বক্সিং রিং-এ রবীন্দ্রনাথ আমার স্পারিং পার্টনার…
Rabindranath Tagore: ক্ষুদিরামকে নিয়ে তিনি জীবনে কোনওদিন কিচ্ছু লিখলেন না, একেবারে পছন্দ করতেন না কিন্তু সমালোচনা করেছেন!
রূপক: আশীষদা, আপনাকে কোট করছি, আপনি বলেছেন, “…আমি জীবনে যা কিছুই করেছি তার মূলে তিনটে ফ্যাক্টর কাজ করেছে; প্রথম হল রবীন্দ্রনাথের গান, তা থেকেই সমস্ত কিছুর সূত্রপাত।" এরপর ছোটবেলায় মেঝেতে শুয়ে কত টাকার চাকরি হলে বাকি জীবনটা খেয়ে পড়ে রবীন্দ্রনাথে ইম্মার্সড হয়ে থাকা যায় সে হিসাব করার গল্পও বলেছেন। তাহলে কি আপনাকে আমি এক্কেবারে লিটরাল সেন্সে “ওয়ান অ্যামাং দ্য মেনি রাবীন্দ্রিক্স” বলে ধরে নেব? (হাসি)
আশীষ: তা বলতে পারব না, তবে স্বীকার করছি যে রবীন্দ্রসঙ্গীত একটা সময়ে এত বেশি ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল যে আধুনিক বাংলা গান, বা অন্যান্য গান বাজনার ভালোমন্দকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্ট্যান্ডার্ডে বিচার করতাম। কাজেই বাংলা বা হিন্দি সিনেমা, বা সাধারণভাবে লোকজনের যে কালচারাল অ্যাটিটিউড সেটা খুব অল্প বয়স থেকেই আমার সঙ্গে বিশেষ মিলতো না। আমি হয়তো সকলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতাম, আড্ডা দিতাম, কিন্তু ডেলিবারেটলি হিন্দি সিনেমা দেখতে যেতাম না এবং ওই ডেলিবারেটলি না যাওয়াটাকে আমি কালচারের প্রমাণই মনে করতাম। কাজেই এইদিক থেকে সেই সময়ে হয়তো 'রাবীন্দ্রিক' বলা যেতে পারত। কারণ তখন আমি নিজেকে এক্সক্লুসিভলি একটাই কালচারে সীমাবদ্ধ রাখছিলাম এবং সেই কালচারের মধ্যমণি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যেমন বললাম, এই উন্নাসিকতা ব্যাপারটা তখন ওই কালচারাল এক্সক্লুজিভিটিরই অংশ ছিল, আর কিছু নয়। কারণ আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারে তেমন এস্থেটিক্যাল রাবীন্দ্রিকতা সম্ভবই নয়। আমি যেখানে থাকতাম, অর্থাৎ ওই কিনু গোয়ালার গলির মতন জায়গাটায়, সেখানে তিন তলার উপর থেকে প্যাকেটে করে বাচ্চাদের বিষ্ঠা রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হত, আর সেটা 'থ্যাপ' করে বাড়ির সামনে এসে পড়ত! কাজেই এইরকম একটা আবহাওয়ায় সেইরকম রাবীন্দ্রিক হওয়া যে সম্ভব নয় তা তো বুঝতেই পারছো! আমার অ্যাটেম্পটটা ছিল রবীন্দ্রনাথকে মধ্যমণি করে এসব, অর্থাৎ যে জিনিসগুলো ওই আবহাওয়ার আমার ভালো লাগতো না তাদের থেকে একটা এক্সক্লুসিভ কালচারাল এস্কেপ রুট বা ডোমেইন তৈরি করার! এই অর্থে আমাকে তুমি রাবীন্দ্রিক বলতেই পারো। (হাসি)
রূপক: রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হিন্দি সিনেমার বিরোধটা কোথায়?
আশীষ: হিন্দি সিনেমাকে একটা উদাহরণ হিসাবে ধরে আমি ইন জেনারেল ক্র্যাস এন্টারটেনমেন্টের কথা বোঝাতে চাইছি। তবে “হিন্দি সিনেমা একটা স্থূল জিনিস” ধারণাটা প্রায় সমস্ত মধ্যবিত্ত বাড়ির মতো আমাদের বাড়িতেও ছিল কিন্তু সেই চিন্তার বিরুদ্ধে গিয়েও তো সবাই দেখত! আমি সত্যি সত্যিই স্কুল লাইফে একটাও হিন্দি সিনেমা দেখিনি, কলেজ লাইফে হার্ডলি একটা কী দুটো দেখেছি। এই ক্র্যাস এন্টারটেইনমেন্টের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ হয় ১৯৭২ সালে, বরোদায় চাকরি করতে গিয়ে, তখন আমার ২৪ বছর বয়স। গোটা দেশ থেকে আমরা ৪২ জন গিয়েছিলাম। সেখানে আর কোথায় রবীন্দ্রনাথ, আর কোথায় আমার অটো টিউন্ড, সেল্ফ ইম্পোজড রিফাইন্ড কালচারাল টেস্ট! (হাসি)
রূপক: হ্যাঁ আপনি বলেছিলেন আগে।
আশীষ: এই সময়ে দুটো জিনিস আমি উপলব্ধি করি। প্রথমত, এই অতিরিক্ত রবীন্দ্রনিমগ্ন হয়ে থাকার ফলে সত্যিই বাইরের জগতের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ ঘটেনি। কিন্তু তাতে আমার কিছু সুবিধেও হয়েছিল। আমি দেখেছিলাম দেশের অন্যদের তুলনায় ফাইন কালচারাল দিকগুলোর সঙ্গে আমি অনায়াসে কানেক্ট করতে পারতাম।
রূপক: যেমন?
আশীষ: ক্লাসিকাল মিউজিক একটা উদাহরণ। বরোদার দিকে এসবের প্রচলন ছিল। তা ওখানকার গাইয়ে-বাজিয়েদের যে সমস্ত কথায় আমার বন্ধুদের চোখ ছানাবড়া হওয়ার যোগাড়, আমি দিব্যি সেসব বুঝতে পারতাম। আমার এক বন্ধু ছিল, সতীশ সামন্ত। তাঁকে আমি বললাম, "তোমাদের মহারাষ্ট্রে তো ক্লাসিকাল গানবাজনার ভালোই প্রচলন আছে?’’ সে বলল, "হ্যাঁ, একটু আধটু আমরা সবাই শুনিয়ে দিতে পারি।" এই কথা বলে, একেবারে টেবিল বাজিয়ে সে চৌতালে ধ্রূপদ গেয়ে দিল। কোনও প্রিপারেশান ছাড়া! এটা আমি যেভাবে, যে লেভেল থেকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পেরেছিলাম, অন্যরা কিন্তু পারেনি। তখন আমার মনে হয়েছিল যে, আমার তথাকথিত রাবীন্দ্রিকতা আমাকে হেল্প করেছিল। অথচ, আমার চাকরিক্ষেত্রের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, যেখানে একটু স্থূল হলেই সুবিধা, সেখানে কিন্তু আমার কমিউনিকেট করতে অসুবিধা হয়নি। কাজেই ইট গেভ মি সাম অ্যাডভান্টেজ!
রূপক: বেশ তাহলে সমস্যাটা বাঁধলো কখন?
আশীষ: পলিটিকালি! আমাদের চারপাশটা যখন একটা সাংঘাতিক বয়েলিং স্টেজে চলে গেল, আমি দেখলাম আমার রাবীন্দ্রিকতা নিয়ে আমি আর আমার নিজের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেই কমিউনিকেট করতে পারছি না! আমি আমারই বন্ধুদের সঙ্গে রিলেট করতে পারছি না। যে রাবীন্দ্রিক গোল-গোল মানবতাবাদে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলাম এবং নিজেকে খুব সুপিরিয়ার ভাবছিলাম, আমি দেখলাম সেটা আমার ক্ষতি করছে! চারিদিকে যখন একটা পলিটিকাল, একটা সামাজিক টারময়েল, যে সময়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথই আমায় সামাজিক কন্ট্রিবিউশানে উদবুদ্ধ করেছেন কিন্তু আমি তাঁকেই মেলাতে পারছি না, এই ডাইকোটমিটা আমার খুবই পীড়া দিয়েছিল। সে কারণেই, যে কথাটা বইয়ে আমি লিখেওছি, একটা স্টেজে এসে আমার মনে হল রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করা দরকার। নাহলে সমসাময়িক বাইরের জগত, যেমন নকশালবাড়ির ঘটনা এবং তা নিয়ে ঘটে যাওয়া তুমুল রাজনৈতিক ঘটনাসমূহ, এর কোনওকিছুর সঙ্গেই আমি কমিউনিকেট করতে পারতাম না। ডেলিবারেটলি, আই স্টার্টেড হেটিং রবীন্দ্রনাথ! 'অচেনা মিত্র' ছদ্মনামে প্রকাশিত আমার প্রথম লেখাটা ঘোর রবীন্দ্রবিরোধী!
