আতঙ্ক বিশ্বজুড়ে! ভয়াবহ পরমাণু যুদ্ধর সম্ভাবনা কতটা জোরালো হচ্ছে?
Nuclear war: নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে এই মুহূর্তে পুতিন পরমাণু যুদ্ধর হুমকি দিচ্ছেন।
If the radiance of a thousand suns were to burst at once into the sky, that would be like the splendour of the mighty one. Now I am become death, the destroyer of Worlds.
১৬ জুলাই, ১৯৪৫। নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে প্রথমবার পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার পর এই কথাগুলো বলেছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। পরমাণু বোমার জনক, ম্যানহাটান প্রকল্পের প্রধান। তার ঠিক কয়েক সপ্তাহ পরেই জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে তিন দিনের ব্যবধানে আছড়ে পড়ে লিটল বয় এবং ফ্যাট ম্যান। প্রায় দুই লক্ষ মানুষ বিস্ফোরণের অভিঘাতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারান, আহত হন অগণিত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তেজষ্ক্রিয়তার কারণে পঙ্গুত্বের শিকার হয়। মানবতার ইতিহাসে প্রথম এবং একমাত্র দেশ হিসেবে নাম লেখায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার পর মাত্র একবারই পৃথিবী পরমাণু যুদ্ধর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। ঠান্ডা যুদ্ধ এবং কিউবার মিসাইল সংকট পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছিল এক ভয়াবহ সংকটের দিকে। দুই রাষ্ট্রনেতা যদি সেদিন সংযত না হতেন, তাহলে আজ কোথায় দাঁড়াত পৃথিবী, কেউ জানে না। আজ, কিউবা সংকটের ছয় দশক পর পৃথিবী আবার পরমাণু যুদ্ধর মুখোমুখি। ভ্লাদিমির পুতিনের পরমাণু বোমা ব্যবহার করার হুমকি আবারও প্রশ্নের মুখে ফেলছে এই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বকে। রুশ রাষ্ট্রপতি এমন এক পথ বেছে নিতে চাইছেন, যে পথ অন্ধকারের। সেই যুদ্ধে কোনও পক্ষেরই জয় সম্ভব নয়। কিন্তু কেন তিনি এই সুরে কথা বলছেন? রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান ঠিক কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে? সেই বিষয়ে আলোচনার আগে একটু ইতিহাসের পাতা উল্টে নেওয়ার প্রয়োজন। পৃথিবীর ইতিহাসে যে একক পরমাণু বোমা নিক্ষেপের উদাহরণ রয়েছে তার কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ঠিক কোন পরিস্থিতিতে এমন কাজ করেছিল তারা? লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষের প্রাণ ওইভাবে কেড়ে নিতে একবারও হাত কাঁপেনি রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যানের?
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর প্রায় শেষ পর্যায়। ইতালির পরাজয় হয়েছে। তাদের নেতা বেনিতো মুসোলিনি জনতার দরবারে শাস্তি পেয়ে গিয়েছেন। পরাজিত হয়েছে জার্মানিও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার জন্য অন্যতম দায়ী, নাৎসি জার্মানির প্রধান অ্যাডলফ হিটলার তাঁর বাঙ্কারে আত্মঘাতী হয়েছেন। লড়াইয়ের ময়দানে টিকে রয়েছে শুধুমাত্র জাপান। অক্ষশক্তির একমাত্র প্রতিনিধি। তারা আত্মসমর্পণ করলেই শেষ হবে যুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে ভেবেছিল, খুব সহজেই তারা এই কাজ সেরে ফেলবে। কিন্তু দ্রুত তাদের এই ধারণা ভেঙে যায়। জাপানিরা নিজেদের প্রাণ খুব সহজেই দিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু পরাজয় শিকার করতে তারা রাজি ছিল না। আমেরিকা সেই সময়ে দেখে, সামরিক যুদ্ধে জাপানকে পরাজিত করে তাদের দিয়ে আত্মসমর্পণ করাতে বহু সংখ্যায় তাদের সৈন্যের প্রাণহানি হবে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে চূড়ান্ত। একই সঙ্গে ম্যানহাটান