ঘাগরা পরা থেকে নগ্নতা, বলিউডের তৈরি পুরুষালি ইমেজ বারবার ভেঙেছেন রণবীর
বলিউড সাধারণ মানুষদের মনে 'পুরুষত্ব' নিয়ে যে ধারনার বুনন করে চলেছিল, এই অভিনেতা কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিডিয়ার সামনে তা ভাঙতে ভাঙতে গেছেন।
বিগত বেশ কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা, রণবীর সিং-এর নগ্ন ফোটোশুটের বিষয়টি নিয়ে দক্ষযজ্ঞ বেঁধে গেছে। রণবীর তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিগুলি পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই কমেন্টের বন্যা বইতে শুরু করে, মাত্র তিন ঘণ্টায় প্রায় এক মিলিয়নের কাছাকাছি লাইক পরে ছবিগুলিতে। চলচ্চিত্রজগতের খ্যাতনামা অসংখ্য ব্যক্তির শুভেচ্ছাবার্তা ঝরে পড়তে থাকে তাঁর কমেন্ট বক্সে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া থেকে শুরু করে বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার মনীশ মালহোত্রা, ইউটিউব-খ্যাত লিলি সিং থেকে টলিউডের ঋতাভরী চক্রবর্তী- সবার কমেন্টে এই বার্তা স্পষ্টই উঠে এসেছে যে, রণবীর সিং এই ফোটোশুটের মাধ্যমে অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন এবং নতুন কিছু করতে সফল হয়েছেন।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত ‘আগুন’-এর ইমোজিতে প্রায় ঝলসে যেতে বসেছিল অভিনেতার কমেন্ট বক্স। কিন্তু এটা মুদ্রার এপিঠ। ওপিঠে অপেক্ষা ছিল ট্রোলবাহিনী। ফোটোশুটকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়া ভাসতে থাকে মিম আর ট্রোলের বন্যায়। জামা-কাপড়ের প্রসঙ্গে রণবীর সিং-কে যে প্রথমবার ট্রোলের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তেমনটাও নয়। প্রতিবারের মতো তিনি নেতিবাচক চর্চাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখাতে এবারেও পুরোদমে সফল হয়েছিলেন। দীপিকা এবং রণবীরের ঘনিষ্ট মহল থেকে এই খবরও কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছিল, রণবীরের এই পদক্ষেপ গ্রহণের সাহসিকতায় বেশ খুশি হয়েছিলেন পত্নী দীপিকা পাড়ুকোনও।
কিন্তু বিপত্তি বাধল মূলত কিছু বেসরকারি সংস্থার পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে। মুম্বইয়ের শ্যাম মাঙ্গারাম ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও অভিনেতার এই নগ্ন ছবিকে কেন্দ্র করে চেম্বুর থানায় অভিযোগ দায়ের করে। তাদের অভিযোগে জানানো হয়, অভিনেতার এহেন আচরণ ভারতীয় সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের ওপর আঘাত হেনেছে। তাদের দায়ের করা অভিযোগে লেখা হয়েছে, সম্প্রতি রণবীর সিং-এর কিছু নগ্ন ছবি ক্রমাগত ভাইরাল হয়েছে এবং ছবিগুলো যেভাবে তোলা হয়েছে, তাতে যে কোনও মহিলা বা পুরুষ এই ছবিগুলো দেখে অস্বস্তি এবং বিব্রত বোধ করবেন। অন্যদিকে আবার শহরের একজন আইনজীবী, দেবিকা চৌবে তাঁর অভিযোগে জানিয়েছেন, রণবীরের এই নগ্ন ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ার কারণে তিনি তাঁর কন্যাসন্তানদের কোনওরকম সোশ্যাল মিডিয়া, এমনকী, নিউজ পোর্টাল অবধি দেখতে নিষেধ করেন। তিনি আরও বলেছেন, দেশের মানুষ তথা ভারতীয় সংস্কারের প্রতি এঁদের মতো অভিনেতার কোনও দায়বদ্ধতা নেই। কোটি কোটি টাকা কামানোর লোভে এঁরা সমাজের সমস্ত সীমা অতিক্রম করতে পারেন। এনজিওর পক্ষ থেকে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট জানানো হয়, তারা রণবীর সিং-এর দ্রুত গ্রেফতারি চান। ইতিমধ্যেই এই অভিযোগের ভিত্তিতে চেম্বুর থানার পুলিশ রণবীর সিং-এর বিরুদ্ধে এফআইআর নথিভুক্ত করেছে।
আরও পড়ুন: আত্মহত্যা না কি…, মহুয়া রায়চৌধুরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে আজও অজস্র প্রশ্ন
বর্তমানে আমেরিকার বিখ্যাত এবং অন্যতম জনপ্রিয় ‘পেপার’ নামক একটি পত্রিকার ফোটোশুটের কারণেই রণবীর সিং একাধিক ধারায় অভিযুক্ত হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ২৯২ (অশ্লীল জিনিস প্রদর্শন), ২৩৯ (অশ্লীল বিষয় বিক্রি) এবং ৫০৯ (মহিলাদের শালীনতার অবমাননা করার উদ্দেশে অঙ্গভঙ্গি অথবা শব্দ নিক্ষেপ)-এর অধীনে মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ২০০০ এর ৬৭(এ) ধারাটিও আরোপ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, আইপিসির ২৯২ ধারায় পাঁচ বছরের এবং ২৯৩ ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি আইন ৬৭(এ)-তে অভিযুক্ত হলে অভিনেতার পাঁচ বছরের সাজাও হতে পারে।