রূপক: হ্যাঁ আপনি বলেছেন।
আশীষ: আমি তাই বলি যে, বক্সিং ট্রেনিংয়ের রিং-এ রবীন্দ্রনাথ আমার স্পারিং পার্টনার! (হাসি) ওর সঙ্গে লড়তে লড়তে আমি বড় হয়েছি!
রূপক: আপনি 'সংস্কৃতির বাংলা বাজার' বইতে সত্যপ্রিয় ঘোষের কথা বলতে গিয়ে ওঁর রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিয়েও সমালোচনামূলক অ্যাপ্রোচের কথা বলেছেন। আপনার রবীন্দ্রনাথের প্রতি 'আনুগত্য' এবং তারপর তৈরি হওয়া 'বিরোধিতা', মাঝের কন্ট্রাডিকশানের পিছনে কি ওঁর কোনও অবদান আছে?
আশীষ: না না। সত্যদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় এর অনেক পরে। বছর পঁচিশেক বয়সে যখন আমি পলিটিকাল অ্যান্ড সোশ্যাল রিয়্যাকশানের রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, কন্ট্রাডিকশানটা তখন দানা বাঁধে। কিন্তু একটা স্টেজে, রাইট ফ্রম কার্ল মার্ক্স, ওই যে তুমি যেটা বললে, একজনকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করেও প্রচণ্ড আক্রমণ করা যায়, আমি সেই শিক্ষাটা গ্রহণ করেছিলাম। মার্ক্সের একটা কথা- 'মেন মেক হিস্ট্রি দেমসেলভস, বাট দে ডু সো আন্ডার গিভেন সারকামস্টান্সেস', যেটা আমি সম্পূর্ণভাবে অনেক পরে বুঝেছিলাম, আমায় রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে সাহায্য করেছিল। কে কোথায় জন্মাচ্ছে, বা কখন জন্মাচ্ছে, স্বাধীনতার আগে বা পরে, রায়টের আগে না পরে এসবের উপর রবীন্দ্রনাথ, মার্ক্স বা এই আমি, কারওই কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। নিজেকেই যদি উদাহরণ হিসাবে ধরি, যে উত্তর কলকাতার এঁদো কালু ঘোষ লেনে আমি জন্মেছিলাম সেখানে রাস্তায় গরুর দুধ দোয়ানো হত, সেখানেই বাচ্চার বিষ্ঠা রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হত, আবার সেখানেই গান ছিল, নাটক ছিল, লেখালেখি ছিল। এই ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে আমায় খুব সাহায্য করেছিল। জীবনে কোনওদিন তাঁকে খাওয়া-পরা নিয়ে ভাবতে হয়নি, সে নিজের বাবার উপর নির্ভরশীল! রবীন্দ্রনাথের সাস্টেনেন্স পুরোপুরিভাবে ওঁদের জমিদারির উপর নির্ভর করত। অথচ সেই জমিদারিকে আমি একটা খারাপ জিনিস বলে মনে করছি। রবীন্দ্রনাথ নিজেও করছেন। ওঁর কথাতেই আছে, পরশ্রমজীবি বলে নিজেকে আমার ঘৃণা হয়! সেটা জেনেশুনেই প্রচুর নোংরা কাজ, প্রচুর খারাপ কাজে যুক্ত হচ্ছেন এবং এই ডাইকোটমিটা তাঁর মধ্যে প্রচণ্ড একটা টারময়েল তৈরি করছে। এই ব্যাপারটাই তাঁর কবিতায়, গানে এবং নানা সৃষ্টিতে অদ্ভুতভাবে সাবলিমেটেড হচ্ছে। এখানেই তিনি জিনিয়াস! তখন মনে হল যে, আমি বোধহয় একটা লাইন পাচ্ছি যেখানে লোকটাকে আমি জিনিয়াস হিসাবে মানছি, লোকটার সৃষ্টি আমাকে মুগ্ধ করে রাখছে, আবার একই সময়ে লোকটার হীনতা, দুর্বলতাও আমি দেখতে পাচ্ছি! কাজেই মার্ক্সের ওই কথাটা আমাকে আজও অসম্ভব প্রভাবিত করে। ওয়ান কান্ট চুজ ওয়ান'স সার্কমস্টান্সেস! আর যদি তাই হয় তাহলে ওই সার্কামস্টান্সের নিজস্ব কন্ট্রাডিকশানগুলোর সঙ্গে লড়তে লড়তে সে নিজেকে তৈরি করছে! কথাটা আমার ক্ষেত্রেও সত্য, তোমার ক্ষেত্রেও সত্য, মার্ক্সের ক্ষেত্রেও সত্য, সাক্ষাৎ রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও সত্য!
এই সত্যটা আমার নিজের ডাইকোটমির ক্ষেত্রেও সমান কাজে লেগেছে। রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলায় আমার ভাবনাকে কমপ্লিটলি মোল্ড করেছিলেন, একথা এক্কেবারে ঠিক কিন্তু যখন রাজনীতির দিকে আমার ঝোঁক গেল…
রূপক: আপনি কি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন?
আশীষ: না, আমি মূলত তাত্ত্বিক দিকের কথাটাই বলছি। আমি কোনওদিনই খুব অ্যাক্টিভলি কিছু করিনি। সে সময়ে আমার বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই সরাসরি যুক্ত ছিল। তাদের বিভিন্ন কাজে আমি যুক্ত ছিলাম। অবৈধ ডকুমেন্ট কিছু অনুবাদ করা, এখানে-ওখানে পৌঁছে দেওয়া, এই ধরনের নানা কাজে আমার পার্টিসিপেশান ছিল। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে জেল হতে পারত, এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এর বেশি আমি কোনওদিনই কিছু করিনি।
কাজেই তেমন পরিস্থিতিতে আমার রবীন্দ্র-মোহের সঙ্গে এবং লেখালেখির সঙ্গে আমি কী করে রিকন্সাইল করব তা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল। আমায় খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে, আমার কোনও প্রপার্টি নেই, আমার বাবার কোনও সম্পত্তি নেই, আমার জমিদারি নেই, কাজেই আমায় একটা চাকরি করে খেতে হবে। সুতরাং, যদিও আমি নিজেই আমার কেরিয়ার বিসর্জন দিয়েছি, তথাপি আমায় মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরিটা নিতে হবে! আবার পেটের দায়ে চাকরি নিতে বাধ্য হলেও আমি মূলত লেখালেখিটাই করতে চাই। কাজেই আমি দেখলাম অনেকের মতো আমারও নিজের কাজের জগৎ আর আমি যা করতে চাই সেই আসল জগতের মধ্যে একটা বিরাট কন্ট্রাডিকশান আছে। আমাকে আমার চাকরির জন্য কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে। এমন অনেক কাজ করতে হয়েছে যা আমি একেবারেই মানতে পারিনি কিন্তু আমি ছাড়তে পারিনি। ১৯৭২ সালে, যখন আমি চাকরি নিই, আমি কবে ছাড়ব এই নিয়ে আমার বন্ধুদের মধ্যে একটা রসিকতা ছিল (হাসি)! আমার লক্ষ্য ছিল, আপাতত পেট চালিয়ে লেখালেখির জগতে একটা হিল্লে হলে আমি চাকরিটা ছেড়ে দেব। তেমন সুযোগ দু-তিনবার এসেওছিল!
রূপক: ছাড়লেন?