প্রকল্পের কাজও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। আমেরিকা চেয়েছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারতে। প্রথমত, তারা বহু কোটি টাকা ব্যয় করে বানানো এই বোমাকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিল, দ্বিতীয়ত, মাত্র একটি বোমার ব্যবহারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে বার্তা দিতে চেয়েছিল গোটা বিশ্বকে। বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সতর্কবার্তার পত্র খুলেও দেখেননি মার্কিন রাষ্ট্রপতি। কত নিরপরাধ মানুষের প্রাণ চলে যাবে, কত প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে, তা নিয়ে ভাবার পরিসর ছিল না ক্ষমতার দম্ভে মগ্ন হ্যারি ট্রুম্যানের। তিনি ব্যাগ্র ছিলেন লিটল বয় এবং ফ্যাট ম্যান ব্যবহারের ফলাফল দেখার জন্যে। সেই সঙ্গে গোটা বিশ্বকে দেখানো, যে পৃথিবীর অবিসংবাদী, সবথেকে শক্তিশালী দেশ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৬ এবং ৯ অগাস্ট পাল্টে যায় পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। চিরকালের জন্য।
মজার বিষয় হলো, বেশিদিন এই প্রযুক্তি নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতে পারেনি আমেরিকা। পরমাণু বোমা নির্মাণের বিজ্ঞান হাতে চলে আসে সোভিয়েত ইউনিয়নের। হিটলার যা পারেননি, তা অনায়াসে করে ফেলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচররা। পাল্টে যায় ক্ষমতার সমীকরণ। নতুন মোড় নেয় ঠান্ডা যুদ্ধ এবং বিশ্বরাজনীতি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মনে করা হয়েছিল, পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা আপাতত নেই। পরমাণু অস্ত্রের সম্প্রসারণ রোধ করার জন্য ঠান্ডা যুদ্ধর সময় থেকেই বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৯৭০ সালের Nuclear Non-Proliferation Treaty, ১৯৭২ সালের Strategic Arms Limitation Treaty এবং ১৯৯১ সালের Strategic Arms Reduction Treaty। বলাই বাহুল্য, তাতে না পরমাণু অস্ত্রের প্রসার রোধ করা গিয়েছে, না এসেছে বিশ্বশান্তি, না গেছে পৃথিবীর বুক থেকে পরমাণবিক শৈত্যের আশঙ্কা। এত কিছুর পরেও আজ পৃথিবীর নয়টি দেশ পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী। মোট ওয়ারহেড বা অস্ত্রের সংখ্যা প্রায় ১৪,০০০। এর মধ্যে সবথেকে বেশি অস্ত্র রয়েছে রাশিয়ার কাছে। সবথেকে শক্তিশালী বোমাও রয়েছে রাশিয়ার অস্ত্রাগারে। বোমার নাম জার বোম্বা, সমস্ত বোমার রাজা। তার ধ্বংস করার ক্ষমতার কাছে লিটল বয় এবং ফ্যাট ম্যান নিতান্তই শিশু। ওই বোমা যেখানে আঘাত করবে, তার ৫০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা মুহূর্তের মধ্যে ধুলোয় মিশে যাবে। চোখের পলকে ধ্বংস হয়ে যাবে একটি গোটা শহর। প্রভাব পড়বে হাজার কিলোমিটার জায়গাজুড়ে। খুব বেশি পিছিয়ে নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। তাদের অস্ত্রাগারও এতটাই বিধ্বংসী যে, তারা দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে সমস্তরকম প্রাণকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে। শুধুমাত্র রাশিয়া এবং আমেরিকার কাছে যত পরমাণু বোমা রয়েছে, তারা যদি চায়, পৃথিবীর সমস্ত বৃহৎ শহরে তারা দশটি করে বোমা নিক্ষেপ করতে পারবে। সেই বোমা পৌঁছে দেবে তাদের অত্যাধুনিক বিমান, আন্তর্মহাদেশীয় মিসাইল, ডুবোজাহাজ।
