'ভালো লাগে, তাই মারি', আট বছর বয়সি সেই সিরিয়াল কিলারের গল্প শুনলে শিউরে উঠবেন
বিশ্বের কনিষ্ঠতম সিরিয়াল কিলারের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ হকচকিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির লোক জানিয়েছিলেন, তাঁরা সবটাই জানতেন। অমরজিৎ সবটাই স্বীকার করেছিল।
সিরিয়াল কিলার শব্দটির সঙ্গে সবাই মোটামুটি পরিচিত। কিন্তু জানেন কি, বিশ্বের সবথেকে কনিষ্ঠ সিরিয়াল কিলারের জন্ম এই ভারতেই? আজ তারই গল্প বলি।
'সিরিয়াল কিলার' শব্দটার সঙ্গে সকলেই পরিচিত। সম্ভবত ১৯৩০-এ ‘সেরিয়েনমর্ডার’— এই জার্মান শব্দটি ব্যবহার হয় প্রথম। যার অর্থ ‘সিরিয়াল মার্ডার’। তিন বা তার বেশি-সংখ্যক মানুষকে যদি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে এবং সময়কালে কেউ খুন করে, তবে তাকে সিরিয়াল কিলার বলা হয় অপরাধের ভাষায়। দীর্ঘদিন ধারণা ছিল, সিরিয়াল কিলাররা শুধুমাত্র মানসিক তৃপ্তির জন্য খুন করে। কিন্তু এখন মনে করা হয় আক্রোশ, রোমাঞ্চের খোঁজ, টাকাপয়সা বা নিজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণের কারণেও খুন করতে পারে সিরিয়াল কিলার। এছাড়াও অক্ষম যৌনেচ্ছা পূরণ করার একটা ঝোঁক দেখা যায় নেক্রোফিলিয়া, বা মৃতদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে। এদের শিকার নির্বাচনের একটা নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া থাকে। তার থেকে খুনের পদ্ধতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। এই ধরন বা প্যাটার্নই সিরিয়াল কিলারকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। একে কেন্দ্র করেই প্রোফাইল তৈরি করা হয় খুনির। সে কেন খুন করে, কীভাবে খুন করে, কী তার পছন্দ, কোন কোন জায়গায় সে খুন করেছে, ফলে সম্ভাব্য খুনগুলির স্থান অনুমান– ইত্যাদি নানা কাজ হয় প্রোফাইলিং-এ। তবে আজ যে ঘটনাটি বলব, সে ঘটনা সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
বিহারে বেগুসরাই বলে একটি জেলা আছে। সেই বেগুসরাই জেলাতেই মুসাহ্রি গ্রাম। ছোট গ্রাম। কয়েকঘর মানুষ, সবাই সবাইকে মোটামুটি চেনেন। সেই গ্রামে দুই ভাই পাশপাশি থাকতেন পরিবার নিয়ে। দু'টি পরিবারই হতদরিদ্র। পুরুষরা দিনমজুরি করে সংসার টানে কোনওরকমে। মহিলারা সংসারের কাজকর্ম দেখেন। বড় ভাইয়ের ছেলেটির বয়স বছরসাতেক, মেয়েটি তখনও মায়ের দুধ খায়। ছোট ভাইয়েরও ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। ২০০৬ সালের ঘটনা। ছোটভাইয়ের ছ'বছর বয়সি মেয়েটি হঠাৎ হারিয়ে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার, নিজেরা টুকটাক খোঁজ করলেও গাঁয়ের কাউকেই তারা জানায়নি কথাটা। পুলিশেও ডায়রি করেনি কেউ। কিন্তু গ্রামের ছেলেমেয়েরা সবাই একসঙ্গে হইহই করে খেলাধুলো করে। খবরও খুব একটা চাপা থাকে না। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই মানুষ জেনে গেল মেয়েটির কথা। কিন্তু যেহেতু মেয়েটির পরিবার এই নিয়ে রা কাড়েনি, কেউই আর কোনও উচ্চবাচ্য করল না এ বিষয়ে। দিন কেটে যায়। লোকে বিষয়টা হয়তো ভুলেই যেত, কিন্তু মাসছয়েকের মাথায় আবার একটা ঘটনা ঘটল। ওই পরিবারেরই বড় ভাইয়ের আট মাসের মেয়েটিকে কিছুদিন ধরে দেখতে পাচ্ছিলেন না প্রতিবেশীরা। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, বেশ কিছুদিন যাবৎ নিখোঁজ সে। এই ঘটনা নিয়েও খুব একটা শোরগোল হয়নি। তবে গ্রামের মানুষের একটু খটকা লেগেছিল। ছ'মাসের মাথায় একই পরিবারের দু'-দু'টি শিশু গায়েব! ব্যাপার কী? একটু ভয়ও পাচ্ছিলেন তাঁরা। ভয় যে অমূলক নয়, বোঝা গেল মাসতিনেকের মধ্যেই। ফের গ্রামে এক ছ'মাসের শিশু গেল হারিয়ে।
আরও পড়ুন: সাধারণ অটোচালক থেকে নৃশংসতম খুনি, তিলে তিলে যেভাবে ত্রাস হয়ে উঠল অটো শঙ্কর
ওই গ্রামে থাকতেন চুনচুন দেবী নামে এক মহিলা। মেয়ের নাম রেখেছিলেন খুশবু। সেই ছ'মাসের মেয়েকে নিয়ে সেদিন চুনচুন বসেছিলেন গ্রামের সরকারি স্কুলের বারান্দায়। রোদ পোহানোও হচ্ছিল, স্কুলের বাচ্চাদের খেলা দেখতে দেখতে খুশবুকে খাওয়ানোও চলছিল। হঠাৎ বাড়ির কোনও একটা কাজ মনে পড়তেই জিভ কাটেন চুনচুন। এই রে! একদম ভুলে গিয়েছিলেন। মেয়েকে দাওয়াতেই শুইয়ে ওখানকার ছেলেমেয়েদের একটু নজর রাখতে বলে ঘরে দৌড়েছিলেন তিনি। পাড়াগাঁয়ে এ জিনিস হামেশাই দেখা যায়। ছেলেমেয়ে আর দশজন পাড়া-প্রতিবেশীর শাসনেই বড় হয়। তাতে বাবা-মা গোঁসা করেন না। বরং অনেকটা নির্ভারভাবেই নিজেদের কাজকর্ম করতে পারেন। যাই হোক, ঘর থেকে কাজ সেরে এসে চুনচুনের মাথায় হাত। দাওয়ায় খুশবু নেই। ভাবলেন, কোনও জ্ঞাতি নিয়ে গেছে হয়তো! কিন্তু না, গাঁয়ের প্রতিটি ঘরে খোঁজ করা হল, খুশবু নেই। আশপাশে খোঁজ করা হল, কোথাও পাওয়া গেল না। ছ'মাসের বাচ্চা তো নিজে হেঁটে চলে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই কেউ নিয়ে গিয়েছে। অনেক খুঁজে ব্যর্থ, ক্লান্ত চুনচুন ভগবানপুর থানায় গিয়ে মিসিং ডায়রি করে এলেন।
এই প্রথম মুসাহ্রির থেকে শিশু গায়েব হওয়ার খবর থানা জানতে পারল। খুশবুর খোঁজে গ্রামে এল পুলিশ। এদিক-ওদিক খোঁজার চেষ্টাও করল তারা। খোঁজ পাওয়া গেল না। গ্রামবাসীদের টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে বরং পুলিশ খবর পেল, এর আগেও একটি পরিবারের দু'-দু'খানি শিশু এমন গায়েব হয়ে গিয়েছে। একই পরিবারে দু'-দু'টি শিশু! অথচ পুলিশে কোনও খবর নেই? তদন্তকারীরা একটু অবাক। গেলেন সেই বড় ভাইটির ঘরে। কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পর সেই ব্যক্তি তাঁর আট বছরের ছেলে অমরজিৎ সদাকে ডেকে পাঠালেন। পুলিশকে বললেন, খুশবুর খোঁজ একমাত্র অমরজিৎ-ই দিতে পারবে বোধহয়।
