ডুবন্ত সুরাইয়াকে বাঁচিয়েছিলেন তিনিই, তবু দেব আনন্দকে খুন করতে চেয়েছিল পরিবার...
Suraiya Dev Anand: দেবের সঙ্গে তাঁর ভালোবাসা ছিল অসম। সাফল্যের চূড়ায় থাকা এক নায়িকার সঙ্গে এক স্ট্রাগলিং অভিনেতার প্রেম।
২০০৪ সালে যখন তিনি মারা গেলেন, অনেকেই প্রশ্ন করেছিল কে তিনি? কেন সব কাগজের প্রথম পাতায় তাঁর মৃত্যুর খবর? চল্লিশ বছর কেটে গেছে। এই বৃদ্ধা লোকসমক্ষে আসেননি। তবুও তাঁকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? হায় রে পোড়া জেনারেশন, তারা জানলই না, মন্নতের শাহরুখ খান কিংবা জলসার অমিতাভ বচ্চন নন, তাঁদের অনেক আগে রোজ নিয়ম করে এই ভদ্রমহিলার বাড়ির সামনে তাঁকে এক ঝলক দেখতে রীতিমতো ট্রাফিক জ্যাম লেগে যেত। হিন্দি ছবির শেষ গায়িকা-নায়িকা ডিভা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেই ট্র্যাজিক নায়িকা, জীবন যার জন্য কোন হ্যাপি-এন্ড স্ক্রিপ্ট লিখে রাখেনি। তিনি সুরাইয়া জামাল শেখ। কিংবা শুধু সুরাইয়া।
জন্ম থেকেই সবাই জানত এই মেয়ে স্টার হবে। তাঁর চলা, কথা বলা, পশ্চার, সবকিছুই যেন হলিউডি নায়িকাদের মতো। কাকা জহুর ছিলেন সেই আমলের নাম করা ভিলেন। তাঁর সঙ্গে সিনেমার শুটিং দেখতে গিয়ে মাত্র সাত বছর বয়সে ম্যাডাম ফ্যাশন ছবিতে প্রথমবার ছোট্ট একটু অভিনয়। কিন্তু কে জানত, কাকার সঙ্গে শুটিং দেখতে যাবার এই ধারা বদলে দেবে তাঁর গোটা জীবনটাকে! তাজমহল ছবির শুটিং শুরু হয়েছে। বিরাট সেট। পরিচালক নানুভাই ভকিল আড়চোখে দেখলেন এক দেবশিশু যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে সেট জুড়ে। আর সবাই অবাক বিস্ময়ে তাঁকে চেয়ে দেখছে। নানুভাই আর দেরি করলেন না। তাঁকে সরাসরি কাস্ট করলেন নিজের সিনেমায়। তবে কোনও সাইড রোল না, একেবারে প্রধান চরিত্রে। মুমতাজ মহল। সুরাইয়ার বয়স তখন বারো পেরোয়নি।
এদিকে পরের বছরই নৌসাদ নায়িকা মেহতাবের জন্য ব্যবহার করলেন সুরাইয়ার কোকিলকণ্ঠ। শোনা যায়, গান রেকর্ডের সময় তাঁর মুখ মাইক অবধি পৌঁছচ্ছিল না। তাই এক টুলে দাঁড়িয়ে গোটা গান সারেন তিনি। সারদা সিনেমার সেই গান, “পঞ্ছি যা পিছে রহা বচপন মেরা” সুপারহিট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সুরাইয়ার নিজের জীবনের কথাও বলে। রাতারাতি কেমন একটা বড় হয়ে গেলেন তিনি। এই যে আচমকা পাওয়া ফেমডম, তা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলেন তাঁর পরিবারের মানুষরাও। তাঁর দাদিজান বাদশাহ বেগম কঠোর হাতে তুলে নিলেন সুরাইয়ার সব আয়ের হিসেবনিকেশ। ছোট্ট সুরাইয়া শুধু যন্ত্রের মতো দাদির হুকুম তামিল করে যেতেন। বাড়ির দাসদাসীদের চেয়েও সুরাইয়ার স্বাধীনতা কম ছিল। দাদির নির্দেশে রোজ ভোর ছ'টায় উঠে গানের রেওয়াজ করে সেই যে দিন শুরু হতো, তাতে দম ফেলার অবকাশ ছিল না। প্রতিটি প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলতেন দাদি নিজে। সুরাইয়ার পারিশ্রমিক গুণে নিতেন তিনিই। বেচারা সুরাইয়াকে এক টাকার জন্যও হাত পাততে হতো। এমনকী যখন তিনি হায়েস্ট পেইড অ্যাকট্রেস, তখনও।
আরও পড়ুন- “এই ছেলেকে দিয়ে আমি গান গাওয়াব,” বাথরুমে কিশোরের গলা শুনে বলেছিলেন শচীন কত্তা!
