ইন্ডিগো-বিপর্যয়: কেন ভোলবদলে গেল অর্ণব গোস্বামীর?
IndiGo crisis: এবার ইন্ডিগো-বিপর্যয়ের ঘটনায় তাঁর হঠাৎ ভোলবদল হয়ে যাওয়া, ইন্ডিগোর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বরং ‘অপারেশনাল সমস্যার’ অজুহাত দিয়ে ইন্ডিগোকে রক্ষার চেষ্টা— আসলে চমকে দিয়েছে দর্শকদের।
অর্ণব গোস্বামীকে চেনেন দেশের সবাই— সরাসরি আক্রমণ, উচ্চস্বরে প্রশ্ন, ক্ষমতার সঙ্গে নির্লজ্জ ঘনিষ্ঠতা কিংবা বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে নাটকীয় চিৎকার, সবেই তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। কিন্তু এবার ইন্ডিগো-বিপর্যয়ের ঘটনায় তাঁর হঠাৎ ভোলবদল হয়ে যাওয়া, ইন্ডিগোর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বরং ‘অপারেশনাল সমস্যার’ অজুহাত দিয়ে ইন্ডিগোকে রক্ষার চেষ্টা— আসলে চমকে দিয়েছে দর্শকদের। অর্ণব আসলে কার পক্ষে, মোদি সরকারের নাকি ইন্ডিগোর? যে সরকারের তিনি নয়নের মণি ইন্ডিগোর জন্য তাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছেন? কার জন্যে? সরকার পক্ষের কৌশলী হিসেবেই যাঁর পরিচয় যিনি সরকারের মান বাঁচাতে যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারেন। তিনি হঠাৎ একটি প্রতিষ্ঠানকে আড়াল করতে মরিয়া?
আসলে এক্ষেত্রে দুর্বল সরকার, বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য— এই দুই মিলেই তৈরি হয়েছে এমন পরিস্থিতি যখন 'সর্বশক্তিমান' সাংবাদিকও আজ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় চেঁচাতে পাড়ছেন না। তাই বলাই বহুল্য, ইন্ডিগোর-বিপর্যয় শুধু বিমান বাতিলের সমস্যা নয়, এটি ভারতীয় ক্ষমতা-অর্থনীতির গভীরতম অসুস্থতার মুখোশ খুলে দিয়েছে।
পাইলট-ক্রু নিয়োগ থেকে শুরু করে শিডিউল ম্যানেজমেন্ট ইন্ডিগোর সব জায়গাতেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। রাতের ফ্লাইটের চাপ সামলাতে না পারায় দেশের বড় বড় বিমানবন্দরগুলিতে পরপর বাতিল হতে থাকে ফ্লাইট। ৬ ডিসেম্বর সকালে দিল্লিতে ১০৬টি আর মুম্বাইয়ে ১০৯টি ইন্ডিগো ফ্লাইট বাতিল হয়। বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, চেন্নাইও বাদ গেল না। একদিনে হাজারেরও বেশি ফ্লাইট বাতিল হওয়া নজিরবিহীন। আর তাতেই ভোগান্তি হলো যাত্রীদের। কেউ বিয়েতে যাচ্ছিলেন— জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিন মিস করেছেন। কেউ বিদেশমুখী কর্মক্ষেত্রের দরকারে দিল্লি থেকে মুম্বাই, বা বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতা ফ্লাইট ধরতে চেয়েছিলেন, ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় চাকরি-সংক্রান্ত মিটিং-এও যাওয়া সম্ভব হয়নি। অনেকেই আবার চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন, কোনো সাহায্য না পেয়ে বিমানবন্দরের মেঝেতে বসে রাত কাটিয়েছেন রোগীরাও। শিশুদের স্কুলের পরীক্ষা, বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর ভিসার সময়, সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার নোটিসে বাতিল হওয়া ফ্লাইটের জন্য।
আরও পড়ুন
ইন্ডিগোর ১০০০ ফ্লাইট বাতিল! ভোগান্তির দাম কি শুধুই কেতাদুরস্ত ‘সরি’?
