এদেশের বিকল্প ইতিহাসকে সিনেমার ফ্রেমে ধরতে চেয়েছিলেন শ্যাম বেনেগাল
Shyam Benegal: শ্যাম বেনেগল খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করছিলেন অন্য ভারতবর্ষকে। দারিদ্রপীড়িত যে দেশে কিছু মাইল পথ পেরোলেই ভাষাই শুধু বদলায় না, বদলে নিতে হয় আখ্যানবিন্যাসের যাবতীয় কৃতকৌশল
বাঙালিরা সৌজন্য বজায় রেখে নামের সঙ্গে জুড়ে দেন ‘বাবু’ শব্দটা— অমলবাবু, কমলবাবু ইত্যাদি। বম্বেতে কিছু কাজকর্ম করার সুযোগ ঘটলে অনেকেই জেনে যাবেন ‘বাবু’ শব্দের মহিমা। উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত স্বল্পসংখ্যক মানুষজনকেই বাবু বলা হয়। বিশেষত থিয়েটারের জগৎ এবং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। শ্যাম বেনেগল (১৪ ডিসেম্বর ১৯৩৪ – ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪) ভারতীয় সিনেমা জগতে শ্যামবাবু নামেই অধিক পরিচিত। কিছুদিন আগেই এই প্রতিবেদক নিবেদন করেছিল ভুলাভাই ইন্সটিটিউট নিয়ে এক গদ্যলেখা। এই সংস্কৃতিকেন্দ্র এবং গ্রন্থাগার বিষয়ে বলতে গিয়ে শ্যাম বেনেগল জানিয়েছেন, ইব্রাহিম আলকাজি ছিলেন পশ্চিম ভারতের নাট্যভুবনের নীল দিগন্ত। বেনেগল সেই সময় কবিতা রচনা করতেন। সুযোগ পেলেই আলকাজিকে শোনাতেন নিজের কবিতা। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন বম্বেতে আসেন শ্যাম এবং ভুলাভাই ইন্সটিটিউট হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। পিডি শেনয় শুরু করেছিলেন শেক্সপিয়র পাঠচক্র। সত্যদেব দুবের মতো অনেকেই জুটে গেলেন শেক্সপিয়র-চর্চায়। গিরিশ কারনাডের সঙ্গে সত্যদেব দুবের যখন দেখা, তখন দুবে করছেন ‘খেয়ালোঁ কে দস্তক’। ইতিমধ্যে চেকভ-আধারিত ‘প্রস্তাব’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। শ্যাম বেনেগল তখন কাজ করেন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় কপিরাইটার হিসেবে। তিনি তখন ছুটে যাচ্ছেন সারস্বত চর্চার প্রণোদনায়। আলকাজির নাটক, পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতার, এমএফ হুসেন, গায়তোন্ডের চিত্রকলা। ইতিমধ্যে মার্কিন নৃত্যশিল্পী মার্থা গ্রাহাম এলেন বম্বেতে এবং যোগ দিলেন ভুলাভাই সেন্টারে।
শ্যাম বেনেগলের জন্ম অবশ্য অবিভক্ত হায়দরাবাদ রাজ্যের তিরুমালাগিরিতে। শ্যামসুন্দর বেনেগলের পড়াশোনা অর্থনীতি নিয়ে। গুরু দত্তের পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক। হায়দরাবাদে থাকাকালীন ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছে, সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত প্রমুখরা শুরু করেছিলেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। বম্বেতেও কাছাকাছি সময়ে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন গড়ে উঠছে। শ্যাম বেনেগল ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের আবর্তে এলেও, থিয়েটারই হয়ে ওঠে তাঁর অন্যতম অবলম্বন। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, তাঁর ছবি নির্মাণের পর্বেও থিয়েটারের মানুষজন ঢুকে পড়বেন হুড়মুড়িয়ে। শ্যাম তখন ভাবছেন egalitarianism-এর কথা, সামাজিক ন্যায়ের কথা। কারণ, তিনি সেলুলয়ডে ধরে রাখতে চাইছেন এদেশের বিকল্প ইতিহাস। সেই ইতিহাসের উত্থান-পতনের মুহূর্তগুলোকে মূর্ত করতে চাইছেন। ১৯৭৪-এ নির্মিত তাঁর প্রথম কাহিনিচিত্র ‘অঙ্কুর’-এর চিত্রনাট্য করতে এলেন সত্যদেব দুবে। ভুলাভাই দেশাই ইন্সটিটিউট— সেই কেন্দ্রকে ঘিরে নাট্যজনেরা পাশে দাঁড়ালেন শ্যামবাবুর। সাধু মেহের, শাবানা আজমি, অনন্ত নাগ, প্রিয়া তেন্ডুলকর- সকলেই কমবেশি থিয়েটারের। তাঁর ছবিতে থিয়েটারের মানুষজনের আনাগোনা নিয়ে তাঁকে একাধিক প্রশ্ন করেছে এই প্রতিবেদক। বেনেগল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে, একটু ওপরের দিকে তাকিয়ে বলছেন— সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ ১৯৫৬-তে আর ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’ ১৯৫৮ সালে। এই দুটো বছরকে তাঁর মনে হয়েছে ভারতীয় সিনেমায় আদিকল্পের পরিবর্তন। অন্যদিকে ১৯৫৫ সালে ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনা ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন সূর্যোদয়ের বিভা। শ্যাম বেনেগলের দ্বিতীয় ছবি ১৯৭৫-এ ‘চরণদাস চোর’। এই নাট্যের বিশ্বজনীন পরিগ্রহণ বেনেগলকে ফের নিকটস্থ করছে মঞ্চের। হাবিব সাহাবকে অন্যতম প্রধান চরিত্রে রেখেই Children’s Film Society-র জন্য ছবিটি তোলা হলো। ওই বছরই আরেকটি ছবি, ‘নিশান্ত’। এই ছবির চিত্রনাট্যকার বিজয় তেন্ডুলকর, সংলাপনির্বাহী সেই সত্যদেব দুবে।
আরও পড়ুন- বাংলা সিনেমা: যেটুকু যা ছিল, আছে, থাকবে
শ্যাম বেনেগল খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করছিলেন অন্য ভারতবর্ষকে। দারিদ্রপীড়িত যে দেশে কিছু মাইল পথ পেরোলেই ভাষাই শুধু বদলায় না, বদলে নিতে হয় আখ্যানবিন্যাসের যাবতীয় কৃতকৌশল। তেলেঙ্গানা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ বিস্তার দক্ষিণ ভারতের নানা জায়গায়। তেলেঙ্গানায় তো কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। এই প্রতিবেদককে শ্যামবাবু জানিয়েছিলেন, তিনি কেবল ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনেই সরাসরি যুক্ত হয়েছেন। আর তাঁর চতুর্দিকের আগাপাশতলা খুঁটিয়ে দেখেছেন। লিখে রেখেছেন নোটবুকে। জনজীবনের ভাষ্য রচনায় তাঁকে প্রায়শই বেছে নিতে হয়েছে সেই সময়ের নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের – যেমন শাবানা আজমি, স্মিতা পাটিল, নাসিরুদ্দিন শাহ, অনন্ত নাগ, সাধু মেহের, অমল পালেকর এবং গিরিশ কারনাডকেও।
১৯৮৮ সালের অক্টোবরে লন্ডনের ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটারে বেনেগল বলেন—
