেশানো যাছে, মুখে লাগালেই চামড়া উঠে যাবে।

আরও পড়ুন- সনিয়ার কন্যাদান করেন হরিবংশ রাই বচ্চন! কীভাবে নষ্ট হল অমিতাভ-রাজীব গান্ধীর বন্ধুত্ব?

অভিনেতা ড্যানি ডেনজংপা একটি সাক্ষাত্কারে পারভীন বাবির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়ে জানিয়েছিলেন, “ও আমার প্রথম বান্ধবী ছিল। যেভাবে ও শেষ হয়ে গেল তা খুবই দুঃখজনক। বিয়ের আগে পর্যন্ত ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। ও অসুস্থ হওয়ার পর আমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা একই বিল্ডিংয়ে থাকতাম। ও ছিল চারতলায় আর আমি এক তলায়। পরে পারভীন মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়ে। মহেশ ভাটের সঙ্গে ডেট করার সময় খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ও। মহেশ আমাকে ওর অবস্থা জানায়, তখনই আমি ওকে দেখতে যাই। তখনই জানতে পারি ও ভয় পেয়ে আছে, ও প্যারানয়েড।"

কী করে বুঝলেন ড্যানি যে পারভীন অসুস্থ? অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল ড্যানির, পারভীন সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন যে ড্যানি অমিতাভের এজেন্ট। অমিতাভের ও ড্যানির বিরুদ্ধে পুলিশে এবং অন্যান্য বিভাগে অভিযোগ জানাতে থাকেন পারভীন। মনে মনে কেন এত শত্রুপক্ষ গড়ে উঠেছিল পারভীনের? কেনই বা অমিতাভের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ। কেন কেবলই একা করে নিলেন নিজেকে। মহেশ ভাটের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা কী এমন বাঁকে গেল যার জেরে নিজেকে এতখানি হারিয়ে ফেললেন পারভীন? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যিনি জানতেন, তিনি নেই। মৃত্যুর তিন দিন পর দুর্গন্ধযুক্ত লাশ হয়ে বেরিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। ফেরেননি। বলিউডের রহস্য কবরে শুয়ে আছে মাটি হয়ে।

More Articles