এআই যতটা গর্জাচ্ছে ততটা বর্ষাবে?

AI Revolution: এই এআই বিপ্লব এখনও উপন্যাসের মধ্যভাগে, পথচলা অনেক বাকি, সবেমাত্র চরিত্ররা নিজস্ব ছাপ ছেড়ে যাচ্ছে, ক্লাইম্যাক্স এখনও অনেক দূর।

AP

দুনিয়ার এখন এমন এক অবস্থা যে দোকানে কিছু দিন আগেও লেখা থাকত 'ফোন রিচার্জ করা হয়', সেখানে কয়েক দিন পর হয়ত বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকবে 'এখানে সুলভ এআই দিয়ে প্রেম পত্র লেখা হয়'। লিফটম্যান, লেকচারার, গ্রন্থাগারিক সবাই এক কথাই বলছেন, 'এআই এলে আর মানুষকে নাকি কাজ করতে হবে না!' শুনলে মনে হয় বাঙালির হাতে চাঁদ। কিন্তু বিধি বাম। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যারন অ্যাসেমোগলুর গলায় উল্টো সুর। তিনি বলছেন, হুজুগ কমান। সব বিপ্লবের শব্দ বড় হয় না, প্রযুক্তির ইতিহাস বলে বিপ্লবের শব্দ অনেক সময় গুগল ড্রাইভের নোটিফিকেশনের মতো নিশ্চুপে আসে।

ড্যারন অ্যাসেমোগলুরের নতুন গবেষণাপত্র 'The Simple Macroeconomics of AI-এ কাগজ, কলম, ক্যালকুলেটর নিয়ে তিনি হিসেব কষে দেখিয়েছেন এই বহুল ঘোষিত এআই বিপ্লব আসলে কোনও বড় ঢেউ নয়, একটা ছোট তরঙ্গমাত্র। তিনি লিখছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আগামী দশ বছরে মোট উৎপাদনশীলতা (TFP) বাড়াবে মাত্র ০.৫৩% থেকে ০.৬৬%, এক চিমটে নুনের মতো। ভাবুন, পৃথিবীতে এত সব বড় টেক কোম্পানি, লাখ লাখ সার্ভার, কোটি কোটি কোড লাইন থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতির গায়ে ঠান্ডা বাতাস লাগছে না ঠিকঠাক। অ্যাসেমোগলু বলছেন, প্রযুক্তি তখনই বদল আনে, যখন তা শুধু ডেটা বিশ্লেষকের ডেস্কে নয়, দোকানির ঘরেও কাজে লাগে।

কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনও কেবল সহকারী মাত্র। ফাইল সাজায়, ই-মেল লেখে, ডেটা খোঁজে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজের ধরন বদলাচ্ছে বটে, তবে সমাজ বদলাচ্ছে কি? গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২০% কাজ এআই দ্বারা প্রভাবিত, কিন্তু তার মধ্যে মাত্র এক চতুর্থাংশই আদপে স্বয়ংক্রিয়। ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার বাড়লেও বাড়বে সর্বাধিক ১.৫৬%। সেটাও মূলধনের সাহায্যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একার ক্ষমতায় নয়।

আরও পড়ুন

এবার হাতের লেখা, সইও নকল করবে এআই! আপনি নিরাপদ তো?

অ্যাসেমোগলু বলছেন, এআই ছবি দেখে হয়ত সহজেই বুঝতে পারে সামনের লোভনীয় বস্তুটি ‘বিরিয়ানি’। কিন্তু সেই বিরিয়ানির গন্ধে স্মৃতি আছে কিনা তা জিজ্ঞেস করতে গেলেই এআই-এর উত্তর হবে হয়ত Error 404। শ্রেণিবিন্যাস বা ডেটা সাজানোর মতো সহজ কাজ এআই-এর হাতে নিখুঁত, কিন্তু জটিল পারিবারিক থেরাপি, কূটনৈতিক আলোচনা যেখানে, সেখানে এআই এখনও ফার্স্ট বেঞ্চের ভয় পাওয়া ছাত্রটি।