আশীষ: না, মিডলক্লাস পরিবারের যে কতগুলো সীমাবদ্ধতা থাকে তার কারণে আমি সে রিস্কটা নিতে পারিনি। এমনকী ৩০ বছর চাকরি করার পরে যখন আমি ছেড়ে দিচ্ছি, তখনও বেশ খানিকটা রিস্ক নিয়েই করেছিলাম। অতি সামান্য টাকা পাব জেনেও আমি ছাড়তে পেরেছিলাম কারণ ততদিনে আমার খানিকটা কনফিডেন্স এসে গেছে। তাছাড়া তখন আমার ডিকশনারির কাজটা আনন্দ পুরস্কার পেয়ে গেছে, বার্নাল অনুবাদ করায় কিছু টাকাও পেয়েছি, আরও নানান কারণে আমার খানিকটা নামও হয়েছে, কাজেই আমি খানিকটা রিস্ক নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু তার আগে আমি পারিনি।
কাজেই সেইখানে আমার রবীন্দ্রনাথের ক্রাইসিসটার কথা মনে হয়েছিল। ওঁর সাস্টেনেন্সটা যে অসৎ উপায় থেকে আসছিল সেটা তিনি নিজেও বলেছেন এবং বলা সত্ত্বেও সারা জীবন কম্প্রোমাইজ করে গেছেন। পাশাপাশি এই লেভেলের সৃজনশীলতার কাজ উপহার দিয়ে গেছেন। এই ব্যাপারটা আজও আমার কাছে একটা ফ্যাসিনেটিং কন্ট্রাডিকশান বলে মনে হয়। আমি সেটা নিয়ে এখনও একটা কাজ করছি। আমার এখন যা বয়স, তাতে নিজের সম্বন্ধে এবং রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধেও কতগুলো ডিসিশানে পৌঁছতে পেরেছি, তাই আমার নিজের ডাইকোটমির সঙ্গে আমি ওঁর সিচুয়েশানটাকেও খানিকটা মেলাতে পারি।
তা তুমি যে সত্যপ্রিয়দার কথা বললে, ওঁর সঙ্গে আমার অনেক পরে আলাপ। উনি অত্যন্ত গুণী মানুষ, শঙ্খ ঘোষের দাদা, রবীন্দ্রনাথকে দারুণ শ্রদ্ধা করতেন। ‘আমরা সকলে ওঁর সন্তান'- সত্যপ্রিয়দার মুখে আমি এই কথাও শুনেছি। সেই লোকই, আমায়, রবীন্দ্রনাথ যে ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ গানটা সত্যি সত্যি জর্জ দ্য ফিফথকে নিয়ে লিখেছিলেন সেটা অকাট্য যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। এ কথাটা যেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজে ক্যাটাগোরিকালি ডিনাই করেছেন, সত্যপ্রিয়দা বলতেন, "তুমি বিটুইন দ্য লাইনজ দেখো! ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে পড়লে বুঝবে শ্রদ্ধা বা ভক্তি না থাক গানটার মধ্যে পঞ্চম জর্জের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সম্মান প্রদর্শন আছে।" বলতেন, "বিটুইন দ্য লাইনজ পড়লে তুমি ওঁর কম্প্রোমাইজটা বুঝতে পারবে।" এই যে পড়াশোনার অ্যাপ্রোচটা, এইটা কিন্তু চিরদিনই আমার নিজেরও অ্যাপ্রোচ ছিল। তাই সত্যপ্রিয়দার মতো শিক্ষিত লোক বলাতে আমি খানিকটা জোর পেয়েছিলাম।
কাজেই আমার ডাইকোটমি, রবীন্দ্রনাথের ডাইকোটমি এবং মার্ক্স কোথাও মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল । বলতে পারো, উই অল বিলং টু সাম কাইন্ড অফ ফেটালিজম! (হাসি)
রূপক: বেশ, আপনার কথাটা আমি খানিকটা মানলাম। এই জায়গায় আমি আমার মূল তিনটে প্রশ্নের একটায় আসি। রবীন্দ্রনাথের ঘটনা, জালিয়ানওয়ালাবাগের কন্ট্রাডিকশান, মুসোলিনির সত্যি জানার পরও আবারও শুধুমাত্র বিশ্বভারতীর বরাতের জন্য হাত পাতা, এমনই আরও নানান উদাহরণ আপনি নিজে আপনার রবীন্দ্র-চর্চায় বারবার এনেছেন। তা সত্ত্বেও, পড়তে গিয়ে প্রত্যেকবারই আমার মনে হচ্ছে, শেষমেশ আপনি ওঁকে একটা এজ দিতে চাইছেন, ইউ আর অ্যাট দ্য এন্ড ডিফেন্ডিং হিম! কেন?
আশীষ: না, আমি এই কথাটাই বারবার বলতে চাইছি। আই অ্যাম নট ডিফেন্ডিং হিম। যে লোকটার কাজ, তার বিস্তার, যে লোকটা একাধারে এতটাই জিনিয়াস যে তিনি আনমিসেবল, তিনিই অন্যদিকে একের পর এক নিন্দনীয়, ধিক্কারের মতো সমস্ত ব্যাপার ঘটিয়ে চলেছেন, তার এই কন্ট্রাডিকশানটাকে আমি বোঝবার চেষ্টা করছি। আগে যখন আমরা সো-কলড এক্সট্রিমিস্ট ছিলাম, তখন আমরা ওঁর এই খারাপ কাজগুলোর জন্য ওঁকে একেবারে নেগেট করে দিতাম, বলতাম যে তিনি বর্জনীয়। আমি এখন সেই জায়গাটা থেকে বেরিয়ে এসেছি। এখন মনে হয়, সেই কাজগুলোর জন্য তাকে নিশ্চয়ই নিন্দা করা দরকার, অ্যাট দ্য সেম টাইম হি রিমেইন্স এ জিনিয়াস ফর হিজ ক্রিয়েশান!
প্রত্যেক বড় মানুষের জীবনেই এমন অনেক জিনিস থাকবে যেগুলো নিন্দনীয় এবং সেগুলোকে জনসমক্ষে নিন্দে করতে হবে। আবার একইসঙ্গে তাঁর জিনিয়াসকেও অ্যাপ্রিশিয়েট করতে হবে। তুমি ফ্রান্সিস বেকনের কথাই ভাবো না। তিনি চোর জোচ্চোর, কী নন, কিন্তু তাঁর কন্ট্রিবিউশান টু ফিলোজফি তো মাথায় করে রেখে দেওয়ার মতো! শেলির জীবন তো একটা ডিবাউচের জীবন। শেক্সপিয়ার? রবীন্দ্রনাথের জীবনে খারাপ কাজের লিস্ট বিশাল, এমনকী তপোব্রত ঘোষ এবং অন্যান্যদের লেখা থেকে এখনও আরও নতুন নতুন জিনিস জানা যাচ্ছে! কিন্তু সেজন্য কি আমরা তাঁকে ভিলেইন বলে দাগিয়ে দিতে পারি?
আমি এটাই বলতে চাইছি। আমি ওনাকে ডিফেন্ড করছি না। আচ্ছা তুমি বলো তো, একজন জিনিয়াস কীভাবে কাজ করে আমরা কি বুঝতে পারি?
রবীন্দ্রনাথের অনেক পূজার গান, এমনকী বিচিত্র পর্যায়েরও বহু গানের সাবস্টেন্স একটু খুঁটিয়ে পড়লে বুঝতে পারা যায় যে, তিনি এই কাণ্ডটা করেছেন। করে, মনের মধ্যে সেটাকে রিজলভ করতে পারছেন না, তাই সাবলিমেশানের পথ হিসাবে তাঁর ক্রিয়েটিভ সত্তাকে ব্যবহার করছেন। এর পরেরদিনই হয়তো আবার সেই খারাপ কাজটাই করছেন।
রূপক: কিন্তু শুধুমাত্র ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে কি এই কন্ট্রাডিকশানকে জাস্টিফাই করা যায়?
আশীষ: জাস্টিফাই নয়, এটাই ওঁর রিয়েলিটি। তার কারণ ওঁর নিজের কোনও রোজগার ছিল না। বাবার উপর ডিপেন্ডেন্ট! সারাজীবন তিনি ব্রাহ্মসমাজ-ব্রাহ্মসমাজ করলেন। শেষ জীবনে গিয়ে হেমন্তবালা দেবীকে লিখছেন, "আমার কোনওদিনই ওসবের সঙ্গে মনের মিল ছিল না।" জীবনস্মৃতিতেও লিখেছেন। তাহলে করেছেন কেন?
রূপক: আপনাকে এখানে একটু আটকাচ্ছি। পাড়ার অমুক দাদা, তমুক দিদি হলে তো এই এজটা তাঁকে দেওয়া হতো না! শুধুমাত্র জিনিয়াস বলে এই এজটা তিনি ডিজার্ভ করেন?
