নরম হিন্দুত্ব! কেজরিওয়ালের পথেই হাঁটছেন মমতা?

West Bengal Politics Mamata Banerjee: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সফট হিন্দুত্বের দিকে হাঁটছেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে দিঘার জগন্নাথ মন্দির।

DB

দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টির শোচনীয় পরাজয়ের অন্যতম কয়েকটি কারণ ছিলো- ওভার কনফিডেন্স (অতি-আত্মবিশ্বাস), সফট হিন্দুত্ব, মুসলিম ইস্যুতে চুপ থাকা। সেই একই কম্পাস নিয়েই কি লড়াইয়ের ময়দানের দিকে এগোচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস? উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, দিল্লিতে আপের পরামর্শদাতা সংস্থা ছিল আই-প্যাক, বাংলাতেও তৃণমূল কংগ্রেসের পরামর্শদাতা সংস্থা সেই আই-প্যাক’ই! বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক নির্ভরতা আই-প্যাকের উপর যে যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে তা তৃণমূল কংগ্রেসের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের দিকে নজর দিলেই অনুমান করা যায়। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হেরে যাওয়া ঘোড়া নিয়ে রেসের ময়দানে কেন নামবেন?

২০২০ সালের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি ৭০টি আসনের মধ্যে ৬২ আসনে জিতে ক্ষমতায় আসে। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার দু'সপ্তাহের মাথায় দিল্লি দাঙ্গা হয়৷ দিল্লির আইনশৃঙ্খলা কেন্দ্র সরকারের হাতে থাকায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দিকে সরাসরি কোনো প্রশ্নবাণ এসে লাগেনি। তবে দিল্লির সাধারণ জনগণ বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় দিল্লি দাঙ্গার সময় কেজরিওয়ালের ভুমিকায় ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। সদ্য জিতে আসা আম আদমি পার্টির প্রতি তাদের আশা ছিল দাঙ্গা দমনে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় কেজরিওয়াল সরকার আরও বেশি সক্রিয়তা দেখাবে, আপের নেতা-কর্মীরা আরও বেশি মাঠে থাকবে। দাঙ্গার কয়েক সপ্তাহ পরেই আরও একটি ঘটনা ঘটে দিল্লিতে। শাহিনবাগের NRC-CAA বিরোধী আন্দোলন উঠিয়ে দেওয়া হয় ২০২০ সালের মার্চের শেষের দিকে। শহিনবাগে মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাই বেশি সংখ্যায় ছিলেন। NRC বিরোধী আন্দোলনে আম আদমি পার্টি সক্রিয় ভাবে (প্রতক্ষ বা পরোক্ষ) সমর্থন জানায়নি, পাশে দাঁড়ায়নি। পরিসংখ্যান বলে, ২০২০ সালের দিল্লি নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট মূলত আপের ঝুলিতে গিয়েছিল। ফলে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আশা ছিল, তারা যাঁকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে সেই দল তাদের পাশে থাকবে। কিন্তু মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সংখ্যালঘুদের সেই ভাবনায় জল ঢেলে দেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিজেই!

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিও যদি আমরা দেখি, দিল্লির সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হবে না। মুর্শিদাবাদ দাঙ্গা (সামসেরগঞ্জ-বেলডাঙ্গা-সুতি) নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, পুলিশ-প্রশাসন খবর পাওয়া সত্ত্বেও অনেক পরে ঘটনাস্থলে গিয়েছে। দাঙ্গা বন্ধ করতে দ্রুততার সঙ্গে যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, রাজ্য সরকার তা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তার সঙ্গে মুসলিমদের কাছে আবেগ ও অধিকারের বিষয় হলো 'ওয়াকফ'। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি গিয়ে 'ওয়াকফ আন্দোলন' করার কথা বলেছেন। তৃণমূল কংগ্রেসও 'ওয়াকফ' নিয়ে খুব জোড়ালো আন্দোলন করেছে, তেমন ছবিও মুসলিমদের কাছে তুলে ধরা যায়নি। ওবিসি নিয়েও বাংলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। প্রতিশ্রুতি মতো পর্যাপ্ত সংখ্যায় মাদ্রাসা চালু না হওয়া, মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন না পাওয়ার মতো ঘটনাও তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে 'উদ্ধারকর্তা' হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ভাবমূর্তি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছিল, সেটিও বর্তমানে নেই।

আরও পড়ুন- এসআইআর: ভোটের আগে ‘ব্র‍্যান্ড মমতা’র হাতে চাঁদ?

