চালচিত্র এখন: সেই সত্য যা রচিবে তুমি
Chalchitra Ekhon Review: অঞ্জনের ছবিটির যে এক দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ হওয়ার অভিপ্রায় রয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সেই ইতিহাস কলকাতার উত্তাল সত্তরের পরে পরাজিত, খানিক দিশাহারা আশির দশকের ইতিহাস অবশ্যই।
গত নভেম্বরে শিকাগোয় মৃণাল সেনের শতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত সিম্পোজিয়ামে অঞ্জন দত্ত আমাদের 'চালচিত্র এখন'-এর কিছু কিছু অংশ দেখিয়েছিলেন। মৃণালপুত্র কুণাল সেনের সঙ্গে অঞ্জনের সংলাপ ছিল এর সঙ্গেই, যেখানে অঞ্জন তাঁর ছবির শেষ গানটি গেয়ে শুনিয়েওছিলেন। এরপরে ছবিটি নানা চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে, কলকাতা ও ঢাকায় পুরস্কৃত হয়েছে। কিন্তু গোটা ছবিটি দেখার সুযোগ পাওয়া গেল সবেমাত্র। এবারে ছবিটি সম্পর্কে একটু সিনেম্যাটিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া যাক। তার আগে একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। এই লেখা সংবাদপত্রের ফিল্ম রিভিউ নয়। ফলে একটি ফিল্মকে ভেঙেচুরে খামচে কারওর অভিনয়, ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফি, এডিটিং-এর দোষে দৈর্ঘ্য বেড়ে গেল কিনা (অর্থাৎ ছবির সম্পাদনার একমাত্র অর্থ ছবির দৈর্ঘ্য একটা চেনা মাপের মধ্যে সীমিত রাখা, সে মাপ আদৌ দেশকালভেদে বদলাতে পারে কিনা, সেই মাপের উৎপত্তি একটা নির্দিষ্ট ইন্ডাস্ট্রির বিশ্বব্যাপী টাকা ও ক্ষমতার প্রভাববলয় থেকে উৎপন্ন কিনা সেসব মাথায় না রেখেই) ইত্যাদি সম্পর্কে কোন মন্তব্যই এখানে করা হবে না।
মৃণাল সেন স্মরণের যে প্রাদুর্ভাব এখন দেখা যাচ্ছে বাংলা সিনেমায়, তাতে এই ছবির একটা নিজস্ব জায়গা নিশ্চয়ই থাকা উচিত, কেন না এটি মুখ্যত অঞ্জনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পুনর্নির্মাণ। সেখানে আশির দশকের কলকাতার দিকে ফিরে তাকানো আছে, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নস্টালজিয়া আছে, এবং বেশ সরল একটা স্বীকারোক্তির আদল আছে। আত্মজৈবনিক ছবির নানা রকম রয়েছে, তা অনেকসময় খুবই পরীক্ষামূলক চেহারা নিতেই পারে। অঞ্জনের ছবিটি তেমন কোনও পরীক্ষার রাস্তায় হাঁটে না। বরং সত্তর এবং/অথবা আশির দশকের প্রথমার্ধ সম্পর্কে, নিজের অতীত সম্পর্কে তিনি এর আগেও যে ধরনের ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন (দত্ত ভারসেস দত্ত যেমন) তার সঙ্গে এ ছবির নানা সাদৃশ্য রয়েছে। তাঁর ছবির ফিগারেরা ক্রমাগত এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে যাতায়াত করে। 'ফিগার' কথাটার চলচ্চিত্রতত্ত্বে একটা ব্যাপকতর অর্থ আছে, তা শেপ, ফর্ম, নানাবিধ ক্লিশে, টাইপ, আইকন, শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাসের নানা উপাদান, কখনো বা নানা ইমেজের একটা সমাহার। অঞ্জন দত্তের ছবিতে, গানে তাঁর সময়ের ও সংস্কৃতির নানা 'ফিগারের' ভিড় প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র শেষ নিয়ে আপত্তি ছিল মৃণাল সেনের