আশীষ: হ্যাঁ জিনিয়াস বলেই তাঁকে এই এজটা দেব। এই লেভেলের জিনিয়াস, যারা প্রতিক্ষেত্রে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে গেছেন, তাদের ক্ষেত্রে তো বটেই। তাছাড়া এখানে ওঁর নিজের সাফারিংসগুলো তোমায় মাথায় রাখতেই হবে।
আমার ছোটভাই, যে এখন আর নেই, খুব সুন্দর একটা হিসেব দিয়েছিল। ১৯০৫ সালে দেবেন ঠাকুর মারা যাচ্ছেন। যদি রবীন্দ্রনাথের গানের হিসেবটা করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, ১৯০৫-এর আগে ওঁর তেমন বিশেষ বর্ষার গান নেই। ভাই বলেছিল, তুই খুঁজলে খান দশেকের বেশি পাবি না। এবং সত্যিই তাই। যেগুলো আছে সেগুলো মূলত নাটকের গান। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পরেই ওঁর প্রকৃতির গান এবং মূলত বর্ষার গানের ফ্লাওয়ারিংটা হলো। অ্যান্ড দ্যাট মেড হিম! ঠিক একইভাবে, আমি যেটা বইয়ে দেখিয়েওছি, দেবেন্দ্রনাথের মারা যাওয়ায় ওঁর মাথার উপর থেকে যে জগদ্দল পাথরটা সরে যায় তাতে তিনি আধ্যাত্মিকভাবে এবং আর্থিকভাবে বিকেম মাচ মোর সেন! এই যে ওঁর কথার সঙ্গে কাজের বিস্তর গরমিল ছিল, এই ঘটনার পরে যত দিন গেছে হি ট্রায়েড টু কাম আউট অফ ইট! শেষদিন অবধিও অবশ্য পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেননি। এখানেই ওঁর ক্লাস রিয়েলিটিটা বেরিয়ে আসে। শান্তিনিকেতনের ক্ষেত্রেও ব্যপারটা খানিকটা তাই। ওঁর বাবার দেওয়া জমির উপর তিনি নিজের কতগুলো আইডিয়া ফ্লারিশ করাতে চেয়েছেন! এর বেশি কিছুই নয়। অজিত চক্রবর্তীকে একটা চিঠিতে তিনি লিখছেন, আমি প্যারাফ্রেজ করছি, "দেখো অজিত, তোমার বাড়িতে প্রচণ্ড অভাব আমি জানি, তোমার এত ভালো কেরিয়ার, তুমি ইচ্ছে করলেই বড় চাকরি পেতে পারতে, তোমার ভাই অসুস্থ, তুমি তো আমার আদর্শের জন্য জীবনে এত কিছু ছেড়েছো কিন্তু আমাকে তো কিছুই ছাড়তে হয়নি! আমার তো ঐশ্বর্যের জীবন। আমার জমিদারের জীবন আমি কিন্তু ছাড়িনি।" আমি বলতে চাইছি, রবীন্দ্রনাথের এই সচেতনতাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ডাইকোটমিকে ছাপিয়ে উঠছে তাঁর সৃজনশীলতা। সৃজনশীলতার জায়গায় আমি তাঁকে কুর্নিশ করতে বাধ্য।
রূপক: পরিষ্কার। এখানে দুটো কথা ওঠে। প্রথমত, আমাদের সময়ের 'ক্যান্সেল কালচার' কন্সেপ্টটাকে আপনি মানেন না, তাই তো?
আশীষ: ডিপেন্ড করছে! কোনও একজন সোশ্যাল বা পলিটিকাল লোক হলে তাঁর ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য, কারণ সেটাই তার কাজ কিন্তু যে লোকটা বেসিকালি একজন ক্রিয়েটিভ লোক, বেসিকালি একজন আর্টিস্ট, যে মানুষের মনকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করছে, তার ক্ষেত্রে তার শর্টকামিংসগুলোর আমি সমালোচনা করব কিন্তু রিজেক্ট করব না। সেটাই এই শাহজাহানের মতো পলিটিশিয়ান করলে আমি তাকে সরাসরি রিজেক্ট করব, চাইব সমাজ থেকে তাকে আইসোলেট করা হোক। বাট নট অ্যান আর্টিস্ট! বাট, অনলি ইফ হি ইজ অ্যান রিয়েল আর্টিস্ট! সিউডো নয়!
রূপকঃ তবে সিউডো কে?
আশীষঃ একজন তথাকথিত আর্টিস্ট যদি তাঁর আর্টকে কমার্শিয়াল প্রয়োজনে অসৎভাবে ব্যবহার করে তাহলে আমার কাছে সে সিউডো! আমার এ কথা বলতে কোনও দ্বিধা নেই। শুধু রবীন্দ্রনাথ তো নন, বড় বড় আর্টিস্টদের অনেকেরই, যেমন মঁপাসার জীবন, বা অন্যান্য অনেকের ব্যক্তিগত জীবন দেখলে তোমার ঘেন্না করবে। তাদের ক্রিয়েটিভিটিটুকু বাদ দিয়ে যদি তুমি দেখো, সত্যি সত্যিই তোমার ঘেন্না করবে। বাট নট হিজ আর্ট! এখানে কার্ল পপারের থ্রি ওয়ার্ল্ড থিয়োরিটা আমার মতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন একটা কাজের ভাবনা যখন আমার মনের মধ্যে নার্চার্ড হচ্ছে, যতদিন হচ্ছে সেটা আমার অঙ্গ। কিন্তু একবার সেটা বাইরে প্রকাশিত হয়ে বেরিয়ে গেলে, তা যে রূপে বা যে অবস্থাতেই বেরোক, সেটা তখন একটা অবজেক্টিভ ডোমেইনে চলে গেল। তখন সেই ক্রিয়েশানটা যার মাথা থেকে বেরিয়েছে সে আর ম্যাটার করে না। তার ব্যক্তিগত জীবনের একাধিক খারাপ কথা আমি জানলেও তাই দিয়ে বিচার করব না। একজন জোচ্চোর বা লম্পট যদি সত্যিকারের আর্ট করতে পারেন, ওয়াইল ক্রিটিসাইজিং হিম, আমি তাকে মাথায় করে রাখব। আমার মনে হয়, এছাড়া আর বাঁচবার পথ নেই। তুমি যে ক্যান্সেল কালচার বা টোটাল রিজেকশানের কথা বললে, ইট উড লিড আস নো হোয়্যার। সভ্যতাটাই থাকবে না।
রূপকঃ মানে বলতে চাইছেন, "যে লেখে, সে আমি না?" (হাসি)
আশীষঃ যে লেখে সে আমিই, যে পাবলিশ করে সে আমি না (হাসি)!
রূপকঃ দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আমি যাব, তবে তার আগে একটা গল্প একটু শুনতে চাই। আপনার বইতেই আছে। উৎপল দত্ত আপনার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক লেখার প্রতিবাদে 'জপেনদা জপেন যা' সিরিজে একটা লেখা ছেপেছিলেন। সেই গল্পটা একটু বিশদে শুনতে চাইছি।
আশীষঃ হ্যাঁ, এইটা বেশ মজার গল্প। তোমায় যেমন বলছিলাম, আমার যখন একটা চাকরির খুব প্রয়োজন, তখন মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরিটা পাই। বরোদা যাবার আগে তখন ফ্রন্টিয়ারের লেখাটা লিখেছিলাম। আমার বন্ধু মুকুট ঘোষ প্রায় জোর করেই লিখিয়েছিল।
রূপকঃ আচ্ছা, মানে আপনার ফ্রন্টিয়ারের প্রথম লেখাটারই সমালোচনা করেছিলেন উৎপল দত্ত?
