শাবল আর চেন দিয়ে মহিলাদের খুন! বর্ধমানের ত্রাস চেনম্যানের কাহিনি হার মানাবে সিনেমাকেও

Serial Killer Chainman: ব্যাগে ছিল একটি লোহার শাবল এবং একটি লোহার চেন। সেই চেনের দু'প্রান্তে বাঁধা ছিল রবার টিউব।

আশির দশকের শেষ ভাগে গোটা কলকাতা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল এক সিরিয়াল কিলার। পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে খুন করত সে, পুলিশি ফাইলে তাকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘দ্য স্টোনম্যান’। সেই স্টোনম্যানকে খুঁজে না পেলেও, ততোধিক কুখ্যাত এবং নৃশংস এক অপরাধীকে রুখতে পেরেছিল পুলিশ। খানিকটা স্টোনম্যানের মতোই এর নাম দেওয়া হয় ‘চেনম্যান’। স্টোনম্যানের মতোই তাকে নিয়েও আতঙ্ক ছড়িয়েছিল গোটা বর্ধমান জেলা জুড়ে। একের পর এক মহিলাকে ধর্ষণ করে খুন করত চেনম্যান। আজ আপনাদের শোনাব বাংলার চেনম্যান, কামারুজ্জামান সরকারের গল্প।

২০১৯ সালের মে মাসে এক ষোল বছর বয়সী কিশোরীকে ধর্ষণ করে খুন করে কামারুজ্জামান। এই খুনের খবর সামনে আসতেই নড়েচড়ে বসে পুলিশ। এটি ছিল একই মহকুমায় ৬ মাসের মধ্যে হওয়া ৬ নম্বর খুন। প্রতিক্ষেত্রেই খুনের ধরন এক। প্রথমে মহিলাদের মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করা হয় এবং এরপর সাইকেলের চেন দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। অনেক সময় লোহার রড দিয়ে মারার ফলে মহিলারা অচেতন হয়ে পড়লে তাদের ধর্ষণ করত কামারুজ্জামান। এমনকী অনেকক্ষেত্রে মৃত্যুর পরেও মহিলাদের ধর্ষণও করত সে। কেন এমন করত কামারুজ্জামান? পুলিশি জেরায় সে জানিয়েছিল, মহিলাদের প্রতি প্রবল আক্রোশ থেকেই এমন কাজ করত সে। কিন্তু এই প্রবল আক্রোশের কারণ কী? সেই সম্বন্ধে পুলিশের কাছে মুখ খোলেনি কামারুজ্জামান।

আরও পড়ুন- সন্ধের পর স্তব্ধ হয়ে যেত কলকাতা, আজও অধরা ঘাতক স্টোনম্যান

চেনম্যান কামারুজ্জামান সরকার

পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী কামারুজ্জামানের আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদে হলেও, পূর্ব বর্ধমানের সমুদ্রগড়ের সুজননগরে সে থাকত। পরিবার বলতে ছিল স্ত্রী, দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। তবে কামারুজ্জামানের পরিবারের তরফে জানানো হয়, ২০০৫ সালে বড়োয়া থানার পাঁচথুপি এলাকার এক মহিলার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। তবে এক মাসও টেকেনি সেই বিয়ে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পরে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে চরগোয়ালপাড়া এলাকার এক তরুণীকে। নিকট আত্মীয়দের মতে, প্রথম স্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ থেকেই মহিলাদের প্রতি এক প্রকার আক্রোশ জন্মে যায় কামারুজ্জামানের। তবে বাইরে থেকে দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। পাড়ায় অত্যন্ত শান্তশিষ্ট মানুষ বলেই পরিচিত ছিলেন কামারুজ্জামান। প্রতিবেশীদের দাবি, সব সময়েই পরিপাটি করা জামা-প্যান্ট পরত কামারুজ্জামান। সব সময়ই হাতে দেখা যেত ব্র্যান্ডেড ঘড়ি, পকেটে দামি সিগারেট, পায়ে দামি কোম্পানির পালিশ করা জুতো। তবে কী কাজ করত সে তা জানতেন না কেউ। তাকে শুধু সেজেগুজে মোটরবাইক নিয়ে সকালে বেরিয়ে যেতে দেখতেন বাসিন্দারা। মাঝেমধ্যে সমুদ্রগড় স্টেশন লাগোয়া বাজার এলাকা আড্ডা মারতে দেখা যেত তাকে।