অঞ্জনের ছবিটির যে এক দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ হওয়ার অভিপ্রায় রয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সেই ইতিহাস কলকাতার উত্তাল সত্তরের পরে পরাজিত, খানিক দিশাহারা আশির দশকের ইতিহাস অবশ্যই। কিন্তু সেইটুকুই সব নয়। যদি সেসময়ের বৈশ্বিক প্রেক্ষিত দেখতে চাই, তাহলে দেখব ১৯৬৮র পরের ফরাসি ছবিতে নবতরঙ্গের অবশেষ, ব্যর্থ বিপ্লবের হতাশা, ড্রাগ ব্যবহার ও আত্মহনন, আবার নবতরঙ্গের পরিচালকদের কাজের সঙ্গে সংযোগ ইত্যাদির বিরাট ভূমিকা ছিল। ফিলিপ গ্যারেল, যাঁর ছবির পর ছবিতে এই উপাদানগুলি দল বেঁধে আসে, তাঁকে জাক রিভেত প্রমুখ নবতরঙ্গের আইকনদের, পূর্বসূরিদের ছবির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে দেখা যায়। আবার অনেক পরের সময়ের পরিচালক অলিভিয়ের অ্যাসায়াস যখন উত্তর-৬৮ প্রজন্ম বিষয়ে ছবি করেন, পত্রাকারে লিখিত একটি বই প্রকাশ করেন সেই ছবিরই সংযোজন হিসাবে, তখনও সে সময়ের হতাশ, বিক্ষুব্ধ প্রজন্মের নানা প্রধান দার্শনিক মতের সঙ্গে সংলাপের জায়গাটিই প্রধান হয়ে ওঠে। অ্যাসায়াসের বইটি গী দেবোরের স্ত্রী অ্যালিস দেবোরের উদ্দেশে লিখিত চিঠি, যা তাঁর অকালপ্রয়াত দার্শনিক সঙ্গীর দর্শনের প্রতি তাঁদের প্রজন্মের ঋণের কথা বলে।
অঞ্জনের ছবিও যেন একটা অনুরূপ চেষ্টা করে আশির দশকের প্রথমদিকের কলকাতার অবয়বের মধ্যে। তিনি কোথাও মৃণাল সেনের চালচিত্রের ক্লিপ ব্যবহার করেন না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দৃশ্যাবলীর চিত্রগ্রহণের নবনির্মাণ করেন মাত্র। সেটাও ১৯৮১-র মূল ছবির, যা দিয়ে অঞ্জন দত্তের ফিল্ম জগতে অবতরণ, তার আইকনিক দৃশ্যগুলিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, সচেতনভাবেই, নতুন করে তৈরি করার চেষ্টা করে না। যেমন বিখ্যাত সেই স্বপ্নদৃশ্যটি, যেখানে অনেক নারীর অবয়ব, প্রত্যেকের অস্ত্র জ্বলন্ত উনুনের ধোঁয়ার সন্ত্রাস। আবার দীর্ঘ যে দৃশ্যটিতে মূল ছবিতে তরুণ অঞ্জন কলকাতার ক্যাওস-আকীর্ণ পথে প্রায় বিপজ্জনকভাবে দৌড়ে বেড়াতে থাকেন ট্যাক্সির খোঁজে তারও খুব সামান্য প্রস্তাবনাটুকুই এখানে দেখা যায়। অঞ্জন তাঁর অভিজ্ঞতার ন্যারেটিভ আস্তে আস্তে বুনতে থাকেন, তার সঙ্গে মৃণাল সেনের ছবি নির্মাণ পদ্ধতির রোজের কিছু ঝলক তিনি জুড়ে দেন, তাতে থাকে কে কে মহাজনের হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা হাতে ঘোরাঘুরি, ট্যাক্সির পেছনে বসে দৃশ্যগ্রহণ, নিটোল চিত্রনাট্যের রহস্যময় অনুপস্থিতি। এর সঙ্গে মৃণাল এবং অঞ্জনের ছবি-ভাবনার, অভিনয়-ভাবনার পার্থক্যও উঁকি দেয়। সমস্যার শুরুও ঠিক এই জায়গাতেই।