আশীষঃ হ্যাঁ, ওই লেখাটাই! 'রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড জালিয়ানওয়ালাবাগ', এই নামে।
রূপকঃ হ্যাঁ আপনি আগেও বলেছেন।
আশীষঃ তো, লিখে তো আমি বরোদা চলে গেলাম। তারপর আমার এক বন্ধু এখান থেকে চিঠি লিখে জানাল যে, উৎপল দত্ত তোমার ওই লেখাটাকে 'জপেনদা জপেন যা' সিরিজে তুলোধোনা করেছেন! (হাসি) আমি ঠিক করলাম, এখনই কিছু করব না। এরপর কলকাতা ফিরে এসে আমি উৎপল দত্তকে, আমার পক্ষে যতখানি সম্ভব কড়া ভাষায়, কিন্তু জপেনদার মতোই স্যাটায়ারিকাল ঢঙে উত্তর দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, "জপেনদা, আপনার কাছ থেকে এইরকম বিলো দ্য বেল্ট আমি আশা করিনি!" (হাসি) আমি ওঁর ভুল, মানে সাল তারিখে যে ভুল করছেন সেটা আমি দেখিয়ে দিয়েছিলাম। তবে যেটা আমার ওঁর প্রতি শ্রদ্ধার জায়গা তা হল, লেখাটা তিনি ছেপেওছিলেন। মোস্ট প্রোবাবলি 'এপিক থিয়েটার' কাগজে। উৎপল দত্তর সঙ্গে এই ধরনের এক-আধটা টাসল আমার আরও বার কয়েক হয়েছিল। একদিন এই নিয়ে আড্ডা হবে। আজকাল আমার লেখা নিয়ে দু-চারটে ভালো কথা তাও শুনতে পাই, আগে লোকে গালাগালই করত। একজন বন্ধু আমায় বলেছিল, "তোমার লেখার দোষ কোথায় জানো? তোমার গদ্যটা খুব ভালো কিন্তু তুমি যে কোনও লেখাই প্রথমেই তিন চারটে চড়-চাপড় মেরে শুরু করো!" (হাসি) তবে, অল্প বয়সে অনেক বেশি করতাম। আজকাল আর অতটা করি না। ভিতর থেকেই একটা সেন্সর কাজ করে।
রূপকঃ এবার একটা অন্য কথায় আসি। আপনি রবীন্দ্রনাথের আলোচনায় একটা খুব সুন্দর শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন নানা জায়গায়। ওঁর কবিসত্ত্বাকে বুঝতে গিয়ে বলেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘সেন্ট্রাল সিমপ্লিসিটি’ বা কেন্দ্রীয় সারল্য হল, তিনি একজন কবি। আপনি নিজে যুক্তির পক্ষে, বিজ্ঞানের ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন সমস্ত কিছু নিয়েই কাজ করেছেন, এখনও করছেন। আবার যুক্তি যদি কলাপক্ষ হয় রবীন্দ্রনাথ আপনার ভাবপক্ষের দিক…
আশীষঃ শব্দটা সুন্দর ব্যবহার করেছো। ভাবপক্ষ!
রূপকঃ শব্দটা আমার নয়, ধার করা। এত সব কাজের মধ্যে থেকে, এতদিন পড়াশোনা করে আপনার কী মনে হয়, আপনার সেন্ট্রাল সিমপ্লিসিটি কোনটা?
আশীষঃ আমার… (একটু থেমে) …আমি নিজে অনেক ভেবেছি। আমাকে কোন জিনিসটা সব থেকে প্রত্যক্ষভাবে নাড়া দেয় সেটা বুঝতে চেষ্টা করেছি। মানে, যেখানে আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারি যে আমি অসহায়, রিয়্যাকশানের দিক থেকে আমার সেন্সরশিপ কাজ করছে না, এইরকম একটা অবস্থার কথা আমি বলতে চাইছি। এখনও পর্যন্ত তেমন জিনিস, আমার ক্ষেত্রে মিউজিক! ধরো খুব একটা জটিল জিনিস লিখছি, বা হয়তো ভিতরে ভিতরে স্যাটিস্ফ্যাকশান আসছে যে, এইবার ব্যাপারটাকে গুছিয়ে আনতে পেরেছি, ঠিক সেই সময়ে, পাশের বাড়ি থেকে হয়তো কোনও একটা গানের কলি ভেসে আসছে, ব্যাস! সুরটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথায় ঢুকে গেল! আমি দেখেছি আমি আর বার করতে পারি না। এমনটা কিন্তু আমার অন্য কোনও কিছুতে হয় না!
পাভলভিয়ান ব্যাখ্যায় ব্রেন টাইপ বলে একটা কথা আছে। এটা আমার মনে হয় তেমনই কিছু। শুধু বাইরের স্টিমুলাসে এটা হয় না। ব্রেন স্ট্রাকচারের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে একটা কিছু থাকে…কারও কারও যেমন কবিতার দিকে হয়, পেইন্টিংয়ে হয়, ফিল্মে হয়, আমার ক্ষেত্রে একেবারে বিবশ করে দেওয়ার মতো যদি কিছু থাকে, সেটা মিউজিক। আমার র্যাশনালিটি সম্পূর্ণ অফ হয়ে যায়, এটা আমি ফিল করেছি। তুমি এই জায়গাটাকে আমার কেন্দ্রীয় সারল্য বলতে পারো, কারণ মিউজিকের ক্ষেত্রে আমি হেল্পলেস!
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কেন্দ্রীয় সারল্যেরই সাধনা করে গেছেন, পাননি। পাননি বলেই এত কিছু! আমি একবার শঙ্খবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "আপনার কি মনে হয় না, যে এই এন্টায়ার বিশ্বভারতী ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ যদি না করতেন তাহলে আমরা কতভাবে লাভবান হতাম! আপনার মনে হয় না, এইসব ফালতু কাজ তিনি কেন করেছেন? ওঁর মতো লোক এসবে কেন জড়াবেন বলুন তো?" শঙ্খবাবু নিজের স্বকীয় স্বভাবে চুপ করে থেকে বললেন, "ওটাও ওর ক্রিয়েটিভিটির প্রকাশ!" আমি যদি টোটালিটির দিক থেকে দেখি, কথাটা নিশ্চয়ই ঠিক। কিন্তু আমি যখন রবীন্দ্রনাথকে একজন কবি, একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে দেখছি, তারপর যখন দেখি যে তিনি বিশ্বভারতীকে নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে দাবি করছেন, তখন অবাক হই। আমার তো মনে হয়, ওইটা ওঁর সব চেয়ে বড় ফেইলিওর! ওটা যদি তিনি না করতেন তাহলে রবীন্দ্রনাথ অ্যাজ আ ক্রিয়েটার অনেক উপরে উঠতে পারতেন। ওটার জন্য ওঁকে এত বেশি কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে, এত বেশি বাজে লোকের সঙ্গে মিশতে হয়েছে কিছু বলার নেই, শান্তিনিকেতনে ক্ষিতিমোহন সেন বা ওরকম দু-একজন লোক ছাড়া আর যারা ছিল তারা তো সকলেই স্তাবক গোত্রের। একদম বাজে! এদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন কাটাচ্ছেন এবং তারা ওঁকে গুরুদেব গুরুদেব বলে সারাদিন প্রণাম করছে এবং তিনিও সেই প্রণামটা নিচ্ছেন! হাস্যকর লাগে না?
রূপকঃ রাবীন্দ্রিক্স!
আশীষঃ আই হেট দ্যাট! আমার এক বন্ধু অমিতেশ সরকার, ওকে সবাই তুবি বলে জানে, একসময় বিপ্লবী রাজনীতি করেছে, দুর্ধর্ষ গানের গলা, ওর একটা রবীন্দ্রনাথের গানের বিষয়ে বই আছে। বইয়ের নাম 'প্রাণের গানের ভাষা'। ও একটা কথা বলত যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গেলেই যে বিশেষ একটা ধুতি পরতে হবে বা গোড়ের মালা নিতে হবে এসব আমি মানি না, আমি জিন্স পরে গাইব কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানটা নিখুঁতভাবে গাইব। হি ডিড দ্যাট। আমি মনে করি, রবীন্দ্রচর্চা আমাদের আরও বাড়ানো উচিত। সবাই ওই গুটি পঞ্চাশ গানের মধ্যেই ঘোরা ফেরা করে! রবীন্দ্র-প্রবন্ধ কেউ পড়েই না! কালান্তরের প্রবন্ধগুলো আমার এক বন্ধু সম্প্রতি পড়ছে, সে পড়ছে আর মুগ্ধ হচ্ছে! একমত হচ্ছে না, তা হতেই হবে তেমনও নয়।
ভাবো, ন্যাশনালিজম বইটা ১৯১৭ সালে ইংরেজিতে বের হয়, আর তার বাংলা হল ২০১২ সালে। এ আমাদের কী ধরনের রবীন্দ্রচর্চা? শুধু জুঁই ফুলের গন্ধ আর মিষ্টি মিষ্টি কথাই কি রাবীন্দ্রিকতা?
রূপকঃ এইখানে একটা প্রশ্ন আসে! আপনি একাধিক জায়গায় লিখেছেন যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা ধর্মযাজকেরা আমাদের দেশের অনেককেই ব্যবহার করতে পারল কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে পারেনি! ধর্মের দিক থেকে না হলেও এই তথাকথিত ‘রাবীন্দ্রিক্স’রাও তো একপ্রকার ফান্ডামেন্টালিস্ট, ধর্মযাজক! তাহলে? আমি অনেককে বলতে শুনি, আমাদের রামকৃষ্ণ আছেন আর রবীন্দ্রনাথ আছেন, আমরা তাই ভগবানে বিশ্বাস করি না। হাস্যকর!