সবথেকে মজার বিষয় হলো, অনেকে ভেবেছিলেন যে, পরমাণু বোমা বিশ্বশান্তি আনবে। যদি দু'-তরফের কাছেই পরমাণু বোমার মালিকানা থাকে, তাহলে কেউই একই ওপরকে আক্রমণ করার সাহস পাবে না। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। কিন্তু যুদ্ধ একেবারে আটকানো গেছে কি? শুধুমাত্র ওই বোমার ব্যবহার হয়নি। কিন্তু নয়টি পরমাণু শক্তিধর দেশের (আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান, ইজরায়েল এবং উত্তর কোরিয়া) মধ্যে শুধুমাত্র ব্রিটেন এবং ফ্রান্স এই মুহূর্তে কোনও দেশের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নেই। তাও তারা ন্যাটোর অংশ এবং সামান্য পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেই তারাও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। উত্তর কোরিয়া কিছুদিন আগেও নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করেছে। চিন তাইওয়ান দখল করতে বদ্ধপরিকর এবং আমেরিকা জানিয়ে দিয়েছে যে, কোনও ভাবে চিন তাইওয়ান আক্রমণ করলে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করবে চিনের বিরুদ্ধে। ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের যুদ্ধ শেষ হয়নি, এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্য ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। যে-কোনও দিন গোটা অঞ্চলে আবার যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। পড়ে রইল ভারত এবং পাকিস্তান। এই বিষয় নতুন করে কিছু লেখার নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যদি পুরোদস্তুর পরমাণু যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে শুধু দুই দেশের মানুষ নয়, মৃত্যু হবে গোটা পৃথিবীর প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষের। কীভাবে? প্রথমত এই দুই দেশের জনঘনত্ব খুব বেশি। এই দুই দেশেই অনেক প্রাণহানি হবে। সেই সঙ্গে যে পরিমাণ ধোঁয়ার সৃষ্টি হবে, তা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। আসবে পারমাণবিক শৈত্য। সূর্যের আলো বহু দিনের জন্য পৃথিবীর অনেক প্রান্তে পৌঁছবে না। খাদ্যের অভাবে মারা যাবেন কোটি কোটি মানুষ। এই ঘটনা ঘটবে আমেরিকা এবং রাশিয়ার কোনও ভূমিকা ছাড়াই। সেক্ষেত্রে এই দুই দেশ পরমাণু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে কী পরিণতি, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই ঘটনাগুলি যে ঘটবে, তা কি ভ্লাদিমির পুতিন জানেন না? তা সত্ত্বেও তিনি কী কারণে এই হুমকি দিচ্ছেন? আসলে যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল একেবারেই আসেনি তাঁর জন্য। এত মাস ধরে এত বোমা বর্ষণ, এত সৈন্য পাঠিয়ে, গণধর্ষণ, গণহত্যা চালিয়েও তিনি ইউক্রেনকে বাগে আনতে পারেননি। ইউক্রেন প্রবল বিক্রমে লড়ছে, পুনর্দখল করে নিচ্ছে অনেক অঞ্চল। সম্প্রতি রাশিয়া অধিকৃত অঞ্চল ক্রাইমিয়ার এক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজও তারা উড়িয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তার। নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে এই মুহূর্তে তিনি পরমাণু যুদ্ধর হুমকি দিচ্ছেন। ব্ল্যাকমেল করছেন যাতে পশ্চিমি দেশগুলি ইউক্রেনকে সাহায্য করা থেকে পিছিয়ে আসে। রাশিয়ার ছয় হাজার পরমাণু বোমাকে তিনি নিজের বিমা হিসেবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু এই হুমকিকে হালকাভাবে কেউই নিচ্ছেন না। ইউক্রেন-সহ পশ্চিমি দেশগুলি প্রস্তুতি নিচ্ছে রুশ পরমাণু আক্রমণের। কোনও ভাবে যদি একটি মিসাইল পুতিন নিক্ষেপ করেন, তা সে যতই কম ক্ষমতার হোক, তা এক ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ন্যাটো সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে, তারা রাশিয়াকে তীব্রভাবে আক্রমণ করবে যদি এমন কোনও ঘটনা ঘটে। বলাই বাহুল্য, তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, যেখানে বিজয়ী হবে মৃত্যু।
I know not with what weapons World War III will be fought, but World War IV will be fought with sticks and stones.
-Albert Einstein