অঞ্জনের ছবিতে তাঁদের দুজনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের তফাত এত বেশিবার পুনরাবৃত্ত হয় যে তাঁদের সিনেমা ভাবনার এবং অভিনেতার শরীর-ভাবনার তফাতের জায়গা অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। অঞ্জনের নিজের বাস্তববাদী অভিনয়রীতিতে আস্থা, আল পাচিনো প্রসঙ্গ অসংখ্যবার উঠে আসে, অথচ এই ধারার অভিনয়পদ্ধতির সঙ্গে মৃণাল সেনের ছবি আর সেই ছবির শরীরে অভিনেতার শরীরকে স্থাপন করার যে প্রয়াস তার কোনও মিল নেই। প্রায় অবসেসিভভাবে তরুণ অঞ্জন দত্তের চরিত্রটি (ইন্টারপ্রিটেশন: শাওন চক্রবর্তী) আল পাচিনোর রেফারেন্স ব্যবহার করতে থাকেন, করতেই থাকেন। তাঁর সঙ্গে মৃণাল সেনের (ইন্টারপ্রিটেশন: অঞ্জন দত্ত স্বয়ং) মতবিরোধ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আসে অবশ্যই, কিন্তু তার মতাদর্শগত জায়গাটাকে অঞ্জন রাজনীতির ঘেরাটোপে আটকে ফেলেন। তার বাইরে সেটি প্রসারিত হতে পারে না। প্রত্যাশিতভাবেই অঞ্জন-মৃণাল সংলাপে ইউরো-আমেরিকান রেফারেন্স ছাড়া অন্য কোনও রেফারেন্স আসেও না, মৃণাল সেনের জীবনভর দীর্ঘ ও বিস্তৃত লাতিন আমেরিকা/গ্লোবাল সাউথ সংযোগ এখানে একেবারে অনুচ্চারিত থেকে যায়।
এই দুই প্রজন্মের বৈপরীত্য আরেকটা বড় সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। ইওরোপীয়, মূলত ফরাসী ছবিতে উত্তর-৬৮ যে দুই প্রজন্মের সংযোগের কথা বলছিলাম সেখানে সংযোগের অর্থ কেবল স্মৃতিচারণ মাত্র নয়, সেখানে 'উত্তরসাধক' (শব্দঋণ: বুদ্ধদেব বসু) হওয়ার এক জটিল প্রক্রিয়া রয়েছে। বাংলা সিনেমায় মৃণাল সেন ও তাঁর সমকালের কোন উত্তরসাধক নেই। তাই মৃণাল-অঞ্জন তর্কবিতর্ক ছবির ইতিহাস, ছবিকরিয়ের নানা অবস্থান ও পর্দায় তার বিবিধ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা নিয়ে আসে না, তা ছবির বহিরঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকে।
কে কে মহাজনের চরিত্রটি (ইন্টারপ্রিটেশন: সুপ্রভাত) এ ছবিতে নিজের ভূমিকা মোটের উপর সীমাবদ্ধ রাখেন নবাগত অভিনেতাটিকে ভরসা জোগানোয়, একটা পুরুষ-বৃত্তে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে অভিনয় সম্পর্কিত কিছু গড়পড়তা আলোচনায় এবং অবিরত মদ্যপানে। এটাই মহাজন বিষয়ে অঞ্জনের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকলে সেটা খানিক হতাশাজনক, কেননা মহাজন যেভাবে ষাট-সত্তরের ভারতীয় নবতরঙ্গের প্রায় সব ধারার ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছেন তার কোনও তুলনা ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে আছে বলে মনে হয় না। ১৯৬৯-এর তিন