আশীষঃ ঠিকই! এরা যদিও সে অর্থে ধর্মের চাটুকারিতা করছে না, এরা রবীন্দ্রনাথকেই ধর্মে রূপান্তরিত করছে! সেটা আরও সাংঘাতিক! খারাপ তো বটেই! আমি বলতে চাইছি যে আজকের ভারতে, যেখানে আরএসএস বা বিজেপি বিবেকানন্দ বা শ্রীঅরবিন্দকে কাজে লাগাচ্ছে, সেখানে তারা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। শান্তিনিকেতনে, গোড়ার দিকে ওঁর যে একটা রিঅ্যাকশেনারি ফেজ ছিল সেটাকে ওরা কাজে লাগাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু সাধারণভাবে আরএসএস তাদের প্রতিবিপ্লবে রবীন্দ্রনাথকে কাজে লাগাতে পারছে না। তারা ধাক্কা খাচ্ছে কিন্তু বিবেকানন্দের ক্ষেত্রে খাচ্ছে না। আমার মনে হয়, হাজার ওঠা-নামার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের একটা ইন্নেট র্যাশনালিটি ছিল! ওঁর ‘ইউনিভার্সাল ম্যান’ বা ‘বিশ্বমানবতা’ নামক আইডিয়াটা, (যেটা আসলে কী তা কেউ জানে না, তিনিও জানতেন না) আর যাই হোক র্যাশনালিজমের দিকে এগোনোর একটা ঝোঁক তো বটেই। উপর থেকে ভগবান ঠিক করে দিয়েছে, তেমন মানুষের কথা আইডিয়াটা বলছে না। মানুষের ভিতর থেকে বেরিয়ে মানবতা একটা ইউনিভার্সাল চেহারা নিচ্ছে, এই জিনিস! তার মধ্যেও আইডিয়ালিজম আছে, ভাববাদ আছে, কিন্তু নট টোটালি ইরর্যাশনাল! মানুষের ধর্মের প্রসঙ্গ থেকে আর এক পা এগোলে রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিকে চলে আসতেন! (হাসি)
রূপকঃ এটা চমৎকার কথা!
আশীষঃ কিন্তু সেই এক পা তিনি এগোলেন না! ওঁর ‘শেষ লেখা’-র ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নতুন আবির্ভাবে-
কে তুমি,
মেলেনি উত্তর।
এরপর লিখছেন;
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিমসাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-
কে তুমি,
পেল না উত্তর।
কাজেই অ্যাট বেস্ট হি ওয়াজ অ্যান অ্যাগনস্টিক! উত্তর পাওয়া যায় না, ফাইনাল উত্তর আমরা পাই না! এই জায়গায় তিনি আসতে পেরেছেন। তাছাড়া, একেবারে মৃত্যুশয্যায় ডিক্টেট করে লেখা যে কবিতাটা…
রূপকঃ আবু সঈদ আয়ুব যেটা নিয়ে ভালো আলোচনা করেছিলেন?
আশীষঃ হ্যাঁ হ্যাঁ! সেই ‘ছলনা দিয়ে করেছো চিহ্নিত’, অর্থাৎ মহৎ যে, সে ছলনা দিয়ে নিজেকে চিহ্নিত করছে। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে লেখা কত বড় কথা!
রূপকঃ অর্থাৎ আপনি বলছেন রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর মুহূর্ত অবধি ওই কন্ট্রাডিকশানেই দাঁড়িয়ে আছেন?
আশীষঃ হ্যাঁ, তবে এখানে ওঁর কন্ট্রাডিকশানটা আমাদের দিকে ঝুঁকে রয়েছে! (হাসি) শেষমেশ এসে উঠতে পারলেন না, তবে একটু ঝুঁকে রইলেন। এখন ওঁকে আমি আমাদেরই লোক বলি কিন্তু ওই একটু গায়ে কাদা-টাদা লেগে আছে এইরকম আর কী!
রূপকঃ বুঝেছি! দেখুন ভাবতে তো ভালোই লাগছে, তবে এখানে দুটো প্রশ্ন থাকছে। শুনে আপনি জুতো-টুতো ছুড়তে চাইলে ছুঁড়বেন, তাও করি।
আশীষঃ না, আমি অত সহজে জুতো ছুড়ি না। জুতোর অনেক দাম!
রূপকঃ আমি স্বদেশী সমাজ, মানুষের ধর্ম আপনার সঙ্গে কথা বলার আগে আবার পড়লাম। ব্যক্তিগত স্তরে বলি, ওঁর প্রবন্ধের গদ্যশৈলী আমার পছন্দ হয় না।
আশীষ: হ্যাঁ, একের পর এক উপমা ফেনিয়ে চলেছেন, অনেকের ভালো নাই লাগতে পারে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ এক অর্থে প্রবন্ধই নয়। সবই পার্সোনাল প্রোজ।
এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলি। এই যে স্বদেশী সমাজ, যা নিয়ে আজকাল সকলে অনেক কথা বলছে, আমি এর প্রচণ্ড বিরোধী। আমি একথা আগেও লিখেছি এবং আজও একই কথা মনে করি যে, ওঁর এই কনসেপ্ট আসলে সাম্রাজ্যবাদকে এড়িয়ে যাওয়ার একটা ছল। এই যে তিনি বলছেন, ‘আমি ডিরেক্টলি পলিটিকালি কন্ট্রিবিউট করব না এবং তার বদলে আমি আমার নিজের যা ক্ষমতা তাই দিয়ে আমার গ্রামকে গড়ে তুলব’, এটা আমি মানতে পারি না। আমার প্রশ্ন হল, রাষ্ট্র যখন আপনাকে ডাণ্ডাটা মারবে তখন আপনি কী দিয়ে লড়বেন? অর্থাৎ আপনি ধরে নিচ্ছেন যে, এই কাজ করলে আপনি পলিটিকাল ডাণ্ডা খাবেন না! তাই তো? এটা তো কম্প্রোমাইজ! যাতে আপনাকে ওই মারটা না খেতে হয় তার জন্য আপনি এইটা করছেন। আমি এইটাকে একদমই মানতে পারছি না!
রূপকঃ ভেরি অ্যালাইক প্যারিস কমিউন! কিন্তু কম্প্রোমাইজের জায়গায় একটা বিরাট পার্থক্য!
আশীষঃ প্যারিস কমিউন ওয়াজ কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট। ওখানে একটা ক্লাস উচ্চ-ক্লাসকে ওভারথ্রো করতে চাইছে। আর এক্ষেত্রে যেখানে যা থাকার তাই থাকছে; ব্রিটিশ তুমিও থাকো, বড়লোক তুমিও থাকো, ক্ষমতাবান তুমিও থাকো, আমিও থাকছি! বলতে পারো, জমিদারি বেনেভলেন্সের খানিকটা মার্জিত রূপ!
আমার নিজের কানে শোনা একটা গল্প বলি। আমার এক দুঃসম্পর্কের দাদু দুঁদে জমিদার ছিলেন। ছোটবেলায় একদিন শুনি, তিনি আমার বাবার সঙ্গে তর্ক করছেন আর বলছেন, "তুমি যাই বলো, জমিদারি প্রথা ভালো ছিল; একজন জমিদারের কত ক্ষমতা বলো তো! জমিদার ইচ্ছা করলে দু-মাসের মধ্যে দশটা গ্রামের চেহারা বদলে দিতে পারে! সেটা সাধারণ মানুষ নিজেরা পারবে?" বাবা তখন তরুণ তুর্কি! বলল, "কিন্তু জমিদার করবে কেন? ওর ধান্দা তো ওখান থেকে কিছু লুটে নিজের মূলধন বাড়ানো! যে করবে সে তো এক্সেপশান!" এই নিয়ে দারুণ তর্ক হতো।
দাদুর লজিকে আমি যদি একজন বেনেভলেন্ট জমিদারের কথা ধরেওনি; এরকম কিছু জমিদার ছিলেনও যারা সত্যি প্রজাদের জন্য ভাবতেন… কিন্তু তাতে কি শোষণটা বদলাচ্ছে? ক্লাস স্ট্রাকচারটা বদলাচ্ছে? বদলাচ্ছে না! এইটা বলতে চাইছি। অজিত কুমার চক্রবর্তী, যিনি ওঁর অতবড় ভক্ত, যিনি রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী লিখেছিলেন, তাতে তিনি বলছেন যে, দেবেন্দ্রনাথ মনে করতেন জমিদারি ব্যাপারটা ঈশ্বরনির্দিষ্ট! অর্থাৎ কারা জমিদার হবে তা উপর থেকে ঠিক হয়ে আসে! সমস্যা হল কথাটা কিন্তু অজিতবাবু খারাপ অর্থে বলেননি এবং শুধু তাই নয়, তুলনায় টলস্টয়কে টেনে আনছেন। টলস্টয় বড় জমিদার ছিলেন ঠিকই কিন্তু যখন তিনি বোঝেন যে ব্যাপারটা ভুল এবং অনৈতিক, তখন কিন্তু জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন! নিজে হাতে লাঙল ধরেছিলেন! একথা দেবেন্দ্রনাথ কল্পনাও করতে পারতেন না এবং সেটা রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন সমর্থন করে এসেছেন! কোনওদিন বেরোতে পারেননি!
