গর্ভবতী অবস্থায় ৭ জনের গলা কেটে খুন! স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলার ফাঁসি দেখবে দেশ?

First Woman To Be Hanged: বিচার চলাকালীনই জন্ম নেয় শবনমের সন্তান। বেশ কয়েক বছর আগে সন্তানটিকে সাংবাদিক উসমান সাইফি এবং তাঁর স্ত্রী বন্দনা দত্তক নেন।

৭ জনকে একসঙ্গে হত্যা। নিষ্ঠুরতার কথা উঠলে সাধারণত কোনও মহিলার চেহারাই ভেসে ওঠে না দীর্ঘদিনের চিন্তন অভ্যাসে। তবু, বাস্তব চিরকালই বড় রুক্ষ। স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা হিসেবে যাকে ফাঁসি দেওয়ার ঘোষণা করেছিল ভারতের আইন সেই মহিলার কাহিনি সেই রূঢ় বাস্তবকে আরও নিবিড় করে খোদাই করে দেয়। শিক্ষিকা থেকে খুনি হয়ে ওঠার সেই যাত্রাপথ নৃশংসতার সংজ্ঞা বদলে দেয়। ৩৮ বছর বয়সী ওই শিক্ষিকা, শবনম আলি পরিবারের সাত সদস্য, নিজের মা, বাবা, দুই ভাই, ননদ, খুড়তুতো ভাই এবং ১০ মাস বয়সী ভাইপোকে হত্যা করে। দুধের মধ্যে নেশার দ্রব্য মিশিয়ে তারপরে গলা কেটে খুন করা হয় পরিবারের ওই সাত জনকে। অথচ এই শবনমই স্কুলে পড়ুয়াদের কাছে ছিল বেশ প্রিয় শিক্ষিকা!

শবনম উচ্চ শিক্ষিতও। উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদের আমরোহা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বাওয়াখেরির বাসিন্দা শবনম ইংরেজি এবং ভূগোলে ডবল এমএ করেছে। স্কুল শিক্ষিকা হিসাবে গ্রামেরই এক স্কুলে পড়াত  শবনম। শবনমের কাকা সাত্তার আলি জানিয়েছিলেন, শবনমের মতো বাধ্য মেয়ের দেখা পাওয়া মুশকিল ছিল। এত বাধ্য, অনুগত মেয়ে কীভাবে বীভৎস খুনি হয়ে উঠল? কীভাবে নিজের পরিবারের স্বজনদের শেষ করে ফেলল একাই? নেপথ্যে রয়েছে শবনমের এক প্রেমের কাহিনি। শবনম আলি তার প্রেমিককে বিয়ে করার জন্যই পরিবারের ৭ জন সদস্যকে হত্যা করে। যদি এই ফাঁসি কার্যকরি হয় তবে এটিই হবে স্বাধীন ভারতের একজন মহিলার প্রথম ফাঁসি।

আরও পড়ুন- ভারতীয়দের নির্বিচারে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হত কলকাতার এই রাস্তায়

সাল ২০০৮। ১৪ এবং ১৫ এপ্রিলের মধ্যবর্তী রাতে শবনম তার পরিবারকে নেশার দ্রব্য খাইয়ে দেয় এবং গলা কেটে খুন করে। তার প্রেমিক সেলিমও একটি কুড়ুল দিয়ে পরিবারের গলা কেটে খুনে সাহায্য করে শবনমকে। যে সময় শবনম এমনটা করছে তখন সে সাত সপ্তাহের গর্ভবতী। এই সন্তান ছিল শবনম আর তার প্রেমিক সেলিমের। শবনমের পরিবারের সদস্যরা সেলিমের সঙ্গে তার এই সম্পর্কের বিরুদ্ধে ছিলেন। এই বিরোধিতার মূল কারণ দু'জনের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ভিন্ন এবং 'জাত'ও ভিন্ন। এবং শবনম ও সেলিমের বয়স তখন ২০-র আশেপাশে। খুনের পর নিজেদের উপর থেকে সন্দেহের তির অন্যদিকে ঘোরাতে শবনম জানিয়েছিল অজ্ঞাতপরিচয় কেউ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যার পাঁচ দিন পরে পুলিশ এই প্রেমিক ও প্রেমিকাকে গ্রেপ্তার করে। নেশার ওষুধ, রক্ত লাগা পোশাক এবং কুড়ুলও উদ্ধার করে পুলিশ।

শবনমের পরিবার ছিল সাইফি মুসলিম পরিবার। জমিজমা ছিল বেশ ভালোই। অন্যদিকে সেলিম একজন পাঠান। শুধু তাই নয়, ষষ্ঠ শ্রেণির পরে স্কুলছুট হয়ে যায় সেলিম। দিনমজুরি করেই রোজগার করত সে। শবনমের পরিবার প্রায় ৩০ বিঘা জমির মালিক ছিল। তার বাবা স্থানীয় কলেজের কলাবিভাগের একজন শিক্ষক ছিলেন। শবনম নিজে একজন স্কুল শিক্ষিকা, আর প্রেমিক কিনা দিনমজুর, মেনে নিতে পারেনি পরিবার।

আরও পড়ুন- চিতাভস্ম কিনতে শোরগোল পড়ে কলকাতায়! কানাইলালের ফাঁসি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছিল ইংরেজদের

২০১০ সালে উত্তরপ্রদেশের আমরোহায় সেশনস কোর্ট শবনম ও সেলিমকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। পরবর্তী ১১ বছরে শবনম রাষ্ট্রপতি, এলাহাবাদের উচ্চ আদালত এবং দু'বার সুপ্রিম কোর্টেও ফাঁসির সাজা মকুবের আবেদন করেন। মথুরা জেলা জেলে দেশের প্রথম মহিলাকে ফাঁসি দেওয়ার তোড়জোর শুরু হয়ে যায়। দেড়শ বছর আগে নির্মিত, মথুরার ফাঁসির মঞ্চ, কাঠামো স্বাধীন ভারতে কখনও ব্যবহৃতই হয়নি। পবন জল্লাদ এসে সব তদারকিও করে যান। বিহারের বক্সার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দু'টি ফাঁসির দড়িও অর্ডার করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট আবেদন খারিজ করে দিলেও থেমে থাকেননি শবনম। এখনও চলছে বিচার।

এই বিচার চলাকালীনই জন্ম নেয় শবনমের সন্তান। বেশ কয়েক বছর আগে এই পুত্র সন্তানটিকে বুলন্দশহরের দম্পতি, সাংবাদিক উসমান সাইফি এবং তাঁর স্ত্রী বন্দনা দত্তক নেন। শবনম এবং উসমান ঘটনাচক্রে একই কলেজে পড়াশোনা করতেন। শবনম দু'বছরের সিনিয়র ছিল উসমানের। একই বাসে কলেজে যেতেন তারা। সেই সময় প্রবল অর্থকষ্টে রয়েছেন উসমান। একবার শবনমকে জানিয়েছিলাম কলেজের ফি জমা দেওয়ার মতো টাকা নেই তাঁর। শবনমই সাহায্য করে উসমানকে। উসমানের কাছে 'বড় দিদি’, পড়ুয়াদের কাছে 'প্রিয় শিক্ষিকা' সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে শবনম হয়ে উঠল এক খুনি। যার মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে দেশও। মহিলার ফাঁসি, স্বাধীন ভারতে প্রথম কোনও মহিলা ঝুলে পড়বেন দড়ি থেকে, দেশ যে দৃশ্য আগে দেখেইনি কখনও।

More Articles