বিখ্যাত ছবি যা নবতরঙ্গের সূচনা করেছিল, সেই 'সারা আকাশ', 'উসকি রোটি' এবং 'ভুবন সোম' তিনটিরই চিত্রগ্রাহক তিনি। মণি কাউলের প্রথম দুটি ছবি, মৃণাল সেন এবং কুমার সাহানির প্রায় সারাজীবনের কাজ, বাসু চ্যাটার্জির গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলি— সবেতেই মহাজনের নাম জড়িয়ে রয়েছে। এত বিভিন্ন এবং প্রায় পরস্পরবিরোধী সিনেমাধারার সঙ্গে তাঁকে যুক্ত দেখতে পাই যে তাঁর বৈচিত্র্যের, সেই সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কোনও চিহ্ন তাঁর অবয়বে না পেয়ে হতাশ হতে হয়।
'চালচিত্র এখন'-এর সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ বলে মনে হয় এমন কয়েকটি দৃশ্যের জোটকে, যাদের সঙ্গে মূল ছবিটির আপাত সম্পর্ক নেই কিছু। আমি অঞ্জন এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন তরুণ নাট্যদলের পিটার ভাইসের Marat/Sade রিহার্সালের অংশটির কথা বলছি। অঞ্জন যখন এই নাটক মঞ্চস্থ করতে চাইছেন, ততদিনে এটি নিয়ে পিটার ব্রুকের ফিল্মও তৈরি হয়ে গিয়েছে, ১৯৬৭-তে। এই বিশ্বখ্যাত পরীক্ষামূলক নাট্য-টেক্সটটি 'থিয়েটার অব ক্রুয়েলটি' থেকে অ্যাবসার্ড থিয়েটার-সহ নানাবিধ নাট্যঘরানার সঙ্গে সম্পৃক্ত, যাদের কোনওটাই বাস্তববাদী অভিনয়রীতির অনুসারী নয়। অথচ তরুণ অঞ্জন এই রিহার্সালের সময়েই তাঁর অভিনেতাদের কাছে ফের আল পাচিনোর মতো অভিনয় করার দাবি করতে থাকেন। এই অস্বস্তিকে সরিয়ে রেখে তার ঠিক আগের অংশে, রিহার্সাল পর্বে আসা যেতে পারে।
রিহার্সাল এখানে মঞ্চে নয়, ঘরে। তার পাশে উঠে যাওয়া সিঁড়ি। সেই সিঁড়িতে অভিনেত্রীরা কয়েকজন বসে থাকেন। ক্যামেরা ধীরে ধীরে বাইরে থেকে ঘরের ভিতরে এগিয়ে আসে, সেখানে মাটিতে বসে মার্কি দে সাদের চরিত্রাভিনেতা তরুণ অঞ্জন (শাওন)। দৃশ্য ও সংলাপ মূল নাটকের প্রথম অঙ্কের একটি অংশ, সেখানে দে সাদের একক উক্তি চলতে থাকে, এবং শার্লট কোরদের চাবুক চলতে থাকে দে সাদের পিঠে। ঠিক এই অংশটিই কেন বেছে নিলেন অঞ্জন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেননা এখানে প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ও অ্যানার্কিক চরিত্রের দে সাদ ফরাসী বিপ্লবের সন্ত্রাস, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকারের চরম নিষ্পেষণ সম্পর্কে বিপ্লবী জঁ-পল মারাকে উদ্দেশ্য করে তাঁর আতঙ্কের ধারাবিবরণী চালিয়ে যান নাটকীয় একোক্তির ঢঙে। পর্দায় এখানে দে সাদ রূপী অঞ্জন (শাওন)-এর ক্লোজ শট, তাঁর দৃষ্টি উপরের দিকে নিবদ্ধ, প্রতিটি চাবুকের ঘার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আর্তনাদ শোনা যায়। পরে এই নাট্যকর্মের আরও একটি সংলাপ, অন্য অংশ থেকে, মাঝে মাঝে ছবিতে ঘুরেফিরে আসবে।
