পাথর ছোঁড়া হয়েছিল অটল বিহারীকে! দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এই বীভৎস খুন...

Ranga Billa Kidnapping and Murder Story: ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এই সম্পূর্ণ সাক্ষারকারটি সংগঠিত হয় জেলের ভেতর।

খুব কম মানুষই নিজেদের নামকে বিশেষণে বদলে দিতে পারেন। সে বিশেষণকে আপনি সু বলবেন নাকি কু, আপনার ব্যাপার। কিন্তু এই ভারতে দুই এমন চরিত্র ছিলেন যারা যথার্থভাবে বিশেষণ হয়ে ওঠার কাজটি সারতে পেরেছিলেন। একটি অপহরণ ঘিরে তোলপাড় হয়েছিল দেশ। অপরাধের সুরাহা করতে বেগ পেতে হয়েছিল খোদ দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে। এই অপহরণের ঘটনা জানাজানি হতে জনগণের রোষে প্রাণ যেতে বসেছিল দেশের বিদেশমন্ত্রীর। পরবর্তীকালে যখন দোষীরা ধরা পড়ে তখন জনতার একটাই দাবি ছিল, ফাঁসি! কিন্তু ফাঁসির আগে এই দুই অপরাধীদের অনেক না বলা কথা ছিল, যা তারা বলেননি কিংবা বলতে দেওয়া হয়নি। কথা হচ্ছে কুখ্যাত অপরাধী জুটি রঙ্গা-বিল্লার। ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত খুনির তকমা রয়েছে তাঁদেরই।

২৬ আগস্ট ১৯৭৮-এর সন্ধ্যায় দিল্লির ধৌলাকুয়ার নেভি অফিসার কোয়ার্টারে অধীর আগ্রহে রেডিও চালিয়ে বসেছিলেন ক্যাপ্টেন মদনমোহন চোপড়া এবং তাঁর স্ত্রী রোমা চোপড়া। রাত আটটা থেকে তাদের দুই সন্তানের একটি অনুষ্ঠান অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আটটা বাজার পরেও যখন রেডিওতে সন্তানদের আওয়াজ শোনা গেল না, তখন চিন্তায় পড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন চোপড়া। ক্যাপ্টেন চোপড়া এবং তাঁর স্ত্রীর দুই সন্তান- মেয়ে গীতা চোপড়া এবং ছেলে সঞ্জয় চোপড়া। সেন্ট মেরি অ্যান্ড জেসাস কলেজের ছাত্রী ১৬ বছরের গীতা পাশ্চাত্য সঙ্গীত এবং নৃত্যে অত্যন্ত পারদর্শী। তাঁর ভাই ১৪ বছরের কিশোর সঞ্জয় ছিল বক্সিংয়ে পারদর্শী। মর্ডান স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র সঞ্জয় স্বপ্ন দেখত বাবার মতোই একজন সফল নেভি অফিসার হওয়ার। সন্ধা সওয়া ছটা নাগাদ ভাই এবং বোন সংসদ রোডে অবস্থিত অল ইন্ডিয়া রেডিও-র সদর দপ্তরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। কথা ছিল আটটা নাগাদ কিশোরদের নিয়ে হওয়া অনুষ্ঠান In The Groove-এ অংশগ্রহণ করবে দুই ভাই বোন। তারপর রাত ন'টা নাগাদ, বাবা গিয়ে তাদের নিয়ে আসবেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কার্যালয় থেকে। কিন্তু রাত আটটার সময় সন্তানদের আওয়াজ শুনতে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে যান ক্যাপ্টেন চোপড়া। সময় নষ্ট না করে সোজা তিনি চলে যান অল ইন্ডিয়া রেডিও-র অফিসে। কিন্তু গিয়ে মদন চোপড়া যা শুনতে পান তাতে তাঁর পায়ের তলা থেকে মাটি খসে যায়। মদন চোপড়াকে জানানো হয়, তাঁর সন্তানরা রেকর্ডিংয়ের জন্য অল ইন্ডিয়া রেডিওতে আসেইনি।

