দুর্নীতি, গণপিটুনি! মমতা বিরোধী হলে কী করতেন? বিজেপি-সিপিএম সব কোথায় গেল?

Opposition Movement in West Bengal বিরোধীদের রাস্তায় নামতে ভয় নাকি রাস্তায় নামার মতো ক্ষমতাও নেই? সোশ্যাল মিডিয়াতেও বা কোথায় হইচই?

সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসন টলানো তৃণমূল একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছিল। বিরোধীদের ভূমিকা কতখানি মারাত্মক হলে শাসক ক্ষমতা থেকে টলে যেতে পারে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনে শাসক বামফ্রন্টকে এতটাই বিপাকে ফেলতে পেরেছিল তৃণমূল যে তারপর থেকে প্রায় ১৩ বছর হয়ে গেল, বামেরা ঘুরে দাঁড়াতেই পারল না। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই এক দশক পেরনো শাসনে একাধিক 'ফাউল' করেছে তৃণমূল। দুর্নীতি ছেয়ে গিয়েছে পঞ্চায়েত স্তর থেকে উপরমহল অবধি। শিক্ষা থেকে রেশন সর্বক্ষেত্রে কোটি টাকার খেলা। মন্ত্রী-আধিকারিকরা জেলে। লোকসভা নির্বাচনের আগে সন্দেশখালির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। শেখ শাহজাহান ও তাঁর দলবলের অত্যাচারের কথা রাজ্য জুড়ে চাউর হয়ে যায়। বোঝা যায়, পাড়ায় পাড়ায় গুন্ডা পোষার সংস্কৃতি অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে তৃণমূল। লোকসভা ভোটের আগে দুর্নীতির রমরমা, ভোটের পর গণপিটুনির বাড়বাড়ন্ত- দু'টি ইস্যুই শাসককে বিড়ম্বনায় ফেলার জন্য যথেষ্ট পোক্ত ছিল। অথচ বিরোধীরা কই?

লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় এবার বিজেপির আসন কমেছে। সিপিএম-কংগ্রেস তো পর্যুদস্ত। ২৯টি আসনে জিতেছে তৃণমূল। লোকসভা ভোটে জয়ের পরেই তৃণমূলের সঙ্গে জড়িত অন্তত পাঁচটি এমন ঘটনা ঘটেছে যাতে শাসকদলকে চাইলেই চরম অস্বস্তিতে ফেলতে পারত বিরোধীরা। তৃণমূল এসব ঘটনা জানার পরেই কখনও নেতাদের কড়া সমালোচনা করে ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করেছে। কখনও টাকা দিয়ে চুপ করানোর চেষ্টাও হয়েছে। অথচ তৃণমূলের এই দুর্নীতি, এই গুন্ডা সংস্কৃতি, আইনকে দুরমুশ করে দুষ্কৃতীতের অঢেল ক্ষমতা দেওয়া— বিরোধীরা চাইলেই সব কিছু নিয়ে তুমুল আন্দোলন করতে পারত। কোথায় আন্দোলন? বিরোধী বিজেপির আসন কমেছে, সিপিএম শূন্য, কংগ্রেস তথৈবচ, তারপরেও কেন ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া নয় বিরোধীরা? এই একই ঘটনা বাম আমলে ঘটলে, তৃণমূল জ্বালাময়ী আন্দোলনে নামত, ধর্নায় বসত, নেতারা প্রয়োজনে হিংসার পথও নিতেন। এখন বিরোধীরা সব গেল কই? রাস্তায় নামতে ভয় নাকি রাস্তায় নামার মতো ক্ষমতাও নেই? সোশ্যাল মিডিয়াতেও বা কোথায় হইচই?

আরও পড়ুন- শেখ শাহজাহান, জেসিবি, জয়ন্ত: পাড়ায় পাড়ায় বাহুবলী এটাই তৃণমূলের সংস্কৃতি?

হকার উচ্ছেদ নিয়ে সম্প্রতি বড় ঘোষণা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফুটপাথ দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেওয়ামাত্র রাজ্য জুড়ে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ফুটপাথের একের পর এক দোকান। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের বুলডোজার চালানোর প্রশাসনিক কায়দার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তের তুলনা শুরু হয়। কিন্তু মমতা নিজেই উল্টে দেন বক্তব্য। বলে দেন, ‘‘কাউকে বেকার করার অধিকার আমার নেই।’’ রাস্তাঘাট, ফুটপাথ, সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করার পাশাপাশি বিকল্প রুটিরুজির ব্যবস্থা করার নির্দেশও দিয়ে দেন। আগ্রাসী থেকে হয়ে যান মমতাময়ী। বিরোধীদের কিছু করারই থাকে না।

ছেলেধরা, চোর, প্রেম বিভিন্ন ইস্যুতে রাজ্যে গণপিটুনির ঘটনা এই একমাসের মধ্যে হঠাৎ বেড়েছে। তারকেশ্বর থেকে ভাঙড়, বারাসত থেকে মেদিনীপুর— গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। গত এক মাসে অন্তত ১৭টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। মর্মান্তিক এবং ভয়াবহ! চাইলে এই নিয়ে আন্দোলন করে গদি উল্টে দেওয়া যায়। কিন্তু বিরোধীরা কই?