"জাতিব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অসাম্য, সামাজিক নিপীড়নের মতো বিষয়গুলিকে আমি দেখার চেষ্টা করেছি জটিলতার বিন্যাসে। বহুস্তরীয় অবস্থানকে বুঝতে চেয়ে আমার যাবতীয় প্রচেষ্টা। উচ্চকিত কোনও উচ্চারণ আমার কাজের অংশ নয়। একদিকে দারিদ্র-জর্জরিত আমার দেশকে শ্রেণিগত অবস্থান থেকে দেখেছি, আবার ক্যামেরা কখনও নিজের দিকেও ঘুরিয়ে দিয়েছি। বিষয় বিষয়ীর মাঝখানে দাঁড় করিয়েছি নিজেকে। অব্যবহিত পরিপার্শ্বের সঙ্গে আমার সম্পর্ককে বুঝতে চেয়েছি জটিল বুননের বাধা পার করে।"
কখনও নিজেকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘conductor of an orchestra’, কিন্তু এক গণতান্ত্রিক পরিসরে। আধুনিকতার বহুমাত্রিক জটিলতাকে ধরতে চেয়েছেন ক্যামেরায়। সেই জন্যই লিখন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাঁর কাছে। ১৯৭৪-এ তাঁর প্রথম কাহিনিচিত্র। এই সময় জুড়ে আধুনিক ভারতীয় রঙ্গমঞ্চ সাক্ষী থাকছে নানাবিধ উন্মোচনের। বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬৪-এ। বিজয় তেন্ডুলকরের ‘শান্তাতা! কোর্ট চালু আহে’ এবং ‘ঘাসিরাম কোতওয়াল’ দুটোই ১৯৭২-এ। এর এক বছর আগে গিরিশ কারনাড রচনা করেছেন প্রহেলিকার আদলে ‘হয়বদন’। প্রশ্ন ছিল— "আপনি নিজে পেশায় ছিলেন কপিরাইটার, ‘মন্থন’-এর কাহিনিকার আপনি, অথচ চিত্রনাট্য লিখতে এলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ লেখকরা?" শ্যামবাবু এর উত্তরে জানান, "তখন বাস্তবিকই আগুনের আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল। ১৯৬২-তে চিন-ভারত যুদ্ধ, ৬৪-তে পণ্ডিত নেহরুর মৃত্যু। স্বাধীনতার পর দুই দশক অতিক্রান্ত। ৬৭-র নকশালবাড়ি। ৬৮-তে প্যারিসে ছাত্র বিদ্রোহ। সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি আক্রমণ আমাদের আকাশপাতাল এক করে দিয়েছে। রোজকার কাজে যাচ্ছি, কাজ করছি, চেষ্টা করছি নিজেদের কিছুটা সরিয়ে রাখতে। কিন্তু কখন যেন স্ফুলিঙ্গের আঁচে দগ্ধ হচ্ছে আমাদের তর্জনী।
তেন্ডুলকরের নাটক মধ্যবিত্ত সমাজে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধকে প্রায় উৎপাটন করতে চাইছে। ধরা যাক ‘সখারাম বাইন্ডার’-এর সেই সংলাপ— ‘বিবাহিতেরা পারমিট সহযোগে ঘরের অন্দরে রাঁড় পোষে’। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ প্রশ্নের মুখে। সেই আন্দোলিত সময়ের অভিঘাতকে ধরতে চাইছিলেন বিজয় তেন্ডুলকর, গিরিশ কারনাড, বাদল সরকার, সত্যদেব দুবে প্রমুখ। ‘ঘাসিরাম কোতওয়াল’ প্রযোজনা নিয়ে তো ধুন্ধুমার পরিস্থিতি। বম্বেতে দু'টি রাজনৈতিক দল ফতোয়া জারি করল এই প্রযোজনার বিরুদ্ধে। পুণের ব্রাহ্মণ সমাজও ক্ষিপ্ত। তৎকালীন সরকারকে গোটা প্রযোজনা সরিয়ে নিয়ে যেতে হলো নিরাপদ স্থানে। অন্যদিকে বাংলায়, বাদল সরকার তো প্রসেনিয়াম ছেড়ে এসে দাঁড়ালেন গণমঞ্চে। আমার ছবিতেও সংলাপ লিখতে এলেন কইফি আজমির মতো শ্রুতকীর্তি কবি। ভার্গিস কুরিয়েনের Milk Cooperative-এর এক অঞ্চলের কাহিনি নিয়ে গড়ে উঠল ‘মন্থন’। ডঃ কুরিয়েনের সঙ্গে তেন্ডুলকর চলে গেলেন গ্রাম থেকে গ্রামে। ১৯৮৩ সালের ৫ মে, আমাকে লেখা এক চিঠিতে তেন্ডুলকর জানাচ্ছেন— টেপ রেকর্ডার হাতে নিয়ে এ-গ্রাম ও-গ্রাম ঘুরছি। তেন্ডুলকরের সেই চিঠির কথা এখনও মনে পড়ে।"
