নস্টালজিয়া না লজ্জা? কলকাতার হাতে টানা রিকশার আড়ালে রয়েছে যে কাহিনি

শহরের বিবেক মানচিত্রে এক ফোঁটা কালির দাগ এই হাতে টানা রিকশা। চুলোয় যাক ঐতিহ্য!

এক সময়ে কলকাতার গলি থেকে রাজপথ দাপিয়ে বেড়িয়েছে হাতে টানা রিকশা। বাতিল হয়েছে। কিন্তু রাস্তা থেকে পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়নি মানুষে টানা এই বাহন। এখনও এমন সময় আসেনি যে, হাতে টানা রিকশা দেখতে যেতে হবে মিউজিয়াম। কলকাতার বড়বাজার, কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া বা বৈঠকখানা বাজারের মতো জায়গায় হাতে টানা রিকশাই সওয়ারি ও পণ্য- দুইয়ের পরিবহণ চালিয়ে যাচ্ছে। বাতিল হওয়ার পরেও কেন হাতে টানা রিকশা কলকাতা রাস্তায় দেখা যায়? এ-ব্যাপারে কলকাতা পুলিশ মনে করে, মানবিকতার কারণে কোনও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। তাহলে প্রশ্ন হল, মানবিকতার কারণে কলকাতার বিবেক কি হাতে টানা রিকশায় সওয়ারি হওয়ার ছাড়পত্র দেয় নগরবাসীকে?

 

পরিবহণ দফতর জানাচ্ছে, ১৯১৯ সালে ‘ক্যালকাটা হ্যাকনি ক্যারেজ অ্যাক্ট’ চালু হয়েছিল। সেই আইনে ব্রিটিশ শাসকরা কলকাতা শহরে ঘোড়া, গরুর গাড়ি, পালকির ওপর নিয়ন্ত্রণ এনেছিল। তখন থেকেই শহরে লাইসেন্স নিয়ে হাতে টানা রিকশা চলাচলের শুরু। ২০০৬-এর আগস্টে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্বাধীনতা দিবসে এমন রিকশা তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। বাতিল করে দেওয়া হয় ১৯১৯-এর হ্যাকনি ক্যারেজ আইনও। কিন্তু তারপরেও কলকাতা থেকে উধাও হয়ে যায়নি এই রিকশা।

 


"আমি যে রিক্সাওয়ালা দিন কি এমন যাবে
বলি কি ও মাধবী তুমি কি আমার হবে…"

মাধবী তাঁর হোন বা না হোন, মোদ্দাকথা হলো, বিপন্ন শহরবাসীর কাছে বিভিন্ন সময়ে এই রিকশাওয়ালাই হয়ে উঠেছেন ত্রাতা। সেই কবে থেকে! ঝমঝম বৃষ্টি, জলমগ্ন শহর, এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে শহরবাসী, বৃষ্টি তাঁদের মাথা থেকে পা অবধি ভিজিয়ে দিচ্ছে, সেই সময় টিং টিং করতে করতে একটা কালো বড় হাতল দেওয়া বাহন সামনে এসে দাঁড়াল। বাহকের পরনে খাটো ধুতি, আর গায়ে একটা ছেঁড়া-ফাটা গেঞ্জি। সেই মুহূর্তে তিনিই ঈশ্বর হয়ে উঠলেন। শহরের ত্রাতা।

আরও পড়ুন: খাস কলকাতায় বাগানে ঘুরত জোড়া রয়‍্যাল বেঙ্গল, রইল ‘বাঘবাড়ি’-র গল্প


ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে তার আগমন এদেশে তথা কলকাতায়, পালকির ও ঘোড়ার গাড়ির বিকল্প হিসেবে। বাংলা রিকশা শব্দটি এসেছে জাপানি শব্দ জিন-রিকি-শা থেকে। জিন মানে মানুষ, রিকি মানে শক্তি আর শা হল বাহন। আভিধানিক অর্থ হল, মনুষ্যবাহিত বাহন। ধ্বনি-বিপর্যয়ে রিকশা।

 

ঠিক কে প্রথম রিকশা বানাল, তা আজও জানা যায় না। মার্কিনরা দাবি করেন, অ্যালবার্ট টোলম্যান নামে এক মার্কিন কামার মিশনারিদের জন্য ১৮৪৮ সালে প্রথম রিকশা বানান। অন্যরা বলেন, জোনাথ স্কোবি। তিনি থাকতেন জাপানের ইয়াকোহামায়। তাঁর স্ত্রী ছিলেন চলৎশক্তিহীন। স্ত্রীর সুবিধার জন্য তিনি এই রিকশা বানান। জাপানিরা অবশ্য বলেন, রিকশা আবিষ্কার করেছিলেন, ইজমু ইয়োসুকি, সুজুকি টোকুজিরো আর তাকায়ামা কোসুকি। সালটা ১৮৬৮।

