সন্ধের পর স্তব্ধ হয়ে যেত কলকাতা, আজও অধরা ঘাতক স্টোনম্যান
স্টোনম্যানের খুনের পদ্ধতি এক হলেও খুনের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। স্টোনম্যান বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষদের খুন করেছিল। তাই এটা বলা যায় না যে, শুধু পুরুষ অথবা মহিলা, কিশোর অথবা বৃদ্ধ, কোনও এক বিশেষ বয়স অথবা লিঙ্গ...
৪ জুন, ১৯৮৯। মেঘলা দিনটার শুরুতে কলকাতার মানুষ বুঝতে পারেনি যে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে বেশ কিছু সময়ের বিনিদ্র রজনী আর একরাশ আতঙ্ক। রাত গভীর হতেই যে আতঙ্ক বড় পাথরের চাঁই অথবা কংক্রিটের স্ল্যাব হয়ে কলকাতার ফুটপাথে নেমে আসবে। কলকাতার ফুটপাথ তখনও বিভিন্ন মানুষের আস্তানা। উদ্বাস্তু, ভবঘুরে, রিকশাচালক, মুটে, মজুর, কাগজকুড়ানি, ভিখারি, মাতাল, পাগল। সে যেন শহরের ফুটপাথে আলাদা এক শহর।
৫ জুন, ১৯৮৯। কলকাতার ফুটপাথে পাওয়া গেল এক মহিলার মৃতদেহ। মাথা থেঁতলে খুন। ভারী কিছুর একবার আঘাতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। মৃতদেহের পাশে পড়ে ছিল একটা বড় পাথরের চাঁই। ওজন প্রায় কুড়ি থেকে তিরিশ কেজি। সেই পাথরের গায়ে লেগেছিল রক্তের দাগ। তদন্তে রক্তের দাগ ছাড়া সেই পাথর থেকে কিছু পাওয়া যায়নি। রাস্তায় বসবাসকারী মহিলার মাথা থেঁতলে খুন নিয়ে শহর তখনও মাথা ঘামায়নি। সবাই এই ঘটনা অন্য পাঁচটা ঘটনার মতো ভুলেই যেত, কিন্তু এই ঘটনা আর পাঁচটা ঘটনার মতো সাধারণ ছিল না। তার প্রমাণ খুব অল্প সময়ে পাওয়া গেল। কলকাতায় ১৯৮৯-এর জুন থেকে আগামী ৬-৭ মাসের মধ্যে একই কায়দায় ১৩টা খুন হলো। মধ্য কলকাতার শিয়ালদহ থেকে হাওড়া ব্রিজ অবধি বিভিন্ন এলাকায় এই ১৩টা খুন হয়েছিল। প্রত্যেকবার ভারী কোনও বড় পাথরের চাঁই অথবা কংক্রিটের স্ল্যাব মাথায় সজোরে আছড়ে ফেলে মাথা থেঁতলে খুন। প্রত্যেকবার খুনে ব্যবহৃত পাথর অথবা কংক্রিটের স্ল্যাব মৃতদেহের পাশেই পাওয়া যেত। সেই পাথরে লেগে থাকত মৃত ব্যক্তির রক্তের দাগ। খুনের পদ্ধতি ছাড়াও আরও বেশ কিছু ব্যাপারে এইসব খুনের মধ্যে মিল ছিল। খুন হওয়া সকলেই ফুটপাথে থাকত। যারা খুন হয়েছিল, তারা প্রত্যেকেই সেই রাতে একা ঘুমিয়েছিল এবং তাদের আশপাশে কেউ ছিল না। প্রত্যেকটা জায়গায় রাস্তার আলো কম ছিল। প্রত্যেকটা খুন রাত বারোটা থেকে পাঁচটার মধ্যে হয়েছিল।
শুরুতে এই খুনগুলো নিয়ে কেউ চিন্তা করেনি। রাস্তার ফুটপাথে যাদের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছিল, তাদের বেশিরভাগের পরিচয় জানা যেত না। চিন্তা শুরু হলো, যখন রাস্তায় একইভাবে খুন হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। এই চিন্তার সঙ্গে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, যখন লালবাজার থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে এক ফুটপাথবাসীর মৃতদেহ পাওয়া গেল। এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে কলকাতার এক জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র কলকাতার এই অধরা আততায়ীর নাম দিল 'স্টোনম্যান'। মানুষ সেই অদৃশ্য আততায়ীকে ভয় পেতে শুরু করল। কলকাতায় সন্ধের পরে লোডশেডিং হতে পারে ভেবে অনেকে বিকেল থেকে বাড়ির সদর দরজা এবং একতলার জানলা বন্ধ করে দিতে শুরু করল। মানুষ ভয় পেতে শুরু করল যে, অন্ধকারের সুযোগে হয়তো স্টোনম্যান তাদের বাড়িতে ঢুকে পড়বে। ফুটপাথবাসীরা রাত্রে সবাই একজোট হয়ে থাকতে শুরু করল। অনেকসময় তারা নিজেদের মধ্যে পালা করে জেগে পাহারা দিত।
আরও পড়ুন: মনে পড়ে সজল বারুইকে? রং-তুলি ছেড়ে কেন বাবা-মাকে নৃশংসভাবে খুন করেছিল এই কিশোর?