আরও পড়ুন- অনুপ্রেরণা জন আব্রাহাম! ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছিল যেভাবে…

গীতা এবং সঞ্জয় চোপড়া

এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগে নর্থ ব্লকে দিল্লি পুলিশের কাছে একটি ফোন এসেছিল। ফোনের ওপার থেকে জনৈক ব্যক্তি জানান, দিল্লির বাংলা সাহিব গুরুদুয়ারা থেকে নর্থ অ্যাভিনিউর দিকে তিনি একটি গাড়ি যেতে দেখেছেন। সর্ষে রংয়ের ফিয়াট গাড়িটির ভেতর তিনি দু'টি বাচ্চার চিৎকার শুনতে পেয়েছেন। গাড়ির নম্বর HRK8930। এর কিছুক্ষণ পর রাজেন্দর নগর থানাতেও একটি ফোন আসে। ফোনটি করেন বছর তেইশের তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ইন্দর সিং। ইন্দর জানান, তিনি লোহিয়া হসপিটালের সামনে দিয়ে একটি সর্ষে রং-এর ফিয়াট গাড়ি যেতে দেখেছেন। গাড়িটির ভেতর থেকে একটি বাচ্চা ছেলে চিৎকার করছিল। তার জামা রক্তে ভিজে যাচ্ছে। সঙ্গে আরেকটি মেয়ে সামনের সিটে বসা একটি লোকের মাথার চুল ধরে নাড়াচ্ছিল। ইন্দর শংকর রোড পর্যন্ত গাড়িটিকে ধাওয়া করলেও তারপর গাড়িটি সিগনাল ভেঙে এগিয়ে যাওয়ায় তিনি আর তাদের নাগাল পাননি। ইন্দর সিংয়ের দেওয়া গাড়ির বর্ণনা এবং গাড়ির নম্বর আগের ফিয়াট গাড়িটির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তবে কোনও অজ্ঞাত কারণবশত, পুলিশের কাছে দু'টি অভিযোগ আসা সত্ত্বেও তারা উদাসীন থেকে যান।

সেই ফিয়াট গাড়িটি

কিন্তু এইসব ঘটনার কিছুই জানতেন না ক্যাপ্টেন মদন মোহন চোপড়া। ছেলে-মেয়ে অপহরণ হয়েছে বুঝতে পেরেই তিনি তাঁর পরিচিত নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের ফোন করেন। রাত দশটা নাগাদ ধৌলাকুয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেন চোপড়া দম্পতি। উপরমহল থেকে চাপ আসায় টনক নড়ে দিল্লি পুলিশের। ১৪০টি সার্চিং পার্টি সারারাত দিল্লির রাস্তা চষে ফেলে ছেলে-মেয়ে দু'টিকে খোঁজার জন্য। এছাড়াও নেভি অফিসাররা তো ছিলেনই। ঘটনার কথা জানতে পেরে ইন্দর সিং যোগাযোগ করেন ক্যাপ্টেন মদনমোহন চোপড়ার সঙ্গে। তিনি জানান শংকর রোডে শেষবার তিনি গীতা এবং সঞ্জয়কে দেখতে পেয়েছেন। শংকর রোডের কাছে একটি 'রিজ' ছিল। রিজ অর্থাৎ ছোটখাট টিলার মতো। ইন্দর সিংয়ের কাছে সব শুনে সেই টিলার কাছে তল্লাশি শুরু করে দিল্লি পুলিশ। রাত প্রায় সাড়ে তিনটে পর্যন্ত তল্লাশি চালিয়েও কোনও সন্ধান পেল না দিল্লি পুলিশ। এত উচ্চপদস্থ একজন  নৌবাহিনীর আধিকারিকের সন্তানরা অপহৃত হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের উপরেও প্রচুর চাপ এসে পড়ে। আগামী দু'দিন অর্থাৎ ২৭ এবং ২৮ অগাস্ট নয়ডা, গুরগাঁও, মথুরা-সহ দিল্লি লাগোয়া অঞ্চলগুলিতে সার্চ অপারেশন চালায় পুলিশ। কিন্তু এবারেও খালি হাতে ফিরতে হয় পুলিশকে।