অ্যাসেমোগলুর সহকর্মী, MIT-এর বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ডেভিড অটর বরং আশাবাদী। তিনি বলছেন, জেনারেটিভ এআই সাধারণ মানুষকেও বিশেষ দক্ষতা ব্যবহার করতে দিচ্ছে। এতে মধ্যবিত্ত হারানো চাকরি ফিরে পেতে পারলেও পারে। কিন্তু অ্যাসেমোগলু সতর্কবার্তা দিয়েছেন, তাঁর মতে, সব প্রযুক্তি মামদানির মত সমাজতন্ত্রী নয়। অভিজ্ঞতা বলছে নতুন কাজ মানেই নতুন স্কিল, আর নতুন স্কিল মানেই ইউটিউবে পনেরো মিনিটে প্রফেশনাল লার্নিংয়ের সার্চ।

বৈষম্যের গল্পটা কোথায়? এই প্রযুক্তির লাভ কোথায় যাবে? হয়ত যেখানে কাঁচের দালান, ল্যাপটপ বা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর সেখানে। কিন্ত গরিবের কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিনি দুধ কম, জল বেশি এমন চায়ের থেকে বেশি কিছু কি হবে আদপে?

অ্যাসেমোগলুর বক্তব্য যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জিডিপি বাড়িয়েছে, কিন্তু সামাজিক শান্তি কমিয়েছে, এআই-ও ঠিক সেই পথে হাঁটছে। অর্থাৎ, জিডিপি খুশি হলেও, সমাজ কাঁদবেই। এআইও হয়ত অর্থনীতিতে নতুন সংখ্যা যোগ করবে, কিন্তু মানুষের সম্পর্কের অঙ্ক হয়ত আরও জটিল হবে। এআই আসলে পারিবারিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মতো দেখবে, কিন্তু সাড়া পাবেন না।

আরও পড়ুন

মিথ্যেবাদী অনৈতিক এআই, মানুষ তাকে সামলাতে পারবে?

গোল্ডম্যান স্যাক্সের গবেষকরা কিন্তু আশাবাদী। তাঁদের মতে, এআই আগামী বছরগুলোতে গড়ে ১.৫% হারে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারবে। নব্বইয়ের দশকের আইটি বিপ্লব, যেমন একসময় নতুন কাজের দুনিয়া খুলে দিয়েছিল ঠিক তেমনই হবে ব্যাপারটা। কিন্তু অর্থনৈতিক সংগঠন রিচমন্ড ফেড জু ঝাং মনে করিয়ে দেন, যত বড় প্রযুক্তি, তত জটিল রূপান্তর। এআই এখনও কেবল প্রাথমিক শ্রেণিতে অর্থাৎ, পরীক্ষার খাতা এখনও খোলেনি তার।

অ্যাসেমোগলুর গবেষণায় একটি উদ্বেগজনক তথ্যও সামনে এসেছে। কম শিক্ষিত শ্রমিকরা আয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মূলধন ও শ্রমের ব্যবধান তো বাড়বেই, সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং পোস্ট ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর কিছু করবে কিনা সেইটেই সন্দেহের। এই এআই বিপ্লব এখনও উপন্যাসের মধ্যভাগে, পথচলা অনেক বাকি, সবেমাত্র চরিত্ররা নিজস্ব ছাপ ছেড়ে যাচ্ছে, ক্লাইম্যাক্স এখনও অনেক দূর। সেই পথচলায় আমরা হয়ত আবার শিখব,অর্থনীতি শুধু সংখ্যার হিসেব নয়, তারও উপরে আছে জীবনের ব্যালান্স শিট। চা খান, সময় দিন, এআই দুনিয়া এখনও 'লোডিং' মোডে আছে।

More Articles