এই রচনার এক অংশে ফরাসি নবতরঙ্গ এবং তার উত্তরসাধনা প্রসঙ্গে এনেছিলাম জাক রিভেতের কথা, তাঁর প্রায় আজীবনের ছবি, থিয়েটারের নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। তা কখনো প্রাচীন গ্রিসের ইস্কাইলাস, কখনো বা সপ্তদশ শতকের ফ্রান্সের জঁ রাসিন। ভারতীয় সিনেমায় থিয়েটারের সঙ্গে এমন পরীক্ষামূলক অর্গানিক সম্বন্ধ বলতে যা প্রথমেই মনে পড়ে তা 'কোমল গান্ধার'। আমি এখানে থিয়েটারের ফিল্মের ভাষায় অ্যাডপ্টেশনের কথা বলছি না, কেননা সেরকম উদাহরণ অনেক। ষাটের দশকের ভারতীয় থিয়েটারের বিশিষ্ট নাট্যকারেরা প্রায় সকলেই নবতরঙ্গের ছবির সঙ্গে হয় সরাসরি যুক্ত, নয় নানা মালমশলা সরবরাহ করেছেন।
নবতরঙ্গের এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ ফিল্মমেকারকে স্মরণ করতে গিয়ে, নিজের স্মৃতির কাছে ফিরে আসতে গিয়ে অঞ্জন দত্ত যে 'Marat/Sade' এর মতো অতি জটিল এবং বহুস্তরীয় টেক্সটের আশ্রয় নেন, তা আমাদের কৌতূহলী করে। কিন্তু এই দৃশ্যের অমিত সম্ভাবনা ছবিটি পূর্ণ করতে পারে না। যে সমান্তরাল দৃশ্য তিনি এখানে তৈরি করতে চান, অর্থাৎ দে সাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা আর মারার বৈপ্লবিক রাজনীতির দ্বন্দ্বের সঙ্গে অঞ্জন ও মৃণালের রাজনীতির দ্বন্দ্ব তা ছবির ন্যারেটিভ আশ্রয় করেই থেকে যায়, ছবির উপরিতলে ঘুরে বেড়ায়। ছবিশরীরের অন্তর্ভুক্ত হবার সম্ভাবনা থাকলেও শেষমেশ হয়ে ওঠে না তা। 'Marat/Sade' আর 'চালচিত্র' (১৯৮১) দুই-ই তো অসম্ভাব্যতার শিল্প, বস্তুত সিনেমা তার সমস্ত শরীর জুড়ে যাকে অনেকসময়েই ধরে রাখে তা আসলে নানা ফর্মের 'ইমপসিবিলিটি'। অথচ এই দুইয়ের মধ্যে কোনও সংলাপ গড়ে ওঠে না।
আরও পড়ুন:মৃণাল সেনের ছবিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল মধ্যবিত্তের রান্নাঘর
কে কে মহাজন তরুণ অঞ্জনকে নিয়ে মদ্যপানের এবং খানিক ধমকানির অংশগুলিতে তাঁদের (অর্থাৎ তাঁর ও মৃণাল সেনের ক্যামেরা) কীভাবে সত্যকে ধরে, সত্য অর্থাৎ বাস্তব, এবং অঞ্জনের নিজের শরীর নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগা কেন অর্থহীন তা নিয়ে কথা বলতে থাকেন। এখানে মনে পড়তে পারে যে সত্য আর বাস্তব সবসময়েই এক নয়, অন্তত কে কে মহাজনের কাছে তো নয়ই, কেননা ততদিনে তাঁর 'উসকি রোটি' বা 'মায়া দর্পণ' শুট করা হয়ে গিয়েছে, 'তরঙ্গ'-ও বাজারে আসবে কয়েক বছরের মধ্যেই, ১৯৮৪ তে। মহাজনের 'ফিগারে'র সঙ্গে সম্পৃক্ত নানা ইমেজ আর তার সাংস্কৃতিক ইতিহাস যদি মনে করি (এবং তা না করতে পারলে ছবিটা পড়াও যাবে না) তাহলে এই বিশ্বাসেই পৌঁছনো চলে যে ঘটে যা তা সব সত্য নয়। সেই রচিত সত্যের ইঙ্গিত, সম্ভাব্যতা, আর ক্রমাগত ভেঙে যাওয়াই ছিল ১৯৮১-র চালচিত্রের আসল কাঠামো। ২০২৪ এর ছবিটি বরং তার গুরুত্ব ও সুযোগ সত্ত্বেও কেবলই ব্যক্তিগত দৃশ্যের জন্ম দেয়।