রূপকঃ কাজেই, যা দাঁড়ালো, ভায়োলেন্সের সমর্থক না হওয়ায় তিনি স্বদেশি আন্দোলনের বিপক্ষে, তিনি গান্ধিবাদের বিপক্ষে, ওঁর 'স্বদেশী সমাজ'-এর কনসেপ্ট নিয়েও আমরা সন্দিহান, এই সব মিলিয়ে আমি ওঁর পলিটিক্সটা বুঝতে পারছি না! এর মানে এই নয় যে, ওঁকে কোনও একটা জানা খোপে ফেলতেই হবে, তবে বুঝতে তো হবে! তিনি কী অ্যাপলিটিকাল? এইখানটা নিয়ে আপনার মত জানতে চাইছি।
আশীষঃ আমি ওঁর রাজনীতিকে বেসিকালি ‘সুবিধাবাদ’ বা ‘অপরচুনিজম’-ই বলতে চাইব!
রূপকঃ আমি শব্দটা একদম স্যাংগুইন না হয়ে ব্যবহার করতে চাইছিলাম না! যাক আপনি নিজেই বলে ফেললেন!
আশীষঃ আমি তো সবসময়ই বলি। ওঁর রাজনীতিতে অপরচুনিজম অঙ্গে অঙ্গে মাখানো! যেমন ধরো, ক্ষুদিরামকে নিয়ে তিনি জীবনে কোনওদিন কিচ্ছু লিখলেন না, একেবারে পছন্দ করতেন না কিন্তু সমালোচনা করেছেন! অথচ যতীন দাশকে নিয়ে তিনি অত সুন্দর গান লিখলেন! দিল্লিতে যখন অত্যাচার হচ্ছে তখন কথা বলছেন, জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা তো আছেই! যেখানে গান্ধি কথা বলছেন না, সিআর দাস প্রতিবাদ করছেন না, সেখানে তিনি একা এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করছেন! ঠিক তারপরেই, পাশাপাশি, মূর্তি স্থাপনের সময়, যেখানে নজরুল সমর্থন করলেন, তিনি তার আগের স্টান্সকে ঢেকে ওয়াইট-ওয়াশ করার জন্য সরে এলেন! এইটা তাঁর সুবিধাবাদ!
এইখানে, মার্ক্সের ক্লাস ফ্যাক্টরটা কাজ করে! তুমি না-ও মানতে পারো কিন্তু আমি মানি। মার্ক্স যেমন বলেছেন, যে কোনও ক্রিয়েশান তার শ্রেণি চরিত্রকে অতিক্রম করে যায়, কিন্তু পলিটিক্সে সেটা হয় না। তাই রবীন্দ্রনাথও সারা জীবনে কখনও শেষ পর্যন্ত তাঁর ক্লাস-বেরিয়ারটা ডিঙোতে পারেননি! ওই ন্যেই আমাদের দিকে আসতে গিয়েও, একটু ঝুঁকে আটকে গিয়েছেন! শেষ পর্যন্ত জমিদারই!
রূপকঃ আপনি যে শ্রেণি চরিত্রের কথাটা বললেন সেটাকে যে আমি একেবারে মানি না তা নয়। হাজার সমস্যায় রাস্তায় নেমেও, ওই ক্লাস বেরিয়ার আমাদের, মানে মধ্যবিত্তকে সুবিধাবাদীই করে রাখে। ও আর আমাদের ডিঙোনো হয় না! যা নেই তার অ্যাসপিরেশান এবং যা আছে তা নিয়ে ইনসিকিউরিটি, এই দুইয়ের মাঝে দোদুল্যমান আমাদের শ্রেণি চরিত্র। আমি এইটা মানি। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পরেরটা ছিল।
আশীষঃ খানিকটা বলতে পারো! একটা কথা বলে ফেলে, তারপর সেটাকে তিনি নানা ভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। যেন কোথাও সমস্যা হয়ে যাচ্ছে! কাজেই ওঁর পলিটিকাল স্ট্যান্ড গুলো অপরচুনিস্ট, কোনও সন্দেহ নেই!
রূপকঃ বুঝেছি। এবার আপনার লেখা থেকে একটা প্রশ্ন করি। রবীন্দ্রনাথ বিয়িং রবীন্দ্রনাথ, যাকে একমেবদ্বিতীয়ম বললেও বোধহয় ভুল করা হবে না, তাঁর দর্শনের আলোচনায় জোসেফ নিডহ্যামকে নিয়ে এসে একটা সিমিলি টানার প্রয়োজন পড়ল কেন? আপনার লেখাটা বুঝতে আমার কোনও অসুবিধা হয়নি কিন্তু এই তুলনার দরকার কী? শুধুই সিমিলির জন্য সিমিলি?
আশীষঃ এটা একটা খুব ভালো প্রশ্ন। ব্যাপারটা উলটো দিক থেকে দেখো। নিডহ্যাম নিজেকে মার্ক্সিস্ট বলেন, নিজেকে সোশালিস্ট বলেন, একইসঙ্গে ধর্মের কথাও আনছেন। অর্থাৎ ধর্ম এবং মার্ক্সিস্ট অ্যাঙ্গেলটাকে মেলানোর চেষ্টা করছেন। কাজেই দু'জনই ধর্মকে স্বীকার করে নিয়ে মানুষের মঙ্গলার্থে কী করা উচিত তা নিয়ে ভাবছেন। নাহলে রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে ওই রুরাল ডেভেলপমেন্ট করতে যেতেন না, শুধুই শান্তিনিকেতন বানিয়ে চুপ করে বসে থাকতেন। কাজেই তিনি ধর্ম এবং শ্রমজীবি মানুষের এগিয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস, এই দুইয়ের মধ্যে একটা সম্মেলন ঘটাতে চাইছেন। নিডহ্যামও এই জিনিসটা করেছেন। প্রথম প্রথম যখন নিডহ্যাম পড়তে শুরু করি, আমার ধারণা ছিল যে, ধর্মকে তিনি কেবল অ্যানথ্রোপোলজিকাল দিক থেকে ব্যাখা করেছেন। পরে আমার সেই ভুল ভেঙে যায়। তিনি মারা যাওয়ার পর দিল্লিতে খুব সুন্দর একটা সেমিনারে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে রিচার্ড গ্রেগরি বলে ক্যানাডার একজন ইয়াং ছেলে, সে আমার কথা শুনে লাঞ্চের সময় সোজাসুজি বলে, "ইউ আর রং দেয়ার! হি ওয়াজ আ রিলিজিয়াস ম্যান ইন দ্য অর্ডিনারি সেন্স!" ছেলেটি বলে যে, নিডহ্যাম নিজে অ্যাংলিকান চার্চের সদস্য ছিলেন, হি ইভেন গেভ সার্মনস দেয়ার! পরে আমি সমস্ত তথ্য মিলিয়ে দেখেছি ওর প্রত্যেকটা কথা ঠিক। একইসঙ্গে নিডহ্যাম নিজে বলেছেন যে, তাঁর মধ্যে বিভিন্ন কন্ট্রাডিকশানস কাজ করেছে। প্রথমত সেই সময়ে বার্নাল এবং আরও মার্ক্সিস্ট বিজ্ঞানীদের গোষ্ঠীর মধ্যে থেকেও একমাত্র ওঁরই একটা ধর্মীয় ডিস্পেনসেশান ছিল। সেটা রেখেই কিন্তু তিনি মাওপন্থীও হচ্ছেন, সোশ্যালিজমকেও সমর্থন করছেন; কী করে আসছে? রবীন্দ্রনাথও ইন্সটিটিউশানাল ধর্ম থেকে ক্রমশ সরে মানবতাবাদের দিকে চলে আসছেন। তুলনাটা আমি এই জায়গায় এনেছি!
