লিঙ্গবৈষম্যের মুখে সপাট জবাব! দেশ ভুলেছে প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক হোমাই ভ্যারাওয়ালাকে

Homai Vyarawalla, India's First Female Photojournalist: প্রায়শই কাঁধে ক্যামেরা বেঁধে রাজধানীর রাস্তায় সাইকেল চালাতে দেখা যেত তাঁকে, তা-ও আবার শাড়ি পরেই।

এই স্মার্টফোনের জমানায় প্রায় প্রত্যেকেই ফটোগ্রাফার। মোবাইল ক্যামেরাতেই আজকাল উঠে যায় দুর্ধর্ষ সব ছবি। ক্যামেরা ব্যাপারটাও এখন প্রায় মুড়ি-মুড়কির মতোই। কমবেশি সকলেরই হাতে হাতে ডিএসএলআর। তবে ফটোগ্রাফারদের এই বাড়বাড়ন্ত কিন্তু একটা শতাব্দী আগেও এমনটা ছিল না। উনিশ শতকের শেষের দিকে শুরু হল এই পেশার আধিপত্য। বিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত সেখানে পুরুষের চাহিদাই বেশি ছিল। এই পেশায় আজও অবশ্য মেয়েরা প্রান্তিকই। খুব কম সংখ্যক নারীকে ফটোগ্রাফির দুনিয়ায় আসতে দেখা যায়। শখের ফটোগ্রাফিরই যেখানে এই হাল, সেখানে পেশাদার ফটোজার্নালিজম বা চিত্রসাংবাদিকতায় যে তাঁদের অবস্থানটা ঠিক কী, তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। তবু সেই রুক্ষ, অনুর্বর ভূমিতেই ফুল হয়ে ফুটে উঠেছিলেন ভারতের প্রথম চিত্রসাংবাদিক হোমাই ভ্যারাওয়ালা।

আজও ভারতবর্ষের মাটিতে নারী-পুরুষ বেতনের বৈষম্য স্পষ্ট। তবে তা যে শুধুমাত্র এ দেশেই, তা বোধহয় নয়। গোটা বিশ্ব জুড়ে ছবিটা কম-বেশি এতই। দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত পড়াশোনার অধিকারটুকুই ছিল না মেয়েদের, সেখানে জীবিকার প্রশ্ন তো অনেক দূরের। কার্যত সেই সময় থেকে উঠে এসেছিলেন হোমাই। সাংবাদিকতা পেশায় তখন ক'জন মেয়েই বা আসতেন, তায় আবার চিত্রসাংবাদিকতা।

১৯১৩ সালে গুজরাটের নভসারিতে একটি পারসি পরিবারে জন্ম হয় হোমাইয়ের। বাবার ছিল থিয়েটর কোম্পানি। ফলে বাবার ওই থিয়েটর কোম্পানির সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। গুজরাটে জন্মালেও তৎকালীন বম্বেতেই পড়াশোনা শেষ করেন হোমাই। ১৯৩২ নাগাদ মুম্বই চলে এল তাঁর পরিবার। সেখানকার জেজে স্কুল অব আর্টে পড়াশোনার সময়েই তাঁর দেখা হয় বিখ্যাত ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার মানেকশা ভ্যারাওলার সঙ্গে। পরবর্তীকালে অবশ্য তাঁকেই বিয়ে করেছিলেন হোমাই। সেই মানেকশা-র হাত ধরেই ফটোগ্রাফির দুনিয়ায় প্রবেশ পারসি মেয়েটির।

আরও পড়ুন: দেশের প্রথম মহিলা সিনেমাওয়ালা, স্পর্ধার নাম ফতমা বেগম

এর মধ্যেই হাতে পেলেন জীবনের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। একটি পিকনিকের ছবি তুলতে বলা হল তাঁকে। সেই ছবি ছাপা হল একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে। এভাবে হাতে বেশ কিছু কাজ আসতে লাগল, শুরু হল হোমাইয়ের চিত্রসাংবাদিকতায় ফ্রিল্যান্সিং। এরই মধ্যে দ্য ইলাস্ট্রেটেট উইকলি অব ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেল তাঁর ছবি। স্বাভাবিক ভাবেই অনেকেরই নজরে এসে গেলেন হোমাই। এরই মধ্যে জাক পেলেন ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার ডাক। সেটা ১৯৪২ সালের কথা। মুম্বই ছেড়ে দিল্লি চলে এলেন।

The Incredible Story Of Homai Vyarawalla, India's First Female Photojournalist

সেসময় একটি মেয়ে যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দের পেশা বেছে নিতে পারেন, সেই ভাবনাটাই ছিল বেশ কঠিন। তবু সেই কাজটাই করে দেখিয়েছিলেন হোমাই। অবশ্য তাঁর সেই পথে তেমন কাঁটা বিছানো কোনওদিনই ছিল না। পারিবারিক ভাবে সমস্ত রকমের সমর্থনই পেয়েছিলেন হোমাই। মানেকশা-কে বিয়ে করা থেকে শুরু করে বিয়ের পর ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া পর্যন্ত সব সিদ্ধান্তেই পাশে ছিলেন তাঁর বাবা-মা। তবে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। হাতে ধরে কাজ শেখানো থেকে শুরু করে তাঁর পঞ্চাশ বছরের কেরিয়ারে সব সময় পাশে ছিলেন মানেকশা। এমনকী হোমাইয়ের তোলা সেই বম্বে উইমেনস ক্লাবে পিকনিকের ছবিগুলো দ্য বম্বে ক্রনিকলে পাঠিয়েছিলেন মানেকশা নিজেই। তবে সমাজ বোধহয় তখনও এতটা এগোয়নি। তাই দ্য বম্বে ক্রনিকলে হোমাইয়ের তোলা ছবি ছাপা হল তাঁর স্বামী মানেকশা-র নামে। কারণ একজন মেয়ে যে দক্ষ ফটোগ্রাফার হতে পারে, তা হজম করতে পারেনি তৎকালীন সমাজ।

