বাংলা বই-বাজারে অনেক ম্যাকমিলান ছিলেন একদা

কাজের স্তর-অনুযায়ী একেকজনের জীবন যেমন পালটে যায়, বয়সের ফেরে বইয়ের গন্ধও তেমনই পালটে পালটে যায়। যেমন কাগজের রং হয়ে যায় হলদেটে। কত-যে প্রকাশক!

‘তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।’

তিতাস একটি নদীর নাম। লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ। বেঁচে থাকতে উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে ছাপা হয়নি, যদিও তিনি তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পর বন্ধুদের চেষ্টায় উপন্যাসটি বইয়ের আকার পায়। কিন্তু এ-ব্যাপারে আমি এমনই আনাড়ি-যে বইটির প্রথম সংস্করণের হদিস নানা চেষ্টা করেও পাইনি। তবে, পুথিঘরের প্রথম প্রকাশই যদি প্রথম সংস্করণ হয়, তবে তার তারিখ— আশ্বিন ১৩৬৩। আমরা পেয়েছি পুথিঘর প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ছাপা বইটিই। রণেন আয়ন দত্তর অপূর্ব ঢেউ-তোলা প্রচ্ছদ। সাড়ে ছ-টাকা দাম। পুথিঘর তখন ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে। বহু পরে যেদিন পেঙ্গুইন ইন্ডিয়ার পেপারব্যাক সংস্করণটি চোখে পড়ে, নারকেলডাঙার ষষ্ঠীতলানিবাসী অকালপ্রয়াত লেখকটির জন্য আর-একবার গর্ব কি হয়নি? রণেন আয়ন দত্তর সেই একই প্রচ্ছদ ছাপার গুণে সেখানে যেন আরো উজ্জ্বল!
অধ্যাপক সুবোধ চৌধুরী তাঁর বন্ধু অদ্বৈত মল্লবর্মণকে বলেছিলেন, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-র পর কি এ-বই লোকে পড়বে? অদ্বৈতর উত্তর ছিল: ‘সুবোধ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় Artist, Master artist। কিন্তু বাওনের পোলা রোমান্টিক। আর আমি তো ‘জাউয়ার পোলা'।’’
‘পদ্মানদীর মাঝি’? সে-বই প্রথম ছাপা হয় সেকালের সেরা প্রকাশনা সংস্থা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে। ১৯৩৬ সালে। এখান থেকেই শরৎচন্দ্রের সমস্ত বই বাঙালি পাঠকের হৃদয় কাঁপিয়েছে। এঁদের লেখক-তালিকায় ছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, দিলীপকুমার রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। দু-এক হাত ঘুরে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ আসে প্রকাশ ভবনে। বলা যায়, এই প্রকাশ ভবনই বিনয় ঘোষের একদা-বিখ্যাত সব বইয়ের প্রকাশক। ওই একই বছরে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’রও প্রথম প্রকাশ ডি এম লাইব্রেরি থেকে। এ-বইটিও দু-এক হাত ঘুরে আসে বেঙ্গল পাবলিশার্সে। সেই বেঙ্গল পাবলিশার্স, যাদের তিন খণ্ডে প্রকাশিত বই ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ’। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ও এদেরই বই।

আরও পড়ুন- দূরে থাকা মানে বিচ্ছিন্ন থাকা নয়, শঙ্খ ঘোষের চিঠিতে স্মৃতির ঘর

কী-সব বই! সে-সব বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা বাংলাবাজারের একেকটা ম্যাকমিলান যেন। আমাদের ছিল যেমন সুবর্ণরেখা। তখনো আমি সিউড়ির কলেজে। কলকাতা এসেছি দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের উসকানিতে। একদিন মহাত্মা গান্ধি রোড থেকে পিছন দিকে সরু, বাঁকানো সিঁড়ি। উঠে রাস্তার দিকে বুক-চাপা বারান্দা। ডানহাতি ঘুরলে ঘুপচি ঘরে এক ভদ্রলোক। হাতে-কাচা ধুতি-পাঞ্জাবি। প্রথম আলাপে— সে-সব বাহাত্তর-তিয়াত্তর সালের কথা— বীরভূম শুনে, বীরভূমের কোথায়? সিউড়ি-বোলপুর রাস্তায়, পুরন্দরপুর নামে একটা আধা গ্রামে। পুরন্দরপুর? ওখানে দুর্দান্ত মাছভাজা খেয়েছি। বাউলের দোকানে। চেনেন?
ইনি ইন্দ্রনাথ মজুমদার ছাড়া আর কে! ততদিনে এঁরই প্রকাশনীর বই ‘প্রাচীন শিল্প পরিচয়’, ‘ঠগী কাহিনী’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’ এবং সবার উপরে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ আমার পড়া। অকালপক্বই ছিলাম বলতে হবে। এই সুবর্ণরেখা থেকে কাছাকাছি সময়েই ছাপা হয় শামশেরদার (আনোয়ার) ‘মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে’। অনেক পরে তাঁরই গদ্যের বই ‘শক্তি ও তাঁর পরবর্তী কবিরা’। সুবর্ণরেখার বই এমনই। ‘ছিল’ বলা যায় না। আছে। এবং থাকবে।
লেটারপ্রেসের অতি নগণ্য সব জিনিসপত্র। পাইকা, স্মল পাইকা, আর ছিল নজর লাগিয়ে দেওয়ার মতো এক টাইপ— বর্জাইস! সেইসব দিয়েই কী-যে অসাধারণ বই নির্মিত হত, এখনো হয়ে রয়েছে, দেখলে আজো চমৎকৃত হতে হয়।