দেখা গেল, নতুন নিয়ম কার্যকর হওয়ার আগেই সঙ্কট তৈরি হয়েছে ইন্ডিগোতে। এই বিশৃঙ্খলা দেখে কেন্দ্রীয় বিমান মন্ত্রক ও DGCA তড়িঘড়ি হস্তক্ষেপ করে। DGCA এককালীন বিশেষ ছাড় দেয়, রাতের ফ্লাইটে সীমাবদ্ধতা সাময়িকভাবে তুলে নেওয়া হয়, পাইলটদের সাপ্তাহিক ছুটিকে সাপ্তাহিক বিশ্রাম হিসেবে গণ্য করার সুযোগ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এ যেন দেশব্যাপী বিমান চলাচল রক্ষার জরুরি অস্ত্র। কিন্তু এই ছাড় ইন্ডিগোর জন্য বিশেষভাবে দেওয়া হলেও অন্য এয়ারলাইনগুলিকে তা দেওয়া হয়নি, যদিও এই নিয়ে পাইলট ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনগুলি তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, এই নিয়ম চালু করা হয়েছিল পাইলটদের ক্লান্তি কাটাতে এবং নিরাপত্তা বাড়াতে। এখন নিরাপত্তা কমিয়ে, যাত্রী-ভোগান্তি কমাতে গেলে তার মূল্য কি ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে না? উঠছে সেই প্রশ্নও।
ইন্ডিগো থেকে দাবি উঠল, এই মুহূর্তে নিয়ম মানা সম্ভব নয়। আর ব্যস, DGCA নিয়ম পিছিয়ে দিল। এতেই প্রমাণ হয়, ভারতের বিমান সেক্টরকে শাসন করছে নীতিনির্ধারক নয়, ইন্ডিগো। সরকার নিরাপত্তার নাম করে নিয়ম করল, আবার ইন্ডিগোর জন্যই নিয়ম শিথিল করল। প্রশ্ন উঠছে, এই দ্বিমুখী অবস্থান কেন?
প্রথমেই বুঝতে হবে, নতুন নিয়ম চালুর আগে প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্ডিগোর ঘাটতি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু যে নতুন FDTL (Flight Duty Time Limitation) নিয়ম নিয়ে এই বিশৃঙ্খলা শুরু, তা হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। বরং পাইলটদের দীর্ঘদিনের দাবি, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতেই এই নতুন নিয়ম বহু আগেই তৈরি হয়েছিল। নতুন নিয়মে বলা হয়েছে, রাতে টানা ডিউটি কমাতে হবে, সপ্তাহে বাধ্যতামূলক ৪৮ ঘণ্টা বিশ্রাম দিতে হবে, পাইলটের উপর অতিরিক্ত চাপ কমাতে হবে ইত্যাদি। এগুলো কোনো বিলাসিতা নয়, মানুষের ক্লান্তি কাটাতে এবং বিমান কর্মীদের নিরাপত্তাজনিত প্রয়োজন। কিন্তু এই নিয়মেই ইন্ডিগোর কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। কেন?
ইন্ডিগোর ব্যবসায়িক মডেলই দাঁড়িয়ে আছে কম কর্মী, বেশি ফ্লাইট, বেশিক্ষণ আকাশে থাকা, ভালো মুনাফায় যাত্রীদের পৌঁছনোর ব্যবস্থাপনায়। পাইলট-স্টাফ সংখ্যা সবসময়ই ছিল ন্যূনতম। দীর্ঘদিন ধরে পাইলটরা অভিযোগ জানিয়েছিলেন, বিশ্রাম না পাওয়া, অতিরিক্ত চাপ, অতিরিক্ত শিডিউল, অপর্যাপ্ত লোকবল নিয়ে। এইসব কিছুই এখন ইন্ডিগোকে আজকের এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু ইন্ডিগো এই সমস্যাকে সমাধান না করে বরং নতুন নিয়মের দিকেই আঙুল তুলছেন। অথচ দেশের সবচেয়ে বড় বাজেট এয়ারলাইন এটি। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ সফর করেন এই এয়ার লাইনে।
অর্ণব গোস্বামী তাঁর প্রাইম টাইম শো-তে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে— কেন্দ্রীয় সরকার, DGCA এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রককে জবাবদিহি করতে হবে। তাঁর কথায়, আর এত কিছুর পরও বলা হয়, সরকার নাকি বিমান চলাচল খাতে প্রচুর কিছু করেছে। অর্ণব প্রশ্ন তোলেন, DGCA নতি স্বীকার করল, কিন্তু যাত্রীরা কি রক্ষা পেলেন? কিছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির জন্য কিছু করে থাকতে পারে, কিন্তু তা কি বিমান চলাচল খাতের জন্য সত্যিই ভালো?