অল ইন্ডিয়া রেডিও, দিল্লি

বাধ্য হয়ে সে সময়ে ২০০০ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা করে দিল্লি পুলিশ। যে বা যারা পুলিশকে ছেলে-মেয়ে দু'টি কিংবা অপরাধীদের সম্পর্কে কোনও তথ্য দিতে পারবে তাদের দেওয়া হবে এই পুরস্কার। ইতিমধ্যেই ওই নম্বরের গাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ। ওই নম্বরের গাড়ির মালিক ছিলেন পানিপত নিবাসী রমেন্দর গুপ্তা। পুলিশ গিয়ে দেখে ওই নম্বরের একটি গাড়ি সত্যিই রমেন্দরের কাছে রয়েছে। কিন্তু সেই গাড়ি ফিয়াট নয়। আর তার অবস্থা এতই খারাপ যে, সেটি পানিপত থেকে দিল্লি আনা অসম্ভব। অর্থাৎ অপরাধীরা এই ক্ষেত্রে নকল নম্বর প্লেট ব্যবহার করেছে। এমতাবস্থায় কিছু বিপজ্জনক না হয়ে যায় এই আশঙ্কাই করছিল পুলিশ। ২৯ অগাস্ট তাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। শংকর রোডের ধারে সেই টিলার কাছে লাশ মিলল দুই ভাই বোন গীতা এবং সঞ্জয় চোপড়ার। রাস্তা থেকে মাত্র পাঁচ মিটার দূরে পড়েছিল সেই লাশ। বাচ্চাদু'টির লাশ তাঁদের বাড়ি থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূর থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর দেখা যায়, গীতার আঙুলে রুপোর আংটিটি অক্ষত রয়েছে। এছাড়াও সঞ্জয়ের পকেটে রয়েছে সাড়ে সতেরো টাকা। অর্থাৎ এতটুকু স্পষ্ট ছিল যে, লুটপাটের জন্য অপহরণ কিংবা খুন করা হয়নি। তাহলে খুন কেন করা হলো? পুলিশ নিজের তদন্ত শুরু করার আগেই ঘটনাটিতে রাজনৈতিক রং লাগতে শুরু করে।

আরও পড়ুন- ১৫০ বছর আগে পাঁচ সঙ্গীকে খুন করে মাংস ভক্ষণ! এই ব্যক্তির কাহিনি নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে

চৌধুরী চরণ সিং, মোরারজি দেশাই এবং বাবু জগজীবন রাম (বাঁদিক থেকে)

সদ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক খুইয়ে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের উপর বেজায় চটেছিলেন চৌধুরী চরণ সিং। সংসদের ভেতর তিনি প্রকাশ্যেই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বসেন। সরকারের ভেতরেই বাবু জগজীবন রাম, যশবন্ত রাও চৌহানের মতো নেতারা প্রধানমন্ত্রী দেশাইয়ের বিরুদ্ধে বয়ান দেওয়া শুরু করেন। রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে 'শেম শেম' স্লোগান দেওয়া হয়। বিরোধী শিবিরে বসা ইন্দিরা গান্ধীও সুযোগ বুঝে বিধঁতে থাকেন প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রীর ওপর এতটাই চাপ পড়ে যায় যে তিনি ইস্তফাও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে নিজের কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে সেই সিদ্ধান্ত বদল করেন। তবে মোরারজি পুলিশকে অপরাধীদের ধরার কড়া নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যেই ৩১ অগাস্ট দিল্লির মজলিস পার্কের কাছে পুলিশ সেই গাড়িটি উদ্ধার করে। গাড়িটির ভেতর থেকে বেশ কয়েকটি নকল নম্বর প্লেট উদ্ধার হয়। এছাড়াও গাড়িটির মধ্যে থেকে বেশ কিছুটা মাটি, রক্তের দাগ লাগা বেশ কয়েকটি ব্লেড, পুড়ে যাওয়া সিগারেটের টুকরো এবং মাথার চুল পায় পুলিশ। তবে গাড়িটির স্টিরিও এবং মিউজিক সিস্টেম উধাও ছিল। তদন্তে জানা যায় ৬ সপ্তাহ আগে অশোকা হোটেলের সামনে থেকে চুরি হয়েছে গাড়িটি। গাড়ির মালিক অশোক শর্মা ইতিমধ্যেই গাড়িটি চুরি যাওয়ার রিপোর্ট লিখিয়েছিলেন থানায়।

বিদেশমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী

গাড়িটি উদ্ধার হলেও অপরাধীরা তখনও অধরা ছিল। ফলত জনমানসে ক্রমশ বাড়ছিল ক্ষোভ। এর মধ্যেই একদিন সংসদের বাইরে ছাত্ররা একটি বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করে। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে দেখে আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির কোনও উন্নতি তো হলোই না, উল্টে ভিড় আরও মারমুখী হয়ে ওঠে এবং পাথরবৃষ্টি শুরু হয়। একটি পাথর গিয়ে লাগে বাজপেয়ীর কপালে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাদা পাঞ্জাবী ভিজে ওঠে রক্তে। ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হন অটল। কপালের বাঁদিকে মোট পাঁচটি সেলাই পড়ে তাঁর। বেশ কয়েকটি পাঁজরে গুরুতর চোট পান অটল। পরিস্থিতি বেগতিক হচ্ছে দেখে আর দেরি না করে সংসদে ফিরে যান তিনি। পরদিন সারা মাথা ব্যান্ডেজ করে সংসদে পৌঁছেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। দেশের বিদেশমন্ত্রীর এহেন অবস্থা দেখে মোরারজি দেশাই বুঝতে পারেন পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে। বাধ্য হয়েই দিল্লি পুলিশকে তদন্ত থেকে সরিয়ে সিবিআইয়ের হাতে তদন্তের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী।

তদন্ত হাতে পেতেই বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায় সিবিআই। এই সন্দেহভাজনদের তালিকায় ছিলেন বেশ নৌবাহিনীর কয়েকজন অফিসার। কয়েকদিন আগেউ এই নেভি অফিসারদের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটিতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ক্যাপ্টেন মদনমোহন চোপড়া। এই অফিসাররা স্মাগলিং করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। সন্দেহভাজন অফিসারদের তালিকায় এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আত্মীয়ের নামও ছিল। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে যায়, কিন্তু কোনও গ্রেফতারি নেই! অবশেষে ৮ সেপ্টেম্বর সিবিআইয়ের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। এদিন আগ্রা স্টেশন থেকে কালকা মেলে চেপে বসেন দুই সন্দেহজনক ব্যক্তি। শুধু ট্রেনে চেপে বসলে কোনও সমস্যা ছিল না, কিন্তু ওই দুই ব্যক্তি চেপে বসেন সেনার সংরক্ষিত কামরায়। স্বাভাবিকভাবেই কামরায় উপস্থিত ফৌজিরা জিজ্ঞাসাবাদ করেন ওই দুই লোককে। কিন্তু কোনও প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারছিলেন না তারা। উপরন্তু ফৌজিদের সঙ্গে তর্ক শুরু করে দেন ওই দুই ব্যক্তি। কিছুক্ষণ বচসা চলার পর নকল বন্দুক বের করে ফৌজিদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেন ওই দুই ব্যক্তি। ফলত, যা হওয়ার ছিল তাই হলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ওই দুই ব্যক্তিকে কাবু করে ফেলেন ফৌজিরা। ইতিমধ্যেই এক ফৌজির সন্দেহ হয় ওই দুই ব্যক্তিকে। তাঁর মনে পড়ে যায় তিনি এর আগে তাদের ছবি সংবাদপত্রে দেখেছেন।

আরও পড়ুন- রেসকোর্স থেকে জ্যোতিষ চেম্বার! কলকাতা পুলিশের রহস্যভেদ হার মানাবে ওয়েব সিরিজকেও!

