"তুমি নেশাগ্রস্ত, তাই ঝামেলা করেছ", কেন শাহরুখ খানকে বলেছিলেন বিগ বি?
Shah Rukh Khan: 'জিরো'-র পর বেশ কিছুদিনের বিরতি পেরিয়ে 'পাঠান', 'জওয়ান' এবং 'ডাংকি' নিয়ে ২০২৩-এ তাঁর বিস্ফোরক কামব্যাক হতে চলেছে বলে মনে করছে তাঁর ভক্তকুল।
আগর কিসি চিজ্ কো দিল সে চাহো তো পুরি কায়নাত উসে তুমসে মিলানে কি কোসিস মে লাগ যাতি হ্যায়
দিল্লির মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেটা হয়তো এই কথা বিশ্বাস করেই অভিনয় জগতে এসেছিল। তাই সময় লাগলেও প্রতিভার সঙ্গে সেই বিশ্বাস হয়তো তাঁকে শাহরুখ খান থেকে বলিউডের বাদশা হওয়ার পথ অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। প্রতিভা, পরিশ্রম এবং অসংখ্য মানুষের ভালবাসার মধ্য দিয়ে শাহরুখ তাঁর জাদু দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং পরিবর্তে এসেছে একের পর এক সুপারহিট সিনেমা, ঝুলি-ভর্তি পুরস্কার, দেশ বিদেশের অভিনেতা, পরিচালকদের প্রশংসা আর অসংখ্য ভক্ত। শুধু ভালো অভিজ্ঞতা নয়, ভক্তদের তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, ব্যবসায় লোকসান, ফ্লপ টেলিভিশন শো, সিনেমার মুক্তির আগে কিছু মানুষের সিনেমা বন্ধের হুঁশিয়ারি, ফোনে হুমকি, সহ-অভিনেত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ফিসফাস, ছেলের কারাবাসের মতো ঘটনা তাঁকে সামলাতে হয়েছে। এই ভালো-মন্দর মধ্য দিয়ে কিং খান তাঁর জীবনের তিনটে দশক বলিউডে কাটিয়ে ফেলেছেন।
১৯৮৯ সালের 'ফৌজি' সিরিয়ালের অভিমন্যু সেই সময় ঘরে ঘরে খুবই পরিচিত মুখ হলেও 'দিওয়ানা'-র রাজা সহায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে তিন বছর পর। ১৯৯২ সালে 'দিওয়ানা'-র মুক্তির সময় ঋষি কাপুরের যথেষ্ট নাম-যশ থাকলেও নায়ক হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তখন পড়তির দিকে। দিব্যা ভারতী নিজের তরফ থেকে যথেষ্ট ভালো অভিনয় করলেও সিনেমা হল সিটি, হাততালির আওয়াজে ভরে উঠেছিল যখন শাহরুখ খান পর্দায় এসেছিলেন। মুম্বইয়ের রাস্তায় বাইকে চেপে তাঁর গানের দৃশ্য দর্শকদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ অবধি তিনি সবরকম চরিত্রে অভিনয় করেছেন। 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে'-র সফল প্রেমিকের চরিত্র থেকে 'ডর' এবং 'অঞ্জাম'-এর খলনায়কের চরিত্র, ডুপ্লিকেটের ডাবল রোল থেকে 'চমৎকার'-এর সাধারণ ঘরের মুখচোরা ছেলে, সবকিছুই তাঁকে এই সময় সাফল্য এনে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন: ‘আমি না থাকলে মান্নত থাকত না’, কেন বলেছিলেন সলমন?
এই সময় মুক্তি পায় এমন দুটো সিনেমা, যার নাম এবং সংলাপ আজ অবধি মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে'-র সাফল্য এই ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায়, মুম্বইয়ের মারাঠা মন্দির সিনেমা হলে এই সিনেমা হাজার সপ্তাহ পূর্ণ করেছিল। নায়িকার জন্য দুই হাত প্রসারিত করে তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা আজও অনেকেই নকল করার চেষ্টা করেন। অন্য ছবিটি, 'বাজিগর'। তাঁর চরিত্র মানুষ যেমন আজ অবধি মনে রেখেছে, সেইরকম মনে রেখেছে সেই চরিত্রের এক বিখ্যাত সংলাপ। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় 'বাদশা'। শাহরুখের এই সিনেমা আর্থিকভাবে খুব সফল না হলেও দর্শকদের দেওয়া বলিউডের 'বাদশা' তকমা তিনি এই সিনেমার দৌলতেই পেয়েছিলেন।
নতুন শতকের প্রথম দশকে বলিউডের বাদশার একাধিক সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল । এই সিনেমাগুলোর মধ্যে 'দেবদাস', 'কভি খুশি কভি গম', 'কাল হো না হো', 'স্বদেশ', 'মহব্বতে', 'ম্যায় হুঁ না', 'ডন', 'ওম শান্তি ওম', 'মাই নেম ইজ খান' তাঁকে সাফল্য এনে দিয়েছিল। সিনেমাগুলো দর্শক এবং সমালোচকদের পছন্দ হয়েছিল। একই দশকে মুক্তি পাওয়া 'অশোকা', 'পহেলি', 'ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্থানি'-র মতো সিনেমাগুলো আর্থিকভাবে অসফল হয়েছিল।