গত ৩০ জুন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম তাঁর এক্স হ্যান্ডলে একটি ভিডিও পোস্ট করেন যাতে দেখা যায় চোপড়ার তৃণমূল নেতা তাজিমুল হক ওরফে ‘জেসিবি’ এক যুগলকে রাস্তায় ফেলে পেটাচ্ছে। জেসিবি চোপড়ার তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ। বিজেপির অমিত মালব্যও ওই ভিডিও পোস্ট করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকে তালিবানি বলেন। শেষ পর্যন্ত জেসিবি গ্রেফতার হয়। হামিদুলকে শোকজ করে তৃণমূল। যে মহিলাকে ফেলে জেসিবি পিটিয়েছিল সেই মহিলা উল্টে সেলিম এবং মালব্যর বিরুদ্ধে এফআইআর করেন। বিরোধীরা থেমে যায়।

কামারহাটির আড়িয়াদহের জয়ন্ত সিংয়ের দাপট ও গুন্ডাগিরির একাধিক ঘটনা ফাঁস হতে থাকে। এক মা-ছেলেকে পেটানোর ঘটনায় জয়ন্ত সিংকে গ্রেফতারও করে নেয় পুলিশ। সকলেই জানেন, তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্রের হাত রয়েছে জয়ন্তর মাথায়। গণপিটুনির মতো গুন্ডা সংস্কৃতি সংক্রামিত হচ্ছে। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে বিরোধীরা কই?

বড়জোর একটা ফেসবুক-এক্স পোস্ট। কিছু সাংবাদিকের এগিয়ে দেওয়া বুমের সামনে বিবৃতি। এর বাইরে বিরোধী নেতাদের ভূমিকা কই? শাসকের একাধিক দুর্নীতি, একাধিক দুষ্কর্মের প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েও ছেড়ে দিচ্ছেন কেন তারা? সংগঠিত আন্দোলন কেন গড়ে তোলা যাচ্ছে না? তৃণমূল আমলে রাজ্য কি তবে সত্যিই বিরোধীশূন্য? বিজেপির নেতাদের অভিযোগ, তৃণমূলের ভয়ে তাদের অনেক কর্মী ঘরছাড়া। দলের এই কর্মীদের সাহায্য করাটাই বিজেপির মূল কাজ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আন্দোলন তীব্র করা যাচ্ছে না। সন্দেশখালি ইস্যুতে একমাত্র বিজেপিই সম্মুখ সমরে নেমেছিল তৃণমূলের সঙ্গে। খোদ নরেন্দ্র মোদি বসিরহাট আসনে প্রার্থী বেছেছিলেন। শেখ শাহজাহান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের গ্রেফতার করা হয়। বিজেপির প্রার্থী রেখা পাত্রও হেরে যান। সন্দেশখালি ইস্যু নেতিয়ে যায়।

আরও পড়ুন- যে কোনও যোগাযোগই রাষ্ট্রের হাতে? যে ভয়াবহ টেলিকম আইন ২০২৩ চালু হচ্ছে দেশে

রাজ্যের আরেক বিরোধী সিপিএম কী করছে? নিন্দুকেরা বলে সিপিএম সোশ্যাল মিডিয়ায় ভোট করালেই একমাত্র ক্ষমতায় ফিরতে পারে। বাস্তবেও খানিক তেমনই ঘটছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ইস্যু ভিত্তিক পোস্ট শেয়ার করা আর বিভিন্ন জায়গায় সাংগঠনিক রুটিন মাফিক সভা ছাড়া আন্দোলনে কোথায় বামেরা? বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছে। হকারদের যৌথ মঞ্চ গড়ে সেই বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকা হয়েছে। সকলেই জানেন বিক্ষোভ ওই সমাবেশেই শেষ। কেউই নবান্ন অবধি গিয়ে রক্তও ঝরাবেন না, হিংসার পথও নেবেন না, এমনকী রাজ্যজুড়ে তিলমাত্র প্রভাবও ফেলতে পারবেন না। তবু বামেরা বলছে, আন্দোলন হচ্ছে না, এটা বলা সত্যের অপলাপ। আন্দোলন যদি হয়েই থাকে, তা দেখা যাচ্ছে না কেন?

তৃণমূল কি বিরোধী স্বর দমন করছে? নাকি বিরোধীদের স্বরগুলি ক্ষমতার কাছে থাকতে চেয়ে দলবদল করছে? নাকি সকলে মেনেই নিয়েছেন তৃণমূলের বাহু ও অর্থবলের কাছে কোনও আন্দোলনই দানা বাঁধানো যাবে না। অথচ ২০১১ সালে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের মতো কোন দুই অজানা গ্রামকে দিয়ে পাশা পাল্টে দেন মমতা। বিরোধীদের কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকেই বিরোধিতার পাঠ শেখা উচিত নয়?

More Articles