কী এমন ভয়? কেন সাবিত্রীর বাড়ির বাথরুমে গিয়ে লুকোলেন উত্তম কুমার?
Uttam Kumar : মাঝরাতে সাবিত্রীর বাথরুমে গিয়ে লুকোলেন স্বয়ং মহানায়ক, জানেন কেন এমন ঘটালেন উত্তম কুমার?
উত্তম কুমার, এই নামটা যেন আজও একটা মায়া। যাঁকে ভূঁইয়া যায়না ঠিকই তবে জাপটে থাকা যায়। আবেগের যেমন বয়স বাড়ে না, উত্তমেরও বাড়ে না। আজও যৌবনের চৌকাঠে আটকে থাকা ওই মানুষটিই বাংলার ম্যাটিনি আইডল। ‘মহানায়ক’ তকমাটা সাধে দেওয়া হয়নি তাঁকে, তাঁর জীবনের গল্পটুকুই তাঁকে পাইয়ে দিয়েছে এই শিরোপা। সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে থেকে শুরু এই জার্নি, তারপর একটার পর একটা ছবির হাত ধরে বাঙালির মনের আসনে প্রবেশ, মহানায়ক তাই আজও অজেয়। ইলিশ, চিংড়ি অথবা মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের মতোই একটা আবেগের নাম তিনিও।
বসন্ত বিলাপ ছবির বিখ্যাত সংলাপটা মনে পড়ে যায়, “একবার বলো, তুমি উত্তম কুমার!”, বাঙালি প্রেমিকের সেই উত্তম হবার শখ কিন্তু চিরকালীন। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁর জুটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলেও, অন্য নায়িকাদের সঙ্গে তাঁর অভিনয়ও ছিল যথেষ্ট সাবলীল। সেই তালিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের নামটা আসেই। শোনা যায়, আদরের সাবুকে তিনিই রঙিন পর্দার সামনে প্রথম নিয়ে আসেন। মঞ্চে অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই সাবিত্রী নামের তারাটি দীপ্যমান। বাংলাদেশের কুমিল্লার মেয়ে সাবিত্রী। দেশভাগের পর এপার বাংলায় চলে আসেন সপরিবারে। বাবা, মা এবং ১২ জন বোনের সংসার, ভাই ছিল না সাবিত্রীর। তাই সংসারের দায়ভার নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন। বোনদের সংসার সাজিয়ে দিতে গিয়ে নিজের সংসার করা হয়নি আর। কিন্তু ছবির দৌলতে তিনি সংসার করেছেন। জীবনের সবটুকু না পাওয়াকে পেয়েছেন তাই অভিনীত মাধ্যমেই।
আরও পড়ুন - আনা হয় সাদা পদ্ম, কেন আজও ‘উত্তম’ পুজো করা হয় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে?
জীবনটা যেন আস্ত একটা ক্যানভাস। তাই বাইরে থেকে পড়তে কোনও দিনই অসুবিধা হয়নি দর্শকদেরও। শোনা যায় এ হেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে উত্তম কুমারের সম্পর্কটা ছিল একেবারে অন্যরকম। স্নেহ, প্রেম, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সমস্ত আবেগের অনায়াস চরাচর ছিল তাঁদের সম্পর্কে। খুব সিরিয়াস অভিনয় থেকে শুরু করে কৌতুক চরিত্র, সাবিত্রীর বিকল্প হয়ে উঠতে পারেননি কেউই। ধন্যি মেয়ে, মৌচাক, হাত বাড়ালেই বন্ধু, দুই ভাই, নিশিপদ্ম, মোমের আলো ইত্যাদি ছবিতে উত্তমের সঙ্গে তাঁর জুটি আজও বাঙালির কাছে যেন এক্কেবারে ঘরোয়া হয়ে রয়ে গেছে, এতটাই আপন। উত্তম সুচিত্রা এবং উত্তম সুপ্রিয়াকে নিয়ে তোলপাড় যতটা হয়েছে ততটা কোনওদিনই হয়নি সাবিত্রীর সঙ্গে, সাবিত্রী নিজেও চাননি এই আলোড়নটা। তাঁর একটা কারণ অবশ্য ছিল পরিবার।
চিরকালই ঘরোয়া সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। সংসার করতে, রান্না করতে ভালোবাসতেন, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই প্রচণ্ড ভয় পেতেন নিজের বাবাকে। সাবিত্রীর বাবার দাপটকে অবশ্য ডরাতেন স্বয়ং উত্তম কুমারও। ঘরের মেয়ে যতোই রোজগেরে হোক রাত দশটার পর তাঁর সঙ্গে কোনও পুরুষ দেখা করতে আসার স্বাধীনতা মোটেই ছিল না সাবিত্রীর। তাই একদিন হল পালে বাঘ পড়ার মতো অবস্থা। উত্তম সাবিত্রীর বাড়ি এলেন ওই সময়, অথচ ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে তখন তথৈবচ অবস্থা মহানায়কের। সাবিত্রীর বাবার ভয়ে গিয়ে লুকোলেন সটান বাথরুমে। বছর কয়েক আগে একটি বাংলা রিয়ালিটি শো তে এসে সেই গল্প করেন সবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন,“বাথরুম থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমায় বলছে দেখি সাবু আমি এখানে। আসলে আমার বাবাকে সত্যিই খুব ভয় পেত।”
আরও পড়ুন - ৫ সিকে পয়সার বিনিময়ে অভিনয় শুরু, পরবর্তী জীবনে কত পারিশ্রমিক ছিল উত্তম কুমারের?
ঘটনাটা আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে শুনতে বেশ মজার লাগছে ঠিকই, তবে বাসবে তখন ভয়টাই ছিল একমাত্র সত্যি। ইন্ডাস্ট্রি মানেই ঘটনা আর রটনার মিশেল, এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সাবিত্রী উত্তমের সম্পর্ক নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি হয়নি কোনওদিনই, তবে রটনা তো ছিলই। আপাত সুন্দরী ছিলেন না নায়িকা, তবুও উত্তম কুমার আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রতি, তাঁর আসল দক্ষতা ছিল অসাধারণ অভিনয়গুণ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বারবার সাক্ষাৎকারে তাঁর দেখা সেরা অভিনেত্রীর শিরোপা তুলে দিয়েছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মাথাতেই।
রাত ঠিক দশটায় বাড়ির গেটে নিজের হাতে তলা ঝোলাতেন সাবিত্রীর বাবা। দাপুটে মানুষটাকে অমান্য করার সাধ্য ছিল না কারোরই। একবার উত্তম এসেছিলেন বাড়িতে কিন্তু ঘড়িতে দশটা বেজে যাওয়ার পরও খেয়াল ছিল না। ব্যাস বাবার ভয়ে সারারাত কাটাতে হল বাথরুমে, কিন্তু সাহস হল না বাবাকে বলে গেটের ছবি খুলে উত্তমকে বাড়ি পাঠানোর। উত্তম নিজেই যেহেতু যৌথ পরিবারের ছেলে। ভালোই বুঝতেন পরিবারের এই নিয়মের কড়াকড়িগুলো। সম্মানও করতেন বড়দের। তাই বাধ্য হয়েই মহানায়ক থেকে গেলেন বাথরুমেই। নায়িকার বাথরুমে রাত্রিযাপনের এই ঘটনা মোটেই কোনও চটুল উপাদেয় নয়, বরং আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সেই সময়ের একটা দর্পন বলা চলে। আজ হাসি পায় ভাবলে, তবে সেদিন সত্যিই ভয় পেয়েছিল উত্তম এবং সাবিত্রী দুজনেই।