টানা ১১ বার পথের পাঁচালী দেখেছিলাম : শ্যাম বেনেগাল

'আমার অব্যবহিত চারপাশের মধ্যে দিয়েই যে বিশাল এক পথ, জানা-অজানা নানা দিকে বিস্তৃত হয়েছে, সে বিষয়ে আমি হয়ে উঠছিলাম সজাগ এবং জিজ্ঞাসু।'

(দৃশ্য চলচ্চিত্র সংস্থার পত্রিকা ‘Drishya’-র জন্য প্রথম শ্যাম বেনেগালের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল চিত্রনাট্য বিষয়ে, ২০০৫ সালে। এর পর বিভিন্ন সময়ে, ২০২০ সাল পর্যন্ত একাধিকবার শ্যাম বেনেগালের সঙ্গে কথা বলেছেন সুদেব সিংহ। শেষবার লকডাউনের সময়, সত্যজিৎ শতবর্ষ তখন সামনে। মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা হয়েছিল এক ঘণ্টার সেই সাক্ষাৎকার। কখনো ক্যামেরায়, কখনো অন্য কোনো যন্ত্রে ধরা হয়েছে তাঁর কথামালা। এ বিষয়ে কৃতজ্ঞতা সুধীর নন্দগাঁওকর এবং অশোক রাণের প্রতি।)

প্র : আপনার জন্ম হায়দরাবাদে ১৯৩৪ সালে। দেশ যখন স্বাধীন হচ্ছে সেসময়ের কথা মনে পড়ে? আরেকটা কথা, ভাষা-ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কার্যকরী হয় ১৯৫৬ সালে। ফলে যে-হায়দরাবাদে আপনার বড় হওয়া, সেখানে তো পরিস্থিতি বেশ উত্তাল ছিল

শ্যা বে : আমার জন্ম হায়দরাবাদের কাছে, তিরুমালঘেরিতে। হায়দরাবাদ থেকে ১৫ কি.মি. দূরত্ব। আমরা যে ভাষায় কথা বলতাম সেটা দক্ষিণী কন্নড় বা কোঙ্কনিও বলা যায়। এই ভাষার কোনও লিখিত বর্ণমালা বা লিপি ছিল না। আমার বাবা শ্রীধর বেনেগাল পেশায় ছিলেন ফটোগ্রাফার। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তাঁর স্টুডিও ছিল। 16 mm hand-cranked ক্যামেরা ব্যবহার করতেন। প্রোজেক্টরও ছিল। আমরা ছয় ভাই, চার বোন। আমি বলতাম, বাড়ি নয় ক্লাব। বাবার ক্যামেরা নিয়ে বহু মজার মজার ঘটনা আছে। তবে যেটা বলতে চাই, ছোটবেলা কেটেছে খুব আনন্দে। বাবার মোটামুটি পসার ছিল। আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত ছিলাম। দেশ যখন স্বাধীন হল, সেই সময়ের কথায় আসি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী হায়দরাবাদ থেকে বিদায় নিয়েছে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৪৬-এর শেষের দিক থেকে। আমার বাবার পসার একেবারেই তলানিতে ঠেকল। পরিস্থিতি এত খারাপ হল যে, আমাদের বসতবাড়ি নিলামে চড়লো। আমার তখন ১১ বছর বয়স। আমি বুঝলাম যে আমরা খুবই গরিব। যে-বাড়িতে বসবাস করছি, সেই বাড়িই নিলাম হচ্ছে। আমার বাবার হাত প্রায় শূন্য। আমার বড়দা ততদিনে রোজগেরে হয়েছেন। তিনি থাকার ব্যবস্থা করলেন। ফলে আমাদের রাস্তায় দাঁড়াতে হল না। আর হায়দরাবাদ তখন খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দেশ স্বাধীন হলেও, হায়দরাবাদ তো নিজাম-শাসিত রাজ্য। আমরা চাইছি ভারত-রাষ্ট্রে যোগদান। সেই দাবিতে ছাত্র আন্দোলন শুরু হল। খুব অল্প বয়সে ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। লাঠির বাড়ি খেয়ে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখ ফুলিয়ে বাড়ি এসেছি।
এর পর অনেকেই জানেন, ১৯৪৮ নাগাদ শুরু হল রাজাকার আন্দোলন। মুসলিম মৌলবাদীরা চাইছে নিজামের হাত শক্তিশালী করতে। রাজাকাররা সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু করল। ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, মহিলাদের ওপর অত্যাচার এইসব আর কি। এদিকে নিজাম তেলেঙ্গানার ৯টা জেলায় হেরে গেছেন। আমরা তখন বোংলি জেলার বাসিন্দা। এই নিজামের বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিল কিন্তু কৃষক-সাধারণ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই সময় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। রাজাকারদের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। তেলেঙ্গানা আন্দোলন তখন খুবই শক্তিশালী। ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনারা নিজাম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে বাধ্য করেছে আত্মসমর্পণ করতে। এরপর অনেকটাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। মজার কথা হল, সিপিআই-এর তখন জনযুদ্ধের লাইন। ভারতীয় সেনারা কৃষক-শ্রমিকের প্রতিনিধি নয়, ফলে তারা ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গেও লড়তে চাইল। তবে ক্রমশ জনজীবন স্বাভাবিক হচ্ছিল। অল্প বিস্তর প্রতিরোধের পর জনযোদ্ধারাও পিছু হটলেন। আমরাও কিছুটা থিতু হলাম।