রূপকঃ সেটা তো আপনার লেখা থেকেই স্পষ্ট কিন্তু আপনি তুলনা আনলেন কেনো? কী প্রয়োজনে?
আশীষঃ তোমার কথাটা ঠিক। রবীন্দ্রনাথের মতো নিডহ্যাম ওয়াজ নট আ ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস। আমি হয়তো তুলনাটার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকেই আরও খানিকটা বুঝতে চেয়েছি। বলতে বলতে মনে পড়ল; যে রুডল্ফ অটো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তাঁকে নিডহ্যাম বিরাট গুরুত্ব দিতেন। ‘নিউমিনাস’-এর আইডিয়াটা তিনি অটোর থেকেই নিয়েছিলেন। আবার রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সেটাও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা নয়। কাজেই ধর্মকে কীভাবে প্রগ্রেসিভ লুকিং লোকেরা দেখতে পারে, এই জায়গাটাতেও বোধহয় একটা কানেকশান ছিল।
রূপকঃ হ্যাঁ, এইবার আমার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।
আশীষঃ এইটা সত্যিই খুব ভালো প্রশ্ন। আমাকে এই প্রশ্নটা আগে কেউ করেনি। তোমায় বলি না, প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিজের ধারণা পরিষ্কার হয়, এই ক্ষেত্রেও আমার নিজের ধারণাটা আরেকটু পরিষ্কার হল। ভিতরে হয়তো এই ভাবনাটাই ছিল, তবে আগে আলাদা করে ভাবিনি।
রূপকঃ শেষ প্রশ্নে আসি, এবং এইটা দিয়ে আপনাকে খানিকটা রাগিয়ে আড্ডাটার ইতি টানব।
আশীষঃ বলো।
রূপকঃ আপনি এক জায়গায় লিখছেন, আমি কোট করছি। “রবীন্দ্রনাথ একজন সক্রিয় সৃজনশীল শিল্পী। বিজ্ঞান এমনকী দর্শনও তাঁর ক্ষেত্র নয়, এগুলো সবই আসলে তাঁর শিল্প সৃষ্টির খোরাক!”
আশীষঃ আগে যেরকম বললাম, বিশ্বভারতীর ক্ষেত্রে শঙ্খবাবুও মোটামুটি এই কথাটাই বলেছিলেন।
রূপকঃ বুঝেছি। আগেরদিন আপনার সঙ্গে কামু ও সার্ত্রের কমিটমেট টু আর্ট এবং কমিটেড আর্টিস্টের কনসেপ্ট নিয়ে কথা হচ্ছিল; সেই পরিপ্রেক্ষিতে, আমি ওঁর ননফিকশান বা এমনকী চতুরঙ্গও যখন পড়তে যাব আমার তো শুধুই মনে হবে তিনি কথাগুলো শুধুই ওঁর আর্টের জন্য বলছেন। কোনও কমিটমেন্ট নেই! ওঁর প্রায় সমস্ত লেখা পড়তে গিয়ে শুধুই মনে হবে সমস্ত অনুভূতিই আসলে সৃষ্টির অছিলা!
আশীষঃ অ্যাপারেন্টলি, সত্যিই তাই! আর এই অ্যাপারেন্টলি কথাটা খুব জরুরি। ওঁর গানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সত্যি।
রূপকঃ আপনার পছন্দ নাও হতে পারে, তবে চন্দ্রিল ভট্টাচার্য একবার এক আলোচনায় বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের মতো পার্ফেকশনিস্টের এই এত লেখা লিখে ফেলার মধ্যে একটা স্ববিরোধ আছে। রবীন্দ্রনাথের মহাকালীন জিনিয়াসকে প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকার করে নিয়েও চন্দ্রিলের কথাটা আমার খুব ভুল মনে হয় না। অকারণে এত লেখা ছাপানোর কী প্রয়োজন ছিল?
আশীষঃ অকারণে নয়। রবীন্দ্রনাথ অত্যধিক বেশি লিখেছেন, সকারণে! প্রতিভার কতগুলো ধরন থাকে। তুমি দেখবে জীবনানন্দের এই যে গাদা গাদা উপন্যাস এখন ছেপে বেরোচ্ছে সেগুলো তিনি নিজে কখনওই বার করেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই সংযমটা ছিল না। কেন ছিল না? কারণ তাঁকে বাংলা কবিতা এবং ভাষার তিনটে পর্বকে তাঁর সীমিত সময়ে তৈরি করে ম্যাচিওরিটিতে পৌঁছে দিতে হচ্ছে। আর লেখার পরিমাণটা যদি হিউজ না হয় সেটা কার্যক্ষেত্রে অ্যাচিভ করা সম্ভব নয়! আজ দুটো কাব্য লিখে একজন কবি বিখ্যাত হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ গাদা গাদা লিখে ওই প্ল্যাটফর্মটা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। এখানে তাঁকে একজন বিল্ডার হিসাবেও দেখতে হবে।
রূপকঃ আশীষদা, আপনার কথাটাতে একটা অ্যাপ্রক্সিমেশান আছে। মনে হচ্ছে যে, তিনি যখন কাজটা করছেন তিনি কনশাসলি ভেবে নিচ্ছেন যে, আমি ওমুক পরিবর্তনটা আনব বা তমুক রাস্তাটা তৈরি করব।
আশীষঃ না না, কোনও বড় কাজ তিনি কনশাসলি ভেবে করেছেন বলে আমার মনে হয় না! কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি, রিয়েলিটি তাঁর সাবকনশাসকে দিয়ে সেটা করিয়ে নিয়েছে। তিনি একটা কথা ব্যবহার করতেন, “পথে হাঁটা এবং পথ তৈরি করা”; এইটা একসঙ্গে ওঁকে করতে হয়েছিল। কথাটা ১০০% সত্যি। ওঁর গান বা কবিতাকে ফলো করলেই দেখবে, একটা ভাবকে নিয়ে গাদা গাদা নিম্ন ও মধ্যমেধার কবিতা একের পর এক চলছে তো চলছেই এবং তারপর ঝপ করে একটা কোয়ালিটেটিভ জাম্প হচ্ছে! একটা জেম বেরিয়ে আসছে। আমি এইটা বলতে চাইছি।
রূপকঃ তা সেগুলো বাদ দিলেও তো হতো, আমি এইটা বলতে চাইছি।
আশীষঃ হ্যাঁ এই এডিটিংটা ওঁর ছিল না এবং সেটা করে দেওয়ার মতোও কেউ ছিল না। মাইকেল মধুসূদন ছাড়া, যাঁকে তিনি কোনওদিন সহ্যই করতে পারেননি, ওঁর সামনে আর কী আদর্শ ছিল, সেই সময়ে? কাজেই একটা লোককে, বলতে গেলে গোটা ভাষাটাই তৈরি করতে হয়েছে, যার জন্য এত জাংক! এটা আমি মানছি। গৌরীদা, ওঁর রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বইতে, ইংরেজি এবং জার্মান নানা কবিতার সঙ্গে তুলনা-টুলনা করে বলেছিলেন যে, ওঁর মনে হয় সাকুল্যে রবীন্দ্রনাথের ২০০ কবিতা রেখে দেওয়া যায়! কিন্তু কথাটা বলছেন কে? যিনি আপাদমস্তক রবীন্দ্র-নিমগ্ন! বলছেন, ওই দুশোটা কবিতা ওই জঞ্জালগুলো না লিখলে বেরতো না! এইখানেই ডায়েলিকটিক্স! এজরা পাউন্ডের একটা কথা মনে আসে, এই ক্ষেত্রে। এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড তো অনেক বড় ছিল, ওটা পাউন্ডের কাছে যাওয়ায় তিনি পুরো কেটে দিয়ে, ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ' থেকে শুরু করেন। তার আগে নাকি বেশ কিছু প্যারা ছিল।
রূপকঃ পরিষ্কার! কিন্তু ওঁর সেই প্র্যাক্টিসটাকে বাজারে আনার কোনও প্রয়োজন ছিল কি?
আশীষঃ সেটা বলতে পারো, অ্যান্ড আই এগ্রি! তিনি তো পাউন্ডের মতো একজন সম্পাদক পেলেন না, স্তাবক পরিবৃত হয়েই রয়ে গেলেন। কথা বলার লোক পেল না লোকটা। হোয়াট হি নিডেড ওয়াজ, আ ভেরি গুড এডিটর!