রঙ্গা এবং বিল্লা

পরবর্তী স্টেশন আসতেই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ওই দুইজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় ফৌজিরা। পুলিশি রেকর্ড ঘেঁটে জানা যায় দুই মূর্তিমানের নাম কুলজিত সিং এবং যশবীর সিং। তবে পুলিশের কাছে তারা দু'জন পরিচিত ছিল অন্য নামে, এরাই ছিল কুখ্যাত রঙ্গা এবং বিল্লা। পেশায় ট্রাক ড্রাইভার কুলিজিত সিং অর্থাৎ রঙ্গা আরও বেশি আয়ের উদ্দেশ্যে বিল্লার সংস্পর্শে আসে। প্রথম জীবনে মুম্বইতে বেশ কিছু অসামাজিক এবং অপরাধমূলক কাজ করে ভালোই অর্থ রোজগার করছিল দু'জনে। কিন্তু পুলিশের নজর পড়ে যাওয়ায় মুম্বই ছেড়ে দিল্লি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। জেরায় ধৃতরা জানায়, তাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল গীতা এবং সঞ্জয়ের পরিবারের থেকে মুক্তিপণ চাওয়া। কিন্তু যখন তারা জানতে পারে তাদের বাবা একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক, তারা ঠিক করে নেয় বাচ্চাগুলিকে আর প্রাণে বাঁচতে দেওয়া যাবে না। এরপরেই গীতা এবং সঞ্জয়কে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ধৃতদের বয়ানের ভিত্তিতে শুরু হয় বিচার। এই সময় সারা দেশ জুড়ে উঠতে থাকে রঙ্গা-বিল্লার ফাঁসির দাবি। অবশেষে ২৬ নভেম্বর ১৯৭৯, দিল্লি হাইকোর্ট এই দুই কুখ্যাত অপরাধীকে ফাঁসির সাজা দেয়।

এরপর দুই আসামী সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে সেখানেও দিল্লি হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকেই বহাল রাখা হয়। এই সময় এক সাপ্তাহিক সংবাদপত্র টিউজডে পোস্টের সম্পাদক সোজা হাজির হন পুলিশের কাছে। তিনি দাবি করেন গীতা এবং সঞ্জয়ের হত্যা রঙ্গা-বিল্লা করেনি। এর পিছনে হাত রয়েছে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ নেভি অফিসারের। কয়েকজন ক্ষমতাধারী ব্যক্তি রঙ্গা-বিল্লাকে 'সুপারি' দিয়েছিল গীতা এবং সঞ্জয়কে হত্যা করার। তিনি এও দাবি করেন যে, রঙ্গা-বিল্লা পালিয়ে কোনও ট্রেনে ওঠেনি বরং তাদের মুম্বই থেকে গ্রেফতার করেই আনা হচ্ছিল। ঘটনা আরও জটিল হচ্ছে দেখে এই দাবি সরাসরি নস্যাৎ করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, সিবিআই এবং পুলিশ। এই সময় সুপ্রিম কোর্ট একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত জানায়। আসলে কয়েকজন সাংবাদিক ফাঁসির আগে রঙ্গা-বিল্লার সাক্ষাৎকার নিতে চাইছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি দিচ্ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সাংবাদিকরা এবং সুপ্রিম কোর্ট সাংবাদিকদের পক্ষেই রায় দেয়। ফলত ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এই সম্পূর্ণ সাক্ষারকারটি সংগঠিত হয় জেলের ভেতর। বিল্লা সাক্ষাৎকার দিলেও রঙ্গা দেয়নি। বিল্লা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটাই কথা বলে গিয়েছিল, সে নির্দোষ। তাদের হত্যা করার কাজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে এই 'সুপারি তত্ত্ব' কেন আগে দেয়নি রঙ্গা-বিল্লা? ১৯৮২ সালের ৩১ জানুয়ারি তিহার জেলে ফাঁসি দেওয়া হয় রঙ্গা এবং বিল্লাকে। সত্যিই কি কিছু হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির পিঠ বাঁচাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই দুই অপরাধীকে? নাকি সত্য আসলে অন্য কিছু? এই সবের উত্তর আজও অধরা।

More Articles