 


১৮৮০ সাল নাগাদ রেভারেন্ড জে ফরডিসের হাত ধরে প্রথম সিমলার রাস্তায় হাতে টানা রিকশা দেখা গেল। এই স্থানেই ব্রিটিশরা তাঁদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী তৈরি করেছিলেন ১৮৬৪ সালে। ফলে মিশনারিদের আগমন ঘটেছিল সেই সময়ই। ভৌগোলিকভাবে চিন সিমলার থেকে খুব দূরে নয়। কাজেই চিন হয়ে রিকশা ভারতের এই প্রান্তে প্রথম ঢুকছে, এটা সহজেই অনুমেয়।

 

প্রায় তিনশো বছরের পুরনো রাজধানী শহর কলকাতার অনেক কিছুই বদলে গেছে। এর মধ্যেই বেঁচে আছে কলকাতার ঐতিহ্যরা। যেমন ট্রাম, যেমন হলুদ ট্যাক্সি, হাতে টানা রিকশা। আজও উত্তর কলকাতার অলি-গলি কিংবা রাজপথে চোখে পড়বে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি এই টানা রিকশা। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কানে বেজে চলেছে ঠুং ঠুং আওয়াজ। সেই আওয়াজের সঙ্গে কি মিলেমিশে ধ্বনিত হয় না বিবেকহীন শহরে রিকশাচালকের যন্ত্রণা? মানুষ টেনে নিয়ে যাচ্ছে মানুষকে। এর চেয়ে বিবেকহীনতার ছবি আর কী হতে পারে!


এত দিন এই হাতে টানা রিকশাচালকদের যাত্রী সংখ্যাও ছিল প্রায় হাতে গোনা। সেখানে লকডাউনের জন্য সেই যাত্রী সংখ্যাও প্রায় শূন্যে নেমে গিয়েছিল। তার ফলে পেটে টান পড়েছে হাতে টানা রিকশাচালকদের।

 

কলকাতায় রিকশার ব্যবহার শুরু হয় ১৯০০ সালের আশপাশে। কলকাতার চিনা অধিবাসীদের মধ্যেই প্রথম রিকশার ব্যবহার দেখা যায়। বউবাজার অঞ্চলের এইসমস্ত চিনা অধিবাসী মূলত কলকাতা ও খিদিরপুর ডকে খালাসির কাজ করতেন। মাল ওঠানোর সুবিধার জন্যই তাঁরা রিকশার ব্যবহার শুরু করেন। মাঝেমাঝে রাস্তায় যাত্রীদের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন তাঁরা। কলকাতার বাইরে বাংলার অন্য কোথাও রিকশার প্রচলন ছিল বলে জানা যায় না। তবে ১৯০৫ সালে বর্ধমানে নির্মীয়মান কার্জন গেটের একটি ছবির সামনে রিকশা দেখা যায়। তবে চিনা অধিবাসীদের হাত ধরে রিকশা ক্রমশ কলকাতাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৪ সালে কলকাতা পুরসভার কাছে একটি আবেদনপত্র জমা পড়ে। তাতে যাত্রী পরিবহণের জন্য রিকশার ব্যবহার শুরু করার কথা বলা হয়। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তৈরি করে 'হ্যাকনি ক্যারিজ অ্যাক্ট'। আর তারপরেই কলকাতার রাস্তায় পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেয় হাতে টানা রিকশা।

 


পরিবহণ দফতরের দাবি, নতুন করে হাতে টানা রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয় না। পুরনোদের লাইসেন্সও নবীকরণ করা হয় না। তারপরেও শহরের রাস্তায় কেন ছুটে চলেছে হাতে টানা রিকশা? পুলিশ বলছে, মানবিকতা ইস্যু। তাই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। পুনর্বাসন নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়েছে। শেষে একথা বলাই যায়, শহরের বিবেক মানচিত্রে এক ফোঁটা কালির দাগ এই হাতে টানা রিকশা। চুলোয় যাক ঐতিহ্য!

 

"বয়স বারো কি তেরো ।।
রিকশা চালাচ্ছে,
আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক ছেলেটাকে ডাকছে।…’’
সেই ডাক শুনতে পাচ্ছেন না সওয়ার বাবুটি, তাই-
"বাবুর খ্যাঁকানি শুনে সম্বিত ফিরে পায়
ছেলেটা যে করে হোক রিক্শা চালিয়ে যায়।‘’

 

এটাই কি রিকশাচালকদের কপাল লিখন? হাতে টানা রিকশা থেকে বিবর্তনের চাকা ঘুরে এসেছে প্যাডেল। তবু বিপর্যয়ের ধারাপাত বদলায়নি। আজও কলকাতায় বুকে রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্নের নাম টানা রিকশা।

More Articles