প্র : কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন অবস্থান কি এখন কিঞ্চিৎ হাস্যকর মনে হয়?

শ্যা বে : ওই জনযোদ্ধারা ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে এইটা ভাবলে অবাক লাগে। তবে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিপ্লবীরাও সর্বদা সংগঠিত লড়াই চালিয়েছেন এমনটাও তো বলা যাবে না। সেই সময়ে সিপিআই-এর সাংস্কৃতিক শাখা দারুণ শক্তিশালী ছিল। তাঁরা উদ্যোগ নিতেন নিয়মিত ফিল্ম স্ক্রিনিং-এর। তাঁদের সৌজন্যেই ‘Childhood of Maxim Gorky’, ‘Battle of Stalingrad’, ‘Fall of Berlin’ এইসব ছবি দেখেছি। এছাড়া, এলিয়া কাজান-এর ‘On the Waterfront’, জন ফোর্ড, হওয়ার্ড হকস্‌ প্রমুখের ছবিও দেখেছি এঁদের জন্য। গোর্কি, চেকভ, তলস্তয়, মায়াকোভস্কি – এঁদের বইও তাঁরা বিক্রি করতেন খুব কম দামে।
আমাদের বাড়িতে আবার রাজনৈতিক পরিবেশটা ছিল খুবই বর্ণময়। আমার বাবা ছিলেন গান্ধীবাদী। তিনি ১৯১৬ থেকে ১৯২০-২১ পর্যন্ত দিল্লিতে কাটিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর যোগাযোগ হয় অ্যানি বেসান্ত, আসফ আলি প্রমুখের সঙ্গে। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছিলেন আমার বাবা। আমার বাবা-মায়ের বিবাহ হয় ১৯২০ নাগাদ। আমার মা সরস্বতী দেবীর বয়স তখন ১৪ হবে। আমার মাতামহ এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমার বড়দা একেবারে মার্ক্সবাদী এবং কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর পরের ভাই আবার আরএসএস-এর সমর্থক। আরএসএস-কে তো দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল বলতেই হবে। এঁদের শাখাগুলিতে হিন্দু মৌলবাদের বীজ ছড়িয়েছিল। যাই হোক, আমাদের বাড়িতে রাতের খাবার টেবিলে শুরু হত তর্কাতর্কি। বাবার সঙ্গে লেগে যেত দুই দাদার। আবার, আমার কলকাতা-ফেরৎ মার্ক্সবাদী দাদার সঙ্গে আরএসএস-পন্থী দাদার তর্ক চলত মধ্যরাত পর্যন্ত।

প্র : আপনি নিজে কি রাজনীতির দিকে গিয়েছিলেন?