প্রশ্ন হলো, ইন্ডিগোর এই ব্যর্থতাকে কেন অর্ণব প্রোপাগান্ডা দিয়ে ঢাকলেন? আসলে ইন্ডিগো আজ ভারতের বিমান ব্যবস্থার শাসক। ইন্ডিগো অচল হয়ে পড়লে যে গোটা বিমান-পরিকাঠামোই বড় ধাক্কা খাবে, তা আর নতুন করে বলতে হয় না। আজ দেশের ডোমেস্টিক উড়ানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ইন্ডিগো নিয়ন্ত্রণ করে। দেশে যত ছোট-বড় বিমানবন্দর রয়েছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই ইন্ডিগোর উপর নির্ভরশীল। শিডিউল ভেস্তে গেলে কেবল যাত্রী নয়, বিমানবন্দর, গ্রাউন্ড স্টাফ, কার্গো, কানেক্টিং ফ্লাইট, সব ক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়ে।
যে দেশে জেট, এয়ার ডেকান, স্পাইসজেট, কিংফিশার, গো ফার্স্ট— একের পর এক এয়ার লাইন ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে, সেখানে প্রতিযোগিতা বলে কিছু নেই। এতে ইন্ডিগো একক আধিপত্যে পৌঁছে গিয়েছে। এই অবস্থায় সরকারের মনে ভয় কাজ করছে যে ইন্ডিগোর সঙ্গে সংঘাত মানে জাতীয় পরিবহণে অচলাবস্থা। তাই যে নিয়ম সবার জন্য করা হয়েছিল, সেই নিয়মই ইন্ডিগোর চাপে এসে শিথিল হলো। এর জন্য মিডিয়ার সুরও বদলে গেল। অভিযোগ, অর্ণব গোস্বামী হঠাৎ ইন্ডিগোর প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন, আসলে সরকারের দুর্বলতা আর দ্বিচারিতাকে আড়াল করতে। বলতেই হয়, এটি ক্ষমতার সামনে মিডিয়ার আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আরও পড়ুন
এমন পরিস্থিতিতে অর্ণবদের মুখে নরম ভাষা আসবেই। কারণ সরকারের উপর চাপ আছে, কর্পোরেটের উপর নির্ভরতা আছে, আর মিডিয়া আজ দুই শক্তির মাঝখানে এক বিমূর্ত ‘সার্ভিস ইউনিট’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সাংবাদিকের ভূমিকা আজ আর প্রশ্ন করা নয়, বরং ক্ষমতার ইচ্ছে মতো 'না-বলা কথাকে' ঢেকে রাখা।
এখন প্রশ্ন, দায় কার? সরকার না ইন্ডিগো? সরকার যুক্তি দিয়েছে, আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে নিয়ম করেছিলাম। কিন্তু যাত্রী ভোগান্তি সামলাতে নিয়ম শিথিল করতে হয়েছে। ইন্ডিগো বলছে, নিয়ম অত্যন্ত কঠোর ছিল, তাই শিডিউল ভেস্তে গিয়েছে। কিন্তু সত্য অন্যত্র। ইন্ডিগো দীর্ঘদিন ধরে জানত এই নিয়ম আসছে। তবুও তারা পাইলট নিয়োগ করেনি। রোস্টার বদলায়নি। দায়িত্ব রাজনীতির উপর ঠেলে দিয়েছে। কেন দেশে একটি এয়ারলাইন এমন অবস্থায় পৌঁছে গেল, যেখানে তার সমস্যাই হয়ে দাঁড়ায় জাতীয় সংকট?
এখানেই আসে ‘মোনোপলি’ প্রসঙ্গ ,যা রাষ্ট্রকে গিলে নিতে পারে। ইন্ডিগো-বিপর্যয়ে শাসক, আমলাতন্ত্র এবং কর্পোরেট এই তিনের দায় সমান। আর অর্ণব গোস্বামীর ভোলবদল আসলে এই বৃহত্তর স্ৱার্থ গোষ্ঠীর কথা মনে রেখেই, যে স্ৱার্থগোষ্ঠীর গোলামি তিনি দীর্ঘকাল করে এসেছেন।
অর্ণবের সুর বদল নিয়ে হাসাহাসি করা সহজ, কিন্তু তাতে আড়াল হয় ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। কারণ, যখন বাজার একজনের হাতেই এত বড় হয়ে যায় যে সরকার তার নিয়ম বদলাতে বাধ্য হয়, তখন মিডিয়ার ভাষাও সেই বাজারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আসলে সরকার এবং অর্ণব ভাই-বেরাদরি পুঁজিবাদের দালালি করছেন। ইন্ডিগো-বিপর্যয় আবারও এই সত্যকে এত নগ্নভাবে সামনে এনে দিয়েছে।
একটি সংস্থার আধিপত্য জাতীয় নীতি পর্যন্ত প্রভাবিত করছে। আর সেই শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে মিডিয়া চুপ, বা নরম, বা সুবিধাজনক ভাষায় কথা বলছে। অর্ণব গোস্বামীর হঠাৎ ভাষা বদলে যাওয়া তাই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি সেই বৃহত্তর কাঠামোর উপসর্গ, যেখানে ক্ষমতা, অর্থনীতি ও মিডিয়া একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে এমন এক বলয় তৈরি করেছে যার বাইরে সত্য বলার জায়গা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

Whatsapp