পুলিশ তদন্ত দুইভাবে শুরু করল। একদিকে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ আর অন্যদিকে ছদ্মবেশে স্টোনম্যানের অপেক্ষা করা। লোকমুখে শোনা যায় যে, পুলিশকর্মীরা ভবঘুরে সেজে চাদর চাপা দিয়ে ফুটপাথে শুয়ে থাকত। তাদের দুই হাতে দুটো বন্দুক ধরা থাকত। সেইভাবে তারা রাত জেগে স্টোনম্যানের জন্য অপেক্ষা করত। এই আতঙ্কের মধ্যে হঠাৎ করেই প্রথম খুনের ৭ মাস পরে স্টোনম্যানের খুনখারাপি বন্ধ হয়ে গেল। শহরবাসীকে উৎকণ্ঠা এবং আতঙ্কের মধ্যে রেখে সে অন্ধকারেই মিলিয়ে গেল।
স্টোনম্যান কে এবং কেন তাকে গ্রেফতার অথবা চিহ্নিত করা গেল না, সেই ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তদন্তকারীদের মতে স্টোনম্যান এক অথবা একাধিক ব্যক্তি হতে পারে। যদিও ২০-৩০ কেজি ওজনের পাথর অথবা কংক্রিটের স্ল্যাব যে উচ্চতা থেকে সজোরে মাথার ওপর আছড়ে ফেলা হতো, তা দেখে খুনি লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান বলেই মনে হয়। তদন্তকারীরা তাই লম্বা, স্বাস্থ্যবান, সন্দেহজনক পুরুষের সন্ধান শুরু করে। যদিও তদন্ত চলাকালীন এবং পরবর্তী সময় বারবার একাধিক ব্যক্তির তথ্য সামনে এসেছে। এমনকী, স্টোনম্যান যে আসলে মহিলা হতে পারে, সেই রকম একটা জল্পনাও লোকমুখে ঘুরতে শুরু করে।
স্টোনম্যানের খুনের পদ্ধতি এক হলেও খুনের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। স্টোনম্যান বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষদের খুন করেছিল। তাই এটা বলা যায় না যে, শুধু পুরুষ অথবা মহিলা, কিশোর অথবা বৃদ্ধ, কোনও এক বিশেষ বয়স অথবা লিঙ্গের মানুষের ওপর আক্রমণ হয়েছিল। অনেকেই মনে করে যে, স্টোনম্যান কোনও বুদ্ধিমান মানুষ, যে মানসিক রোগী। সেই কারণেই সে এই নৃশংস হত্যালীলা চালিয়ে যেতে পেরেছিল। বহু ক্ষেত্রে স্টোনম্যানের সঙ্গে নরবলি প্রথা এবং কালোজাদুর যোগসূত্র সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে, যদিও কেউ এই ঘটনার সঙ্গে নরবলি প্রথার যোগাযোগের কোনও প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। স্টোনম্যানের আক্রমণ যে ফুটপাথবাসীদের প্রতি কোনও এক অথবা একাধিক ব্যক্তির ঘৃণা থেকেও হতে পারে, সেই বিষয়ে বিভিন্ন গল্প শোনা যায়, যার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। স্টোনম্যানের হঠাৎ অন্তর্ধান নিয়েও বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মত রয়েছে। সেই নানা মুনির নানা মতে স্টোনম্যানের হঠাৎ মৃত্যু থেকে অন্য কোনও অপরাধে ধরা পড়ে জেলে যাওয়ার মতো সবকিছুই শোনা যায়।
১৯৮৯ সালে কলকাতায় স্টোনম্যানের হত্যালীলার আগে ১৯৮৫-১৯৮৮ অবধি মুম্বইতে একই কায়দায় ১২টা খুন হয়েছিল। এই দুই ক্ষেত্রেই কাউকে খুনি হিসেবে চিহ্নিত অথবা গ্রেপ্তার করা যায়নি। এই দুটো ঘটনার নেপথ্যে কি একই ব্যক্তির হাত ছিল? সেটা মানুষ জানবে কীভাবে? স্টোনম্যান তো শহরের অন্ধকারে ফিরে গিয়েছে।