The Incredible Story Of Homai Vyarawalla, India's First Female Photojournalist

যদিও সেই ভ্রম ভাঙাতে বেশি সময় নেননি হোমাই। দিল্লিতে আসার পর প্রায়শই কাঁধে ক্যামেরা বেঁধে রাজধানীর রাস্তায় সাইকেল চালাতে দেখা যেত তাঁকে, তা-ও আবার শাড়ি পরেই। ভারতে ইংরেজ শাসন এবং স্বাধীনতা, এই দুই পর্বই কর্মজীবনে দেখেছেন হোমাই। তাঁর ক্যামেরায় বন্দি হয়েছে এই দুই সময়েরই অজস্র ফ্রেম। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভাইসরয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস, মহাত্মা গান্ধী থেকে জওহর লাল নেহরুর শেষকৃত্য, কী ছিল না সেই তালিকায়।

The Incredible Story Of Homai Vyarawalla, India's First Female Photojournalist

The Incredible Story Of Homai Vyarawalla, India's First Female Photojournalist

বেশিরভাগ ছবি তাঁর প্রকাশিত হয়েছে 'দালদা ১৩' ছদ্মনামে। কতরকম অভিজ্ঞতা যে হয়েছে তাঁর এই চিত্রসাংবাদিকতার জীবনে। ১৯৫৬ সালে দলাই লামা যখন সিকিমের নাথু লা পাস দিয়ে ভারতে এসে পৌঁছন, সেই ঘটনা কভার করতে সেখানে গিয়েছিলেন হোমাই। পরনে শাড়ি। ট্রেনে করে দার্জিলিং, সেখান থেকে পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ গাড়ি চড়ার পর যখন গ্যাংটকে পৌঁছলেন তখন অন্ধকার। থাকার জায়গা পর্যন্ত নেই হোমাইয়ের। তবে ডরার পাত্রীই ছিলেন না তিনি। সমস্ত প্রতিবন্ধকতার উপর দিয়েই নিজের অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে এসেছিলেন তিনি। সম্ভবত সেখানে তিনিই ছিলেন একমাত্র মহিলা ফটোগ্রাফার। লর্ড মাউন্টব্যাটেন থেকে মার্শাল টিটো, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ থেকে জ্যাকলিন কেনেডি, কার ছবি না তুলেছেন হোমাই। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধরা ছিল তাঁর ক্যামেরায়।

The Incredible Story Of Homai Vyarawalla, India's First Female Photojournalist

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর অন্যতম পছন্দের চিত্রসাংবাদিক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন হোমাই। স্বাধীনতার পরের বছরগুলিতে বিদেশ থেকে যতজন প্রতিনিধি ভারতে এসেছেন, প্রায় সব কটি অনুষ্ঠানেই ক্যামেরা কাঁধে হাজির ছিলেন হোমাই। ১৯৭০ সালে নিজের কেরিয়ারের শেষ ছবি তোলেন তিনি। ইতি পড়ে চার দশকের চিত্রসাংবাদিকতার কেরিয়ারে। ১৯৬৯ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পরেই দিল্লি ছেড়ে গুজরাটে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে শুধু স্বামীর মৃত্যুই নয়, ফটোগ্রাফি থেকে সরে আসার নেপথ্যে পরবর্তী যুগের ফটোগ্রাফারদের অসৌজন্যমূলক ব্যবহারকেও দায়ী করেন অনেকে।

আরও পড়ুন: বাইজি গলি থেকে মুম্বই শাসন! ভারতের প্রথম দুই মহিলা সুরকারকে ভুলেছে সিনেমা

জীবনের প্রান্তে এসে ভারতের প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক হিসেবে বেশ কিছু সম্মান পেয়েছেন হোমাই ভ্যারাওয়ালা। ২০১১ সালে পদ্মবিভূষণ পান তিনি। ২০১২ সালে ৯২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এই অসামান্য চিত্রশিল্পীর। তাঁর তোলা সমস্ত ছবি অবশ্য এখনও রয়েছে দিল্লির আলকাজি ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টসে। সাংবাদিকতার দুনিয়া হোমাইকে কতটা মনে রেখেছে বলা শক্ত, কিন্তু হোমাই না থাকলে হয়তো মেয়েদের জন্য একটা দরজা চিরকাল বন্ধই থেকে যেত। লিঙ্গবৈষম্যের অন্ধকারে সেদিন যে আলোকবর্তিকাখানি তুলে ধরতে পেরেছিলেন তিনি, তার চর্চা ইতিহাসে থেকে যাবেই।

 

More Articles