এবার পুলিশের আরও খানিকটা অবাক হওয়ার পালা। আট বছরের বাচ্চা দেবে খুশবুর খোঁজ? গোটা গ্রামে কেউ দিতে পারল না! তবু যদি কোনও ক্লু-টু পাওয়া যায় ভেবে, নিছক খানিক মজামেশানো কৌতূহলের বশেই, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো খুশবুর কথা। প্রশ্ন শুনে খুব হাসতে শুরু করল অমরজিৎ। বারবার প্রশ্ন করা হয় আর বারবার সে হাসে। এবার পুলিশ বিরক্ত, সময় নষ্ট কেবল। ইতিমধ্যে অমরজিৎ হাসতে হাসতেই জবাব দিল, "হ্যাঁ, জানি বইকি।" “কী জানো?” না, এমনি এমনি বলবে নাকি সে! তার খিদে পেয়েছে, আগে একখান বিস্কুট এনে দাও। একখান কি, তাকে এক প্যাকেট বিস্কুট এনে দেওয়া হল। তখন আরাম করে বিস্কুট খেতে খেতে অমরজিৎ পুলিশকে বলল, “টালি দিয়ে ছেঁচে মেরে দিয়েছি।”
তদন্তকারীরা বিস্মিত। আরেকবার বল, আরেকবার বল। “টালি টালি, ছেঁচে মেরে দিয়েছি খুশবুকে।” এবার সত্যি রেগে যাচ্ছিলেন তদন্তকারীরা। এত মিথ্যে কথা বলে ছেলেটা। বিস্কুট খেতে খেতেই অমরজিৎ বলল, “চলো, তোমাদের জায়গাটা দেখিয়ে দিচ্ছি।” এবার পুলিশের আগ্রহ খানিক বাড়ল। অমরজিৎ সেই স্কুলবাড়ির থেকে খানিক দূরে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে গেল তাঁদের। সেখানে একটা ঝাড়ের দিকে ইশারা করে বলল, “এর নিচেই শুইয়েছিলাম।” জায়গাটার ঝরা পাতা, আগাছা পরিষ্কার করে দেখা গেল, সত্যি সেখানে একটা গর্ত। আর গর্তের নিচে খুশবুর লাশ। সবাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা কথা বলে কম, হাসে বেশি। আট বছর বয়স মাত্র। সে কিনা অবলীলায় মেরে ফেলল শিশুটিকে!
গ্রেপ্তার হলো অমরজিৎ। অমরজিতের বয়ানেই জানা গিয়েছিল, প্রাইমারি স্কুল থেকে বাচ্চাটিকে তুলে প্রথমে নির্জন জায়গায় নিয়ে আসে সে। তার গলা টিপে ধরে, শেষে নিশ্চিন্ত হতে ক্ষেত থেকে একটুকরো টালি তুলে মাথা থেঁতলে দেয়। তারপর ছ'মাসের শিশুটির লাশ পুঁতে দিয়ে পালিয়ে আসে। একে একে নিজের বোন এবং খুড়তুতো বোনকেও মারার কথা স্বীকার করে অমরজিৎ। সেসব কথাও সে হাসতে হাসতেই স্বীকার করেছিল। পুলিশ স্টেশন, বিচারের রায় কোনওকিছুকেই সে তেমন গ্রাহ্য করেনি। বলেছিল, ভালো লাগে, তাই মারি।
বিশ্বের কনিষ্ঠতম সিরিয়াল কিলারের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ হকচকিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির লোক জানিয়েছিলেন, তাঁরা সবটাই জানতেন। অমরজিৎ সবটাই স্বীকার করেছিল। প্রথমবার তাঁরা ভেবেছিলেন, খেলতে খেলতে হয়তো ঝগড়া-মারপিট হয়েছে, তাতেই মারা গিয়েছে খুড়তুতো বোন। পরেরবার অবশ্য প্রচণ্ড মার মারা হয় তাকে। আর কখনও করবে না বলেছিল অমরজিৎ। ‘ফ্যামিলি ম্যাটার’, তাই এবারও পুলিশকে জানাননি পরিবার। আর এই প্রশ্রয়ই আরেকটি শিশুহত্যার পথ সুগম করে দেয়। বিচারে সাজা অমরজিতের বিশেষ হয়নি। শিশু সংশোধনাগারের সলিটারিতে, অর্থাৎ বাকি শিশুদের থেকে আলাদা করে রাখা হয় তাকে। আঠারো বছর বয়সে নতুন নাম-ধাম পরিচয়পত্র দিয়ে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। বর্তমানে তার বয়স ২৪ বছর। পরিপূর্ণ যুবক সে। সে এখন কোথায়, কী করছে, জানার আর উপায় নেই। হয়তো আমাদের মধ্যেই বাস করছে সাধারণ মানুষ হিসেবে। কিন্তু বিশ্বের সেই কনিষ্ঠতম সিরিয়াল কিলারের ঘটনা মুসাহ্রির লোকে এখনও ভুলতে পারেনি। ভোলা বোধ করি সম্ভবও নয়।