এই দশকেই কিং খান দুটো টেলিভিশন শোয়ের উপস্থাপনা করেছিলেন। একটির ক্ষেত্রে তাঁর পরিবর্তে অমিতাভ বচ্চনকে উপস্থাপক হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। অন্য শোটি একটা সিজন চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। 'শক্তি দ্য পাওয়ার' সিনেমার শুটিংয়ের সময় পাওয়া চোটের কারণে তাঁকে বাধ্য হয়ে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল। এই চোটের ফলে তাঁর অভিনীত সিনেমার সংখ্যা কমে গেলেও তাঁর জনপ্রিয়তা কমে যায়নি। তাই হয়তো যখন 'মাই নেম ইজ খান' সিনেমা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি এসেছিল, তখন তিনি নিজের অসংখ্য ভক্তের উপর ভরসা রেখেছিলেন। তাঁর ভক্তরাও তাঁকে নিরাশ করেনি।
এই দশকের শুরুতেই আর্থিক লোকসানের ফলে জুহি চাওলার সঙ্গে শুরু করা যুগ্ম প্রযোজনা সংস্থা 'ড্রিমজ আনলিমিটেড' বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিং খান কিন্তু হার মানেননি। নতুন করে 'রেড চিলিস এন্টারটেনমেন্ট' নামে এক প্রযোজনা সংস্থা তৈরি করেন এবং দ্বিতীয়বার সফল প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। প্রত্যেকবার বাধা অতিক্রম করে হয়তো তিনি বলতে চেয়েছিলেন, আসলে 'হার কর জিতনেওয়ালে কো বাজিগর ক্যাহতে হ্যায়'।
দ্বিতীয় দশকের বেশিরভাগ সিনেমা হয় আর্থিকভাবে অসফল, নাহলে সমালোচকদের অপছন্দ। 'রা.ওয়ান', 'যব হ্যারি মেট সেজল', 'ফ্যান', 'জিরো' আর্থিকভাবে অসফল হয়েছিল। অন্যদিকে 'দিলওয়ালে', 'হ্যাপি নিউ ইয়ার', 'চেন্নাই এক্সপ্রেস'-এর মতো সিনেমা বক্স অফিসে সফল হলেও সমালোচনার মুখে পড়েছিল।
আরও পড়ুন-শাহরুখ খান: কেন আজও ভারতের ‘দ্য লাস্ট স্টার অফ দ্য স্টারস’ বাদশা
কিং খান এক সাক্ষাৎকারে এই শতকের প্রথম দশকের তাঁর এক অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। কোনও এক শুটিং চলাকালীন বলিউডের শাহেনশাহর থেকে তাঁর কর্মজীবনের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি পরামর্শ চেয়েছিলেন। উত্তরে অমিতাভ বচ্চন তাঁকে বলেছিলেন, "শাহরুখ তুমি এখন সুপারস্টার। যতটা সম্ভব ঝামেলা থেকে দূরে থাকবে, আর কোনও ঝামেলা হলে তুমি ক্ষমা চেয়ে চলে যাবে"। তখন কিং খান পালটা প্রশ্ন করেন, "আমি যদি ঝামেলা শুরু না করি, তাহলেও"? তখন অমিতাভ বচ্চন তাঁকে বলেছিলেন, "তুমি ঝামেলা করেছ কারণ তুমি নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ছিলে"। বলিউডের বাদশা তাতে অবাক হয়ে বলেছিলেন, "কিন্তু আমি যদি নেশা করে না থাকি"? অমিতাভ তখন শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, "তুমি বলিউডের সুপারস্টার। তাই তুমি নেশাগ্রস্ত থাকো। পয়সার নেশা তোমার মাথায় চড়ে গিয়েছে তাই তুমি মানুষকে মানুষ ভাবো না। তুমি যেভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করো, বেশিরভাগ মানুষ আসলে তোমার ব্যাপারে এই ধারণাই পোষণ করেন"। হালফিলের নেপোটিজমের খোঁচা কিছুটা এড়িয়ে গেলেও সমস্ত বিতর্ক বলিউডের বাদশা এড়িয়ে যেতে পারেন না।
প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে তুমুল গুঞ্জন চলেছিল টিনসেল টাউনে এককালে। 'ডন' এবং 'ডন টু'-তে দু'জনের বিদ্যুৎ খেলিয়ে দেওয়া কেমিস্ট্রি মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। কিন্তু শাহরুখের এই বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে ফিসফাস, জল্পনা একসময় এমন আকার নেয়, যার ফলে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার কেরিয়ার। মাদক কাণ্ডে আরিয়ানের গ্রেপ্তারি হোক, বা লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্যে দুয়া করা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক, কিছু না কিছু শাহরুখকে তাড়া করেই বেরিয়েছে।
পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত এমন এক অভিনেতা, যাঁর ব্যাপারে দেশ-বিদেশের মানুষের আগ্রহ। লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও থেকে মার্টিন স্করসেসি যাঁর সঙ্গে সিনেমা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। 'জিরো'-র পর বেশ কিছুদিনের বিরতি পেরিয়ে 'পাঠান', 'জওয়ান' এবং 'ডাংকি' নিয়ে ২০২৩-এ তাঁর বিস্ফোরক কামব্যাক হতে চলেছে বলে মনে করছে তাঁর ভক্তকুল। তাঁর যাত্রা যে এখনও অনেকটাই বাকি, তা তিনি নিজেও জানেন। হয়তো বলিউডের বাদশা আগামী দিনে আবার বলবেন, "পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।"