এই সমস্ত ঘটনায় একটা ব্যাপার চিরকালের মতো ঘটে যায়। সুরাইয়ার ব্যক্তিত্ব কোনওদিন সেভাবে বিকশিত হতেই পারেনি। চিরকাল তিনি ছিলেন এক শিশুর মতো। খ্যাতির চরম সীমাতেও যেন অবাক হয়ে ভাবছেন, “আমি কি এত কিছুর যোগ্য!” তাঁর গানে বারবার এই শিশুসুলভ বিস্ময় ফুটে উঠেছে, আর তাতেই তিনি অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা। ১৯৪৬-এ সুপারডুপার হিট ছবি আনমোল ঘড়ি-তে নূরজাহানের পরে সেকেন্ড লিড তিনি। নূরজাহানের “আজা মেরি বরবাদ মহাব্বত” কিংবা “জওয়াঁ হ্যায় মোহাব্বত”-এর পাশেই সুরাইয়ার “সোচা থা কেয়া, কেয়া হো গয়া”-ও গুনগুন করতে থাকেন শ্রোতারা। পরের বছর দর্দ ছবিতে আবার সেকেন্ড লিড। এবার মুনাওয়ার সুলতানার পরে। এবার তাঁর “বিচ ভঁওর মে অ্যা ফসা হ্যায়” সেরা হিট। সায়গল নিজে প্রস্তাব দিলেন সুরাইয়াকে নায়িকা করে ছবি করার। সুরাইয়া রাজি কিন্তু একটাই শর্ত। সায়গল সাহেবের সঙ্গে তাঁর কোনও ডুয়েট থাকবে না। কেন? সুরাইয়ার মনে হয়েছিল, সায়গলের মতো বড় গায়কের সঙ্গে গাইবার যোগ্যতা তাঁর নেই। বেচারা সায়গল কি আর করেন, মেনে নিলেন। তাদের একসঙ্গে অভিনীত ছবিতে দু'জনের আলাদা আলাদা সোলো আছে, ডুয়েট নেই। নূরজাহানকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন সুরাইয়া। তাঁর গানের কেউ প্রশংসা করলেই বলতেন “আসল গায়িকা হলেন নূরজাহান। আমাকে আপনারা মিছিমিছি গায়িকা বলে লজ্জা দেন।”
এদিকে জনমানসে সুরাইয়ার জাদু প্রায় আকাশ ছুঁয়েছিল। সুরাইয়া বুঝতেও পারেননি। বড়ি বহেন ছবির প্রিমিয়ারে গিয়ে দেখেন কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। সুরাইয়াকে দেখে সবাই পাগলপারা। হলে না ঢুকেই কোনওক্রমে যখন ফিরে এলেন তাঁর পোশাকের বিভিন্ন অংশ ছিঁড়ে-খুঁড়ে মেমেন্টো বানিয়ে রেখে দিয়েছে ফ্যানরা। আতঙ্কিত সুরাইয়া সিদ্ধান্ত নিলেন জীবনে আর কোনওদিন ছবির প্রিমিয়ারে যাবেন না, যানওনি।
এদিকে প্রথমবার তাঁর জীবনে বড় একটা পরিবর্তন এল। ১৯৪৮ সালে বিদ্যা সিনেমার শুটিং। নায়ক নবাগত কোনও এক ধরমদেব পিশোরিমল। দেব আনন্দ নামে সিনেমায় নেমেছে। তখন সুরাইয়া স্টার। নায়ককে তেমন পাত্তাই দিলেন না। সিনেমায় এক দৃশ্যে সুরাইয়া নৌকায়, আচমকা নৌকা ফুটো হয়ে ডুবতে শুরু করল। সবাই হতভম্ব। বুঝতে পারছে না কী করবে। জলে ঝাঁপিয়ে সুরাইয়াকে উদ্ধার করলেন দেব আনন্দ। “আজ আপ আগর মুঝে না বঁচাতে তব তো মেরে জান হি চলি যাতি!” নায়িকার উত্তরে একপেশে হেসে নায়ক জানালেন, “সির্ফ আপকা নেহি, মেরা ভি”। ব্যাস! জীবনে প্রথমবার প্রেমে পড়লেন সুরাইয়া।
আরও পড়ুন- গান প্রতি ১৫ টাকা! গানের চাবুকে বলিউড শাসন করেছিলেন সামসেদ বেগম