শ্যামবাবু চিত্রনাট্য লিখতেন ইংরেজিতে। ক্রমশ তাঁর মনে হলো, বিজ্ঞাপনী ছবি বা তথ্যচিত্রের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা কার্যকরী হলেও এহেন পরিস্থিতিতে সম্ভব নয় ইংরেজি শব্দমালার প্রয়োগ। মানুষের মুখের ভাষাকে তখন শ্যামবাবু নিয়ে আসতে চাইছেন তাঁর চিত্রনাট্যে। স্তরে স্তরে বিন্যস্ত মানুষের বিচিত্র জীবনছবিকে তাঁদের ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে কীভাবে সম্ভব হবে বিকল্প ইতিহাস রচনা! তাই নাটকের কাছে যেতে হয়েছে তাঁকে বারবার।
আরও পড়ুন- তিতুমীর : পরিচিতির বিষণ্ণতা, সময়হারা সংশয়
বিজয় তেন্ডুলকর এসময় এক গদ্যরচনায় লিখছেন— "থিয়েটার নিঃসন্দেহে একটি ভিজুয়াল মাধ্যম। আবার সংলাপও শ্রবণকে ক্রমাগত উজ্জীবিত করে বা ক্রুদ্ধ করে। চরিত্রায়ন এবং সংলাপের ব্যাপ্তি কোনও অংশে কম নয়। এখানে বিগ ক্লোজ-আপ নেই, কিন্তু জীবন্ত চরিত্রের আনাগোনার আবেদন বহুমাত্রিক এবং তীব্র।"
এরপরেই শ্যাম বেনেগল এসে পড়বেন ‘ভূমিকা’ ছবিতে। জরুরি অবস্থা পার করতে হয়েছে। Film Finance Corporation-কে সমালোচিত হতে হয়েছে ‘আর্টহাউস’-ঘেঁষা সিনেমার প্রতি পক্ষপাতের জন্য। ‘ভূমিকা’-তে শ্যামবাবু কাজ করলেন সিনেমার মধ্যে সিনেমা নির্মাণে। নৃত্যশিল্পী ঊষাকে (স্মিতা পাটিল) দেখা গেল তামাশায় অভিনয় করতে। নানারকম যৌন ইঙ্গিতবাহী দেহভঙ্গিমার সঙ্গে গান – ‘মেরা চিথিলা বালম না আয়া’। বম্বে সিনেমার স্টুডিও পরিবেশকে উপস্থাপন করতে অসাধারণ সেট নির্মাণ করা হলো। ক্রমশ ঊষা চলে যায় সিনেমা জগতে। তার স্বামীর (অমল পালেকর) প্রয়োজন আরও অর্থের। এই ছবিতে ফিরে এল পুরাণকাহিনি, নাচ, গান প্রভৃতি। পার্সি থিয়েটার, কোম্পানি নাটকের স্মৃতিমালাকে ধরে রাখে এই ছবি।
এই প্রতিবেদককে শ্যাম বেনেগল জানান, এই ছবিটা যতটা তাঁর, তার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি গিরিশ কারনাডের। কোম্পানি নাটকের ধারা, পার্সি থিয়েটার, তামাশা, নাচা প্রভৃতির আদলে সিনেমার এক একটি গান রূপায়িত হয়। গিরিশ ভেবেছিলেন, এই নৃত্যগীতের ধারা ভারতীয় সিনেমা থেকে বহিষ্কার করা আর সম্ভব নয়। বরং সিনেমাই যদি ধরে রাখে সময়ের স্মৃতিমালাকে, আঙ্গিকের বিন্যাসকে, সেক্ষেত্রে নতুন এক সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। পার্সি থিয়েটারে একসময় অভিনয় করেছিলেন সুর-সম্রাজ্ঞী বেগম আখতারও। সেই দিন থেকে ঊষার সময়কাল পর্যন্ত public woman psyche-র এক ইতিহাস রচনাও সম্ভব হলো বেনেগলের এই ছবিতে। সংসারের জন্য অভিনয় করে উপার্জন, অথচ পেশার জন্য সমাজে প্রান্তিক অবস্থান ঊষার। জটিল এই আবর্ত সৃষ্টি হয় ‘ভূমিকা’-তে।