২০১৯ সালের ২ জুন গ্রেপ্তার হয় কামারুজ্জামান

পুলিশি জেরায় কামারুজ্জামান জানায়, ২০১৩ সালে নিজের হাতে প্রথম খুন করে সে। যদিও এর বছর দুয়েক আগে অর্থাৎ ২০১১ সালে মোটরবাইক চুরির দায়ে জেল খাটতে হয়েছিল তাকে। মূলত দুপুরবেলায় যখন বাড়িতে পুরুষরা অনুপস্থিত, তখন খুন করতে যেত কামারুজ্জামান। কেউ সন্দেহ করলে নিজেকে বিদ্যুৎ বিভাগের লোক বলে পরিচয় দিত সে। মিটার দেখবে বলে ঘরে ঢুকত সে এবং তারপর খুন। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দু'টি খুন এবং পাঁচটি খুনের চেষ্টা করেছিল কামারুজ্জামান। তবে শেষ ৯-১০ মাসে সে একপ্রকার সিরিয়াল কিলারের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ৭ জন মহিলাকে খুন করেছিল সে। এছাড়াও আরও অনেক মহিলাকে খুনের চেষ্টা করে সে, তবে তারা পালিয়ে বেঁচে যায়। এমনই একজন মহিলার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। জ্যোতিষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল কামারুজ্জামানের। এক জ্যোতিষী তাকে বলেছিল, লাল রঙ তার জন্য শুভ। সেই জ্যোতিষীর নির্দেশেই লাল রঙের বাইক এবং লাল রঙের হেলমেট পরে ঘুরত সে। এই লাল বাইক আর লাল হেলমেটের সূত্র ধরেই তদন্ত শুরু করে পুলিশ। অবশেষে সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা মেলে চেনম্যানের। অনতিবিলম্বে সেই লাল বাইক এবং লাল হেলমেটের ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়া হয় গোটা বর্ধমানে। পুলিশি জেরায় কামারুজ্জামান জানায়, খুনের পর মহিলাদের গয়না নিয়ে পালাত সে। পুলিশের দাবি, চোরাই গয়না বিক্রি করতে গেলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ধরা পড়ারও সম্ভবনা থাকে। তাই প্রয়োজন মতো সেই গয়নাগুলি বন্ধক দিয়েই সংসার চালাত কামারুজ্জামান।

আরও পড়ুন- ৩০০ জনেরও বেশি কিশোরীকে ধর্ষণ, খুন! এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সিরিয়াল কিলার

কামারুজ্জামানের সেই লাল বাইক এবং লাল হেলমেট

অবশেষে ২০১৯ সালের ২ জুন, রবিবার বিকেলে কালনার সাধপুকুর এলাকা থেকে কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের জেরায় কামারুজ্জামান সরকার স্বীকার করে যে, সে-ই একের পর এক মহিলাকে খুন করেছে। পুলিশের অনুমান, এ দিনও নিজের ‘শিকার’ খুঁজতে যাচ্ছিল সে। গ্রেফতারির সময় কামারুজ্জামানের সঙ্গে ছিল একটি ব্যাগ। পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়, সেই ব্যাগে ছিল একটি লোহার শাবল এবং একটি লোহার চেন। সেই চেনের দু'প্রান্তে বাঁধা ছিল রবার টিউব। খুনের আগে যৌন নির্যাতন চালানো হতো বলেও দাবি করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। পুলিশের একাংশের দাবি, মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করে চেন দিয়ে আটকে রাখা হতো। হাত থেকে চেন যাতে পিছলে না যায়, সেই জন্য লাগানো ছিল রবারের টিউব।

গ্রেফতারির পর আশেপাশের পাঁচটি থানা থেকে পুলিশ আনানো হয় সাধপুকুরে। একইসঙ্গে শনাক্তকরণের জন্য ডেকে পাঠানো হয় যাঁরা হামলায় বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের। তাদের শনাক্তকরণের মাধ্যমে মামলা শুরু হয় কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে। সে অবশ্য নিজেও খুনের কথাগুলি স্বীকার করেছিল। একের পর এক নৃশংস ঘটনার প্রেক্ষিতে আগেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল সে। এই ঘটনার পর ২০২০ সালের ৬ জুলাই কামারুজ্জামানকে ফাঁসির সাজা দেয় কালনা আদালত। করোনা আবহে সেই সময় কোর্টে জমায়েতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, এই মামলার রায় শুনতে ভিড় হয়েছিল প্রচুর। স্বাভাবিকভাবেই মৃত এবং নির্যাতিতারা প্রকৃত ন্যায়বিচার পান আদালতে।

More Articles