এই সমালোচকরা কিন্তু কেবলমাত্র অভিযোগ দায়ের করেই ক্ষান্ত হননি। ইন্দোরের অন্য এক এনজিও, ‘নেকি কি দিওয়ার’, তারকার এই ছবির বিরোধিতা করেছে জামাকাপড় দানের মধ্য দিয়ে। শহরের একটি স্থানে বিশালাকার এক বক্সে অভিনেতার নগ্ন ছবি সেঁটে, সেখানে তারা জামাকাপড় দান করা শুরু করেছেন। শুধু তাই নয়, বক্সের অন্যদিকে আবার ‘মানসিক কাছড়া’ বলে কটূক্তি করতেও ছাড়েনি তারা।
রণবীর সিং বরাবরই একটু ছকভাঙা। বলিউডের অন্যান্য জনপ্রিয় অভিনেতাদের থেকে তিনি বেশ খানিকটাই আলাদা। তিনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এমন এক পুরুষ, যিনি বিয়ের পর বলেছিলেন, সিং পদবির পরিবর্তে যদি তাঁকে পাড়ুকোন পদবি রাখতে বলা হয়, তবে তাতে তাঁর যশ কিংবা খ্যাতি কোনওটাই কমবে না, বরং বাড়বে। বিশ্বজুড়ে গোলাপি এবং নীল দিয়ে লিঙ্গবিভাজনের প্রথা এখনও চালু রয়েছে, রণবীর কিন্তু কখনও সেই গোলাপি রঙের কোট কিংবা শার্ট পরতে পিছপা হননি। ঘাগরা চোলি থেকে পালাজ্জো, মহিলাদের পোশাক বলে পরিচিত পোশাক পরতেও দ্বিধা করেন না তিনি। বলিউড সাধারণ মানুষদের মনে 'পুরুষত্ব' নিয়ে যে ধারনার বুনন করে চলেছিল, এই অভিনেতা কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিডিয়ার সামনে তা ভাঙতে ভাঙতে গেছেন। দীপিকার প্রতি তাঁর ভালবাসার প্রকাশ কিংবা আলিয়ার সঙ্গে তথাকথিত মহিলাসুলভ ভাবভঙ্গিমায় কথা বলার মাধ্যমে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মনিগড়ের একপ্রকার বিরোধিতাই বারবার করেছেন তিনি।
অন্যদিকে ফিল্মস্টার মানেই যে প্রতিটা সময় টিপটপ থাকার একটা ইমেজ এত বছর ধরে বলিউড আমাদের দেখিয়েছে, সেক্ষেত্রেও রণবীর উল্টো সুর গেয়েছেন। যেখানে অন্যান্য তারকাদের সচসাচর কালো কোট-স্যুট পরে অ্যাওয়ার্ড শো-তে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়, সেখানে তিনি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো হয়তো ঢোলাঢালা আলাদিন প্যান্ট আর প্রিন্টেড টি-শার্ট পরেই চলে যান। সম্প্রতি আবার একটি অ্যাওয়ার্ড শো-তে রণবীর সিং-কে সাদা কুর্তা-পাজামা এবং নেহরু কোর্টে দেখা গেলে, সেই নিয়েও ট্রোল করা শুরু হয়। অনেকেই বলেছেন, তবে কি এফআইআর দায়ের করার ফলেই এতদিনে হুঁশ ফিরল নায়কের? অনেকে আবার অভিনেতাকে সাধারণ পোশাকে দেখে চমকে গিয়ে লেখেন, হঠাৎ করে হলো কী? তারকারাও যে সাধারণ মানুষ, এই সহজ বিষয়টি তিনি খুব সহজভাবেই হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করেন আমাদের। কিন্তু সাধারণ মানুষ হয়তো নিজেদের ধারণার ঘেরাটোপ থেকে বেড়াতে পারে না। এত বছর ধরে বলিউড তারকাদের গোটা দুনিয়ার থেকে আলাদা করে রাখার যে সচেতন প্রয়াস করেছে, সেই গণ্ডি পেরিয়ে নতুন কোনও চিন্তা আমাদের মননে সাড়া দেয় না এবং সম্ভবত সেই কারণেই রণবীরের সবকিছু নিয়েই মানুষ তাঁকে ট্রোল করে। এমনকী, দীপিকা পর্যন্ত '৮৩’ সিনেমাটির প্রোমোশনে এসে তাঁকে ট্রোল করেন এবং এছাড়াও বিভিন্ন শো-তে এসেও তাঁকে একাধিকবার স্বামীর ফ্যাশন সেন্স নিয়ে সমালোচনা করতে শোনা গেছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও রণবীর সিং নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর থেকে এক পা-ও নড়েননি।
অন্যদিকে এই বেসরকারি সংস্থাগুলিকে চরম কটাক্ষ করে উরফি জাভেদ বলেন, যেসব সংস্থাগুলি এখন মহিলাদের ভাবাবেগ নিয়ে এত কথা বলছেন, তাঁরা এতদিন কোথায় ছিলেন, যখন তাঁকে খোলামেলা পোশাক পরে ছবি পোস্ট করার কারণে বারংবার নেটিজেনদের অশ্লীল সব মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছিল! তিনি আরও বলেন, রণবীর নিজের ইচ্ছেটাকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়েছে বলেই কি বর্তমানে এনজিও-গুলির হঠাৎ করে এত সমস্যা? রণবীরের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিদ্যা বালানও।
নিশ্চয়ই নতুন ট্রেন্ড ঢেকে দেবে এই ঘটনাকে, কিন্তু রণবীর আছেন রণবীরেই।