শ্যা বে : ঠিক সেভাবে নয়। তবে একটু বড় হয়ে আমি কিন্তু খানিকটা নেহরুভিয়ান হয়েছিলাম বলা যায়। একবার এক যুব সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলেন পণ্ডিত নেহরু। ১৯৪৯-৫০ সাল সম্ভবত। আশ্চর্যের বিষয়, সেদিনের বক্তব্য ছিল প্রধানত সিনেমা নিয়ে। মোটেও সেই সভার পূর্বনির্ধারিত এজেন্ডা সিনেমা-বিষয়ক ছিল না। যেহেতু শ্রোতাদের মধ্যে বড় সংখ্যায় তরুণরা উপস্থিত ছিলেন, নেহরু বেছে নিলেন সিনেমা বিষয়টিকে। আধুনিক এই মাধ্যমের অগাধ শিল্প-সম্ভাবনার দিক নিয়ে আলোচনা করছিলেন এবং বেশ প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়েও বলছিলেন। তিনি যে আইজেন্‌স্টাইন, পুদভকিন এঁদের ছবি দেখেছেন সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল। ‘Battleship Potemkin’ নিয়েও বলেছিলেন। সেসময়ের রাজনীতির মানুষজন দলীয় প্রচারে সবসময় পথে বেরিয়ে পড়তেন এমনটা ভাবলে ভুল হবে। তাঁরা নিজেদের বিশ্ববীক্ষা মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার বিষয়েও যথেষ্ট মনযোগী ছিলেন। আমি ইতিমধ্যে ‘Letters from a Father to a Daughter’ এবং ‘Glimpses of World History’ পড়ছি। ‘Glimpses…’ কিন্তু আমাকে অনেকটাই পরিণত করে তুলেছিল। আমার অব্যবহিত চারপাশের মধ্যে দিয়েই যে বিশাল এক পথ, জানা-অজানা নানা দিকে বিস্তৃত হয়েছে, সেবিষয়ে আমি হয়ে উঠছিলাম সজাগ এবং জিজ্ঞাসু। আজকের টিভি বা প্রযুক্তি-নির্ভর যে প্রজন্ম তারা দেশ-বিদেশের নানা image দেখার সুযোগ পায়। তবে সেটা তাদের বিশ্ব-জিজ্ঞাসায় কীভাবে বা কতটা প্রণোদিত করে এ-নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। ওই অল্প বয়সে ‘Glimpses of World History’ বইটা কিন্তু আমাকে একটা বিশ্বজনীন পরিসরের কথা ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমাদের আরেক নিকট-আত্মীয় ছিলেন সুভাষচন্দ্রের অনুগামী। সুভাষচন্দ্র যখন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করলেন, আমার এই আত্মীয় তখন ফরওয়ার্ড ব্লক-এ যোগ দেন। তিনি হায়দরাবাদে আসতেন, দেশি অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে বেঁধে ছেঁদে রওনা দিতেন কলকাতা। আমার বড়দা (তাঁর নাম সুদর্শন) তখন কলকাতাবাসী এবং রীতিমতো জড়িয়ে পড়েছেন বামপন্থী আন্দোলনে। ফলে, সব মিলিয়ে আমার ওপর দিয়ে একের পর এক ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। সুভাষচন্দ্রের বীরত্ব অকল্পনীয়। তবে বোধহয় একটু individualist। নেহরুর ওই ইংরেজি লেখা আমাকে সাংঘাতিক প্রভাবিত করেছিল। সেই সময় একটা ভাবনা জোরালো ছিল যে, ভালো ইংরেজি লিখতে হবে। ওই যে বলে না, clipped, sharp sort of an articulation?

আরও পড়ুন-এদেশের বিকল্প ইতিহাসকে সিনেমার ফ্রেমে ধরতে চেয়েছিলেন শ্যাম বেনেগাল

গুরু দত্ত আমাদের পারিবারিক আত্মীয় ছিলেন। তিনি এসে আমাদের বাড়িতে বেশ কিছু দিন থেকেও যেতেন। আমরা তখন বিমল রায়, গুরু দত্ত, মেহবুব এঁদের চিনতাম ভারতীয় চিত্রনির্মাতা হিসেবে। আমার বাবার সংগ্রহে ছিল বাস্টার কিটন, লরেল অ্যান্ড হার্ডি এবং কিছু চ্যাপলিনও। আমার আরেক দাদা সদানন্দ, সেও ছিল সিনেমার ভক্ত। আমরা একসঙ্গে ‘Return of Frankenstein’, ‘Green Years’, ‘How Green Was My Valley’, ‘Rebecca’ এইসব ছবি দেখছি। সেই সঙ্গে দেখছি ‘A Tale of Two Cities’। ক্রমশ ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলিয়ান সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ল। আমার বড়দা তখন Penguin Film Review নিয়ে আসতেন কলকাতা থেকে। পরবর্তীকালে এই পত্রিকাই কিন্তু ‘Sight and Sound’ নামে পরিচিত হবে। আমার হাতে আজেন্‌স্টাইন ঈবং পুদভকিনের লেখা এসে পৌঁছল। এসবই কলকাতা মারফৎ। ইতিমধ্যে আমি ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ পড়ছি। সেখানে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে রীতিমতো যুক্ত হলাম। দেশ-বিদেশের সাহিত্য পড়ছি। চার্লস্‌ ডিকেন্স, মপাসাঁ, হেনরি জেমস্‌, তলস্তয় এরকম অনেক নাম বলা যায়।

প্র : ফিল্ম সোসাইটি এবং কলকাতার কথা যখন উঠল, আপনার ‘পথের পাঁচালী’ দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটু যদি বলেন...