দিল্লির রাজনীতিতে 'রাম' যদি বিজেপির হয়, তাহলে 'হনুমান' হচ্ছেন আম আদমি পার্টির। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সফট হিন্দুত্বের দিকে ঝুঁকে পড়া রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। কেজরিওয়ালের পরিচিতি গড়ে উঠেছিল 'হনুমান ভক্ত' হিসেবে। বিভিন্ন মন্দিরে যাওয়া, পুজো দেওয়া, হনুমান চালিশা পাঠ করা, কপালে তিলক কাটা প্রভৃতি কেজরিওয়ালের সেকুলার ভাবমূর্তিতে জোর ধাক্কা দেয়। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সফট হিন্দুত্বের দিকে হাঁটছেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে দিঘার জগন্নাথ মন্দির। আইনের ফাঁকফোকড় ব্যবহার করে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় মন্দির বানানো মমতার সেকুলার ভাবমূর্তিতে সবথেকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। তার সঙ্গে মহাকাল মন্দির, দুর্গাঙ্গন করার ঘটনাও সেকুলার ইমেজে ধস নামিয়েছে। আর এই সফট হিন্দুত্বের ভিত্তি তৈরি হয়েছে দুর্গাপূজায় ক্লব গুলিকে লাখ লাখ টাকা দেওয়ায়। বাংলায় বিজেপি যে 'তীব্র' হিন্দুত্বের পথে হাঁটছে তার পাল্টা হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সফট হিন্দুত্বের আমদানি করেছেন, তৃণমূলের সঙ্গে থাকা হিন্দু ভোট যাতে বিজেপির দিকে না যায়, মূলত সেই উদ্দেশ্যেই তৃণমূল কংগ্রেস একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে, যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা বিজেপির দিকেই যাবে সেকুলার ভোট তৃণমূল থেকে সরবে, সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন ধরাবে।

২০২৫ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে আবগারি দুর্নীতি মামলায় জেলে যেতে হয়েছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে। ধারণা করা হচ্ছিল, জেলে গিয়ে 'শহিদ সম্মান' পেয়ে দিল্লিবাসীর দিল পেয়ে যাবেন। অভ্যন্তরীন সমীক্ষা, বেসরকারি সংস্থার ইনপুট সবকিছু মিলিয়ে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিলেন ঝাড়ুর মালিক কেজরিওয়াল। সেই বিশ্বাসে ভর করে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন (জেলে থাকা অবস্থায় পদে থেকে সরকার চালিয়ে গিয়েছেন)। জয়ের বিষয়ে আপ এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে কয়েকমাস আগে (২০২৪ লোকসভা) ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম শরিক হলেও বিধানসভা নির্বাচনে একা লড়াই করে। অতি আত্মবিশ্বাসী না হলে, হারের সম্ভাবনা নজরে থাকলে বিজেপিকে আটকাতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের পথে অবশ্যই হাঁটতেন, সেটা বেশি আসন ছাড়তে হলেও।

আরও পড়ুন- বাঙালি অস্মিতাকে চুম্বক করেই ছাব্বিশের লড়াই, একুশের সভায় বুঝিয়ে দিলেন মমতা

২০২৬-এর নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস একাই ২৫০ আসন পাবে। বহু তৃণমূল নেতা একথা বারংবার বলছেন। শুধু নেতা-কর্মীরা নন, মমতা-অভিষেকও ২৬-এর জয় নিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত তা বারংবার তাদের কথায় স্পষ্ট হয়েছে। ২০২১-এর থেকে বেশি আসন জিতবে তৃণমূল একথা স্বয়ং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন। এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৬-এর বিধানসভার নির্বাচনের থেকে ২০২৯-এর লোকসভা নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁর বক্তব্যে! তৃণমূল কংগ্রেসের অতি আত্মবিশ্বাস বারংবার প্রকাশ্যে আসছে। 