একটু দক্ষিণে গেলে, কলেজ স্কোয়ার পেরিয়ে, সূর্য সেন স্ট্রিট। লাল, পুরনো একটা বাড়ি। ঘরোয়া ঢঙে ধুতি। কখনো লুঙি। গায়ে ফতুয়া। পায়ে অতি সাধারণ চপ্পল— কৃষ্ণগোপাল মল্লিক থেকে কে.জি. হওয়ার দিকে সবে এগোচ্ছেন। স্টেটসম্যানের চাকরি ছেড়ে এমন এক অকুতোভয় মাসিক পত্রিকা চালাচ্ছেন, যার নাম ‘গল্পকবিতা’, যে-পত্রিকাটি একদিন-কী-একদিন অফুরন্ত নীল সাগরে ভেসে যাবেই। অধুনা-নামের দুঃসাহসী এক প্রকাশনার কর্তাও তিনি। তত দিনে বাংলাভাষায় বেশ কয়েকটি পেপারব্যাক সে-প্রকাশনা থেকে বেরিয়ে গেছে, যেগুলোর প্রথমটির লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, ‘সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য’ (জুলাই ১৯৬৯), যে-বইটি সম্বন্ধে স্টেটসম্যান লিখেছিল— ‘Now the pocketbook has at last made its debut in Bengal.’ (29.9.69)
বাংলা বইয়ের সেরকম প্রচ্ছদ তার আগে কখনো দেখা যায়নি। পরে? নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না। আমাদের বন্ধু দেবু, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, তখন ‘গল্পকবিতা’য়— বলেছিলেন, আঁকা প্রচ্ছদটি কেষ্টগোপাল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে একটা কাঁচি নিয়ে খচখচ করে এদিকওদিক কেটে ফেললেন। যা দাঁড়াল, ইংরেজিতেই সম্ভব সেটা।
দ্বিতীয় পকেটবুক একটি কবিতার সংকলনগ্রন্থ ‘কবিতার পুরুষ’-এর পর ফের আগুন— তুষার রায়ের গল্পগ্রন্থ ‘শেষ নৌকা’ (অগাস্ট ১৯৭১)। শুরু হচ্ছে উন্মাদ গদ্য— ‘দূরান্তে নীল বিলীন আকাশ মেশে সমুদ্রে যেখানে সেখানে মৃদু রক্তিমা ম্লান শুকনো ব্রাশ ঘষার মতো ঈষৎ দৃষ্ট— তা নাহলে আকাশ আর জলের ফারাক যেতো না বোঝা, জলধোয়া ছবির মতো বালিয়াড়ি বেলাভূমি সামান্য হরিদ্রাভ ছায়াধূসর— এসব ডিটেল থেকে প্যানোরামিক চোখকে প্যান করে অর্থাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে সম্মোহন আরো কিছু যেনো দেখতে চাইলো এবং দেখতে পেলোও ইতিউতি সঞ্চরমান সিল্যুট সিল্যুট সব যুবক-যুবতীদের।’

আরও পড়ুন-বাড়িতে পোষেন ডাইনোসর! জ্যোতির্ময় দত্তকে নিয়ে এমনই বিশ্বাস অনেকের

কিন্তু, এসব তো পরের পর বেরিয়ে যেতে পারে না! সব বিপ্লবেরই শেষ আছে। আর তাই চতুর্থ পকেটবুক ‘অসীম রায়ের গল্প’ই সম্ভবত ওই সিরিজের শেষ বই।
তারপর কোনো-একদিন ক্রমে তিনি কে.জি. নামে পরিচিত হবেন। এমন এক লেখক, দু-খণ্ডে যাঁর গদ্যসমগ্র প্রকাশ পাবে। বিদেশী ভাষায় অনুবাদ হবে সে-লেখা।

সে-যাই হোক, কাজের স্তর-অনুযায়ী একেকজনের জীবন যেমন পালটে যায়, বয়সের ফেরে বইয়ের গন্ধও তেমনই পালটে পালটে যায়। যেমন কাগজের রং হয়ে যায় হলদেটে। কত-যে প্রকাশক! মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র নাভানাকে। অরুণা প্রকাশনীর ‘সতীনাথ গ্রন্থাবলী’কে, যা আজ মিত্র ও ঘোষ থেকে বেরোচ্ছে ‘সতীনাথ ভাদুড়ী রচনাবলী’ নামে। এই যে আজকের দে’জ পাবলিশিং। তারও তো বয়স পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। তাদের প্রথম দিককার কোনো কোনো বই খোঁজ করলে আজো পাওয়া যায়।
কিন্তু শতবর্ষের পুরনো? ১৮৪১ সালে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস থেকে ছাপা একটি ফার্সি-ইংরেজি ডিকশনারি রয়েছে রামধন সেনের। সে বইয়ের বয়স তো হলুদ হতে হতে গুটিগুটি পায়ে দুশো বছরের দিকে এগোচ্ছে! কিংবা পঞ্চানন তর্করত্নের মনুসংহিতা, যেটি বাংলা ১৩১৫ সালে ছাপা, যার বয়স ১১৭ বছর!

এরা বহু আগেই অমরত্ব পেয়ে গেছে। সামনের বইমেলায় হয়তো কারো কারো পুনর্জন্মলাভ হবে। আমরা তাদের স্বাগত জানাব।

More Articles