শ্যা বে : এখানে বলি, আমি খুব ভালো সাঁতারু ছিলাম। এক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছিলাম কলকাতায়। আমার কাকা কে.কে. বেনেগলের কলকাতায় ফটোগ্রাফির দোকান ছিল। তিনিও ছিলেন পেশাদার ফটোগ্রাফার। আর তাঁর দোকানটা ছিল ধর্মতলায়, কলকাতা কর্পোরেশনের মেন বিল্ডিং-এর একেবারে পাশে। ওখান থেকে হাঁটা পথে যাওয়া যেত জ্যোতি সিনেমা হল-এ। আমার কাকার সঙ্গে কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি করা মানুষজনের যোগাযোগ ছিল। আমার কাকা তাঁদের কাছে শুনেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটির কথা। তখন সদ্য মুক্তি পেয়েছে। সত্যজিৎ রায় নামটিও জেনেছিলেন কাকা। তিনি আমাকে খুব জোর দিয়ে বললেন, এই ছবিটি অবশ্যই দেখো, এটা মিস করা will be kind of a sin। আমি জ্যোতি সিনেমা হল-এ ছবিটি দেখলাম। কীরকম একটা আবিষ্ট হয়ে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে, কাকার দোকানে গিয়ে একটু বসতাম, তার পরে কলকাতা কর্পোরেশনের কাছ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জ্যোতি সিনেমা হল। আমি বোধহয় টানা ১১বার ছবিটা দেখেছিলাম। আমার মনে হয় আরও বেশি। কারণ প্রথম দিনই তো পরপর দুটো শো। সে এক নাওয়া-খাওয়া ভোলা অবস্থা। এই ছবি দেখার পর আমি এক অর্থে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমরা তখন হায়দরাবাদে সকালে ফিল্ম দেখাই। আমি সত্যজিৎ রায়কে চিঠি লিখলাম তাঁর ছবি পাঠানোর জন্য এবং যেসব ছবি জোগাড় করে আমরা দেখাতে পারি সেবিষয়েও তাঁর পরামর্শ চাইলাম। সত্যজিৎ রায় ততদিনে ‘অপরাজিত’ এবং ‘পরশ পাথর’ নির্মাণ করেছেন। তখন Federation of Film Societies খুব সক্রিয় ছিল। আমরা সত্যজিৎ রায়ের ফিল্ম ছাড়াও ‘Ivan the Terrible’ (দুটো পর্ব) দেখিয়েছিলাম। আর যতদূর মনে পড়ছে, ‘Miracle in Milan’ এবং ‘Bicycle Thieves’।

প্র : একটা ছোট প্রশ্ন করব। কলকাতায় যখন ছিলেন, দেশভাগের কোনও কোনও চিহ্ন চোখে পড়েছিল কি?

শ্যা বে : খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছ। আমার এক কাকা দিনকর রাও থাকতেন তৎকালীন বার্মায়। জাপানি অবরোধের সময়ে তিনি সেখানে আটকে পড়েন। আমার সেই কাকা তাঁর মাকে নিয়ে রেংগুন থেকে পায়ে হেঁটে কলকাতা যাত্রা করলেন। তিনি যখন কলকাতায় পৌঁছলেন, তাঁর অবস্থা ভয়ংকর। তাঁর মায়ের শারীরিক অবস্থাও শোচনীয়। এঁর অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেশভাগের পরিস্থিতি অনেকটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। আমার এই আত্মীয়ের প্রভাব আমার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সিনেমার বিষয়ে কিছুটা রক্ষণশীল ছিলেন, কিন্তু সাহিত্যের বিষয়ে খুবই উদার। মহাকাশ বিজ্ঞানেও এঁর গভীর উৎসাহ ছিল। সেই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মহাকাশ বিষয়ক ছোট ছোট বই এদেশে আসত। আমার এই কাকা এইসব বই আমার নাগালে এনে দিয়েছেন। বহু নাম-না-জানা রাশিয়ান লেখকদের বইও তাঁর সূত্রে হাতে এসেছে। তিনি ছিলেন ফরাসি সাহিত্যের ভক্ত। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা তিনি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। এর পর রাশিয়ান বইয়ের দেখা পেলাম বম্বেতে ভুলাভাই দেশাই মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটে।

প্র : ভুলাভাই দেশাই মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটের কথা উঠল যখন, সেই সূত্রে জিজ্ঞাসা করি, সেই সময়ের নাট্যজনদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কি আপনার এখানেই? এঁদের অনেকেই তো আপনার ছবির নেপথ্য কারিগর হয়ে উঠবেন।