বাংলার প্রধান বিরোধী দল বিজেপির অন্যতম বড় অস্ত্র হতে পারে তৃণমূল কংগ্রেসের ওভার কনফিডেন্স (অতি আত্মবিশ্বাস)। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ী হওয়ার অন্যতম একটি কারণ ছিল তাদের দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভয়, যে বিজেপ ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। বিজেপি সেই সময়ে যে রাজনৈতিক হাওয়া (পরিবেশ) তৈরি করেছিল তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ফুল ফর্মে এসে 'খেলেছেন', নিজস্ব ক্যারিশমায় তৃণমূলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মাঠে নামাতে পেরেছিলেন। তবে তৃণমূল কংগ্রেস যদি ২৬-এ অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে যায়, তাহলে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অতি সক্রিয় ভাবে মাঠে না থাকার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যা বিজেপিকে বাড়তি অক্সিজেন দেবে।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তার টার্গেট পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু তার পর থেকে একের পর এক রাজ্য জয় করে চলেছে। গেরুয়া শিবিরের বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখলে এটা স্পষ্ট হওয়া যায়, ২৪-এর লোকসভা নির্বাচননের পর আরএসএস-এর সঙ্গে সমন্বয় বাড়িয়েছে বিজেপি। বিশেষ করে মহারাষ্ট্র-দিল্লিতে এর ব্যাপক প্রভাব দেখা গিয়েছে। অন্তরালে থেকেই দিল্লি-মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে কাজ করেছে সঙ্ঘ পরিবার। লোকসভা নির্বাচন পরবর্তী সময় বাংলাতেও আরএসএস-এর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে নজরকাড়ার মতো! বঙ্গ বিজেপিও ২১ সালের মতো 'হাওয়া গরম' করার পথে এগোচ্ছে না। আদি ও নব্য বিজেপির সমন্বয় বৃদ্ধিও চলছে। এর পাল্টা হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তেমন কোনো বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন এমন ছবি দেখা যাচ্ছে না। তৃণমূলের কোনো অন্তরালের সংগঠন নেই, যে আরএসএস-কে টেক্কা দেবে। তবে ২০২১ সালে 'নো ভোট টু বিজেপি', বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন সেই সময়ে বিভিন্ন নকশাল-আধা নকশালপন্থী সংগঠন তাঁর হয়ে কাজ করেছিল, ২৬ এগিয়ে আসলেও এমন কোনো বিষয় এখনও দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন- মোদির ক্ষমতার উৎস‍! আজ কালো টাকা তত্ত্বকেই নাকচ করছে বিজেপি?

২০২০-তে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আপ ভরসা রেখেছিলে পরামর্শদাতা সংস্থা আই-প্যাকের উপর। প্রশান্ত কিশোরের তৈরি এই সংস্থা কেজরিওয়ালের জন্য ইস্যু বাছাই, প্রচার কৌশল, সার্ভে ইত্যাদির কাজ করে। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি অরবিন্দের বাংলাতেও তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য কাজ করে আই-প্যাক সংস্থাটি। তৃণমূল কংগ্রেসকে বুদ্ধি দেওয়া, ইস্যু বাছাই করা, প্রার্থী বাছাইয়ে সাহায্য করা, প্রচার কৌশল ইত্যাদির কাজ তারা করে। আই-প্যাকের প্রতিষ্ঠাতা (বর্তমানে নেই) প্রশান্ত কিশোর বিহারে নিজের দল তৈরি করেছেন এবং হেরেছেন। রাজনীতির হিসেব বলছে বিহারে প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ আসলে কংগ্রেস-আরজেডিদের মহাগঠবন্ধনকে ক্ষতি করেছে এবং বিজেপি-জেডিইউদের এনডি-এ জোটকে সুবিধা করে দিয়েছে। 

এবার একটু ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকানো যাক। যদি প্রশ্ন করা হয়, লোকসভা নির্বাচন কোন ইস্যুর উপর হয়েছিল? শুরুতেই মাথায় আসবে বিজেপির '৪০০ পার' স্লোগানের কথা। একটি রাজনৈতিক দলের টার্গেট কেন নির্বাচনের ইস্যু হতে পারে? তারপরেও এই স্লোগানই ২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে মূল প্রভাব ফেলেছিল, ভোট হয়েছিল 'বিজেপিই জিতবে, বিরোধীরা শক্তিশালী না' ধারণার উপর। কিন্তু ৪০০ আসন জেতা যে কোনো ব্যাপারই না, সেই কথাটি কে প্রথম বলেছিলেন? অমিত শাহ? নরেন্দ্র মোদি? বিজেপি নেতারা তো বলবেনই, সেটা 'হাওয়া' তৈরি করতে যথেষ্ট নয়। নাকি এমন কোনো ব্যক্তি যার রাজনৈতিক জ্ঞান-প্রজ্ঞা আছে, ক্রেডিবিলিটি আছে? প্রশান্ত কিশোর ২৪-এর ভোট মরশুমের শুরতেই বলেছিলেন বিজেপি একাই (এনডিএ জোট নয়) ৩০০-র বেশি আসন পাবে। কিশোরের এই প্রেডিকশন বিজেপিই জিতছে 'হাওয়া'কে পোক্ত করেছিল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি কি এই বিষয়গুলো জানেন না? তিনি কি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের যাত্রাপথ সম্পর্কে অবগত নন? তার পরেও সেই একই পথে হাঁটা কেন? নাকি এখনও বড় কোনো চমক বাকি? উত্তর সময় বলবে।

More Articles