জীবনে খ্যাতি, টাকা পয়সা অনেক পেয়েছিলেন সুরাইয়া। পাননি ভালবাসা। দেবের সঙ্গে তাঁর ভালোবাসা ছিল অসম। সাফল্যের চূড়ায় থাকা এক নায়িকার সঙ্গে এক স্ট্রাগলিং অভিনেতার প্রেম। দেবের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য একের পর এক ছবি রিফিউজ করতে থাকলেন সুরাইয়া। তাঁর অভিনীত ছবির গান গাইতে বললেন অন্যকে দিয়ে। আগে এমনটা কোনওদিন করেননি। তিনি। স্টুডিও পাড়ায় কানাকানি রটল। এই উটকো ছেলেটার জন্য সুরাইয়ার কেরিয়ার শেষ হয়ে গেল। বাদশাহ বেগমের কানে কথা গেল। একে তো হিন্দু ছেলে, তার উপরে তেমন বিখ্যাত কেউ না। এই সম্পর্ক বিয়ে অবধি গেলে সর্বনাশ! তিনি এবার নিজে আসরে নামলেন। দেবানন্দকে ডেকে ধমকানো, সুরাইয়াকে ভয় দেখানো, সব চলল। শেষে দুইজন ঠিক করলেন পালিয়ে যাবেন। কিন্তু সুরাইয়ার কানে এল, যদি তারা পালান, তবে দাদি লোক লাগিয়ে দেব আনন্দকে খুনের চক্রান্ত করেছেন। তাঁদের এনগেজমেন্ট রিং আরব সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বেগম। সুরাইয়াকে বাধ্য করলেন নিজের মুখে দেবকে জানাতে যে তাদের বিয়ে সম্ভব নয়। আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে সব করলেন সুরাইয়া। একই সঙ্গে সিনেমা মাধ্যম থেকে ধীরে ধীরে তাঁর উৎসাহ কমতে শুরু করল। গায়িকা, অভিনেতা সুরাইয়া রয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর ভিতরের কী একটা যেন মরে গেছিল। যারাই তাঁকে দেখত, বুঝে যেত রাতারাতি সেই ছোট্ট মেয়েটা যেন প্রৌঢ় হয়ে গেছে। চল্লিশের দশকে সারা ভারত কাঁপানো নায়িকা পঞ্চাশের দশকে একের পর এক গান গেয়ে চললেন যন্ত্রের মতো। একটাও তেমন ছাপ ফেলতে পারল না, এক ১৯৫৪-র মির্জা গালিবের গান বাদে। মির্জার বেদনা যেন সুরাইয়ার নিজের বেদনা হয়ে তাঁর কণ্ঠে রূপ পেল। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু অবধি বললেন, “লড়কি, তুমনে গালিবকে রুহ কো জিন্দা কর দিয়া”। তালাত মাহমুদের সঙ্গে তাঁর ডুয়েট “হামকো উনসে ওয়াফা কি হ্যায় উম্মিদ, যো নেহি জানতে ওয়াফা ক্যায়া হ্যায়” কিংবা সামা পারওয়ানা ছবির “মেরা দিদার না মিলায়া” সুরাইয়ার সোয়ান সং।
বলিউডে গায়িকা নায়িকার দিন ঢলছিল। আর নতুন সূর্যের মতো উত্থান হচ্ছিল দুইদিকে বেণী দোলানো একেবারে সাধারণ চেহারার এক মেয়ের। নাম লতা মঙ্গেশকর। সুরাইয়া মন থেকে এই জগতকে ভালবাসেননি। এতদিন আঁকড়ে ছিলেন পরিবারের চাপে। বাদশাহ বেগম মারা যাবার পরে সেই বন্ধনটাও শেষ হল। ১৯৬৩ তে রুস্তম শোরাব-এর “ইয়ে ক্যায়সি আজব দাস্তান হো গয়া” গেয়ে সিনেমাকে, ক্যামেরাকে, লাইমলাইটকে চিরকালের মতো বিদায় জানালেন সুরাইয়া। মনে রাখবেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র তেত্রিশ।