শ্যা বে : আমার এক বন্ধুর ভাই রেলে কাজ করত। তাঁর সাহায্যে অর্ধেক দামের টিকিট কেটে বম্বে যাত্রা করলাম ১৯৫৮-এর একেবারে শেষের দিকে। এর আগে ১৯৫৬ সালেও একবার বম্বেতে ছিলাম বেশ কিছু দিন। আমার এক বন্ধুর যোগাযোগে এক বিজ্ঞাপন সংস্থায় কপিরাইটারের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম। খুব সামান্য মাইনে। তার ওপর Vicks Vaporub ঘাড়ে করে প্লেনে চড়ে অসমের জোড়হাট যেতে হয়েছিল। সেখান থেকে আর্মি কনভয়ে কোহিমা পর্যন্ত। হতে হয়েছিল গুলিচালনার মুখোমুখিও। আমার সাথে আলাপ হয় এ.এম ফিজো-র। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। Nation-building-এর সেই যুগে উত্তরপূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নানা প্রসঙ্গও জেনেছিলাম এঁর কাছ থেকে। এটা একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। এরপর আমি বোম্বাইয়ে একটি বড় বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরি পেয়ে চলে আসি। যেমনটা বললাম, ১৯৫৮-এর শেষের দিকে। প্রথম দিকে আমার আলাপ হয় সত্যদেব দুবের সঙ্গে। ও তখন ইব্রাহিম আলকাজির সহকারী নির্দেশক। দুবে বিলাসপুরের ছেলে। আলকাজি RADA থেকে পড়াশোনা করে ফিরেছেন। দুবেও বম্বের সেন্ট জেভিয়ার’স্‌ থেকে পড়াশোনা করেছে। সেখানে ওর বন্ধু হয়েছে বিজয় ‘গোল্ডি’ আনন্দ। সেই সময় দুবে J.B. Prestley-র ‘Time and the Conways’ অবলম্বনে ‘থোড়ি দের পেহলে থোড়ি দের বাদ’ প্রযোজনা করছে। ও আলকাজির ‘থিয়েটার ইউনিট’ দলেরই সক্রিয় নাট্যকর্মী। ইতিমধ্যে আমি তেন্ডুলকরের নাটক দেখারও সুযোগ পেলাম। ইতিমধ্যে গিরিশ কারনাডের সঙ্গে আলাপ। গিরিশ Rhodes scholar, অক্সফোর্ডে পড়েছে। বিদেশে যাওয়ার আগেই রচনা করেছে ‘যযাতি’। আমি অল্পবিস্তর কবিতা লিখতাম ইংরেজিতে। আলকাজিকে দেখাতাম। হাবিব সাহাব তখন দিল্লির ওখলা শিল্পাঞ্চলে থিয়েটার নিয়ে জোরালো কাজ শুরু করেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন এম.এস সথ্যু। কুদসিয়া জইদি কাজ করছেন হাবিবের সঙ্গে। এঁর কন্যা সামা জইদি। ভুলাভাই ইন্সটিটিউটে তখন বম্বে প্রোগ্রেসিভ গ্রুপের হুসেন, গায়তোন্ডেরা কাজ করছেন। আর রয়েছেন নতুন থিয়েটার নিয়ে চিন্তা করা মানুষজন। আলকাজি আমাদের জন্যে পশ্চিম দিগন্ত উজাড় করে দিয়েছেন। চেকভ, জঁ আন্যুই, ইবসেন, লোরকা, স্ট্রিন্ডবার্গ – আরও কত। তেন্ডুলকর, কারনাড, বাদল সরকার এঁরা নতুন নাটকের রচয়িতা। সত্যদেব দুবে দেশ-বিদেশের নাটক পড়ে, কুস্তি লড়ে। গিরিশের উৎসাহ আবার বক্সিং-এ। এইসব বিচিত্রের দূতরা ক্রমশ আমাকে ঘিরে ফেলবেন। আমার কাহিনিচিত্র ‘অঙ্কুর’-এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলেন সত্যদেব দুবে। পরে আমি কাজ করলাম তেন্ডুলকর, কারনাড এঁদের নিয়েও। Parallel Cinema নামটা আমি পছন্দ করি না। বরং New Cinema বা Alternative Cinema বললে ভালো শোনায়। এই সিনেমায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল Modern Indian Stage। এর মধ্যে রয়েছে মারাঠি, কন্নড়, বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষার থিয়েটার।

More Articles