আরও পড়ুন- সিনেমার কৌমার্যব্রত: কুমার সাহানি
এর পর ‘অনুগ্রহম’। চিন্তামণি ত্রম্বক খানোলকরের উপন্যাস অবলম্বনে চিত্রনাট্যে অংশগ্রহণ করেন গিরিশ কারনাড পুনর্বার। লক্ষ্য করার বিষয়, খানোলকর কথাশিল্পী হয়েও নাটক রচনার জন্য সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। ভারতবর্ষের বিবিধতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকায়ত উদযাপনে, পালা-পার্বণ কিংবা বৈবাহিক অনুষ্ঠানে। এই performative tradition-এর কাছে বেনেগল বারবার ফিরবেন পরবর্তী সময়েও। ‘মান্ডি’, ‘সরদারি বেগম’, ‘জুবেদা’ প্রভৃতি ছবিতেও সদর-অন্দরের আলো-অন্ধকার মিশে সৃষ্টি করে নতুন চিন্তাস্রোত।
মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’-কে কেন্দ্র করে ভারতীয় সিনেমার নবতরঙ্গের পথচলা শুরু, এই মতকে গ্রহণ করেন বেনেগল। তবে তাঁর ছবির ক্ষেত্রে নাট্যভুবন কখনও সরাসরি কখনও প্রকারন্তরে ছায়া ফেলেছে। ভারতীয় সিনেমার নবতরঙ্গ যে সময়টিকে বলা হয়, একই সময়ে আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারেরও বর্ণময় বিচ্ছুরণ দেখেছে দেশ। সেই সময়ের জল-বাতাস আলো-অন্ধকার সবই যেন অচিনপুরের কথা শোনাত। নাটক এবং চিত্রনাট্য নিয়ে সম্মুখ সমর দুই মহারথীর। একজন তেন্ডুলকর, অপরজন গিরিশ কারনাড। স্থান, শ্যাম বেনেগলের ছোট্ট ফ্ল্যাট। তাঁর কন্যা তখন ছোট। দুই লেখকের যুক্তি-প্রতিযুক্তি প্রক্ষেপণের শব্দে কান্না জুড়ে দিল সেই শিশুকন্যা। শ্যাম বেনেগল বাধ্য হয়ে দু'জনকেই ফুটপাতে নেমে যেতে বললেন। তর্ক শেষে তাঁরা যেন পুনরায় ফিরে আসেন। তখন ফের আলোচনা হবে আধুনিক শিল্পের অন্তর্বলয় নিয়ে। একে একে কাজ থেকে সরে গেছেন এম এস সথ্যু, সইয়দ আখতার মির্জা। কিছুদিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন কুমার শাহানি। শ্যাম বেনেগলেরও চিরবিদায়। চিন্তনের প্রবাহকে চলচ্চিত্রে স্থাপন করতে এমন আকুতি আর দেখা যাবে কি? এ এখন বড় প্রশ্ন।
বৃহত্তর দর্শকের কথা ভেবে শ্যাম বেনেগল ছবি করেছেন প্রধানত হিন্দিতে। তবে হিন্দি ভাষার ছবি মানেই ভারতের জাতীয় ছবি এহেন কোনও সরলীকরণে আস্থা ছিল না তাঁর। বরং এ ধরনের বাক্যে থাকতেও পারে গূঢ় অভিসন্ধি, সে বিষয়ে খোলা মনে কথা বলেছেন বারবার। বাংলা, মালায়ালাম, হিন্দি, কন্নড় এসব মিলেই তো দেশবাসীর পরিচয়। নাহলে ‘ভবনি ভাওয়াই’, ‘মাটির মনিষ’, ‘সংস্কার’, ‘ঘাটশ্রাদ্ধ’, ‘এলিপ্পাথায়াম’, ‘আম্মা আরিয়ান’, ‘ইশানু’, ‘উমবার্থা’ – এসব ছবিরই তো ঘটে যাবে নির্বাসন। কী আশ্চর্য! এই সব ছবিকে ভর করেই তো ভারতীয় ছবির জয়যাত্রা। নাহলে সবই অলীক হয়ে যায়।
(এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে শ্যাম বেনেগল এবং গিরিশ কারনাডের কথাবার্তার অনেক অংশ ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সঙ্গীতা দত্তের লেখা শ্যাম বেনেগলের জীবনী বইটিরও সাহায্য নেওয়া হয়েছে।)