দিল্লিতে কৃত্রিম বৃষ্টি! ক্লাউড সিডিং কি পারবে রাজধানীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে?

Delhi’s Pollution: প্রধানত তিন ধরণের মেঘে ক্লাউড সিডিং করা হয়: স্থির মেঘ, গতিশীল মেঘ ও হাইগ্রোস্কোপিক বা জল শোষণকারী মেঘ।

দূষণ কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না দিল্লির। কলকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া, পড়শি রাজ্য পঞ্জাব, হরিয়ানার চাষের জমিতে পড়ে থাকা ফসলের গোঁড়া (চলতি ভাষায় যাকে আমরা ন্যাড়া বলি) পোড়ানোর ধোঁয়ায় কার্যত দমবন্ধ হয়ে আসছে রাজধানীর বাসিন্দাদের। উপরন্তু দীপাবলির আতশবাজির কারণে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে; বাতাসের গুণগত মান (একিউআই) সূচক এখন ভয়ানক অবস্থায় (৩০০ এর কাছাকাছি) রয়েছে, আর একটু পরিস্থিতি অবনতি হলে যে কোনো মুহূর্তে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। উদ্বেগজনক এই অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য দিল্লি সরকার ‘ক্লাউড সিডিং’ বা কৃত্রিম বৃষ্টিপাত করাচ্ছে। পরিস্থিতি সব ঠিক থাকলে ২৮, ২৯ ও ৩০ অক্টোবর, এই বৃষ্টিপাত হবে। ইতোমধ্যেই, আইআইটি কানপুর থেকে মিরাট, খোকার, বুরারি হয়ে দিল্লিতে ক্লাউড সিডিং-এর পরীক্ষামূলক অভিযান চালিয়েছে দিল্লি সরকার।

কী এই ক্লাউড সিডিং?

অত্যাধুনিক এই পদ্ধতিতে, রকেট, বিমান বা ড্রোনের সাহায্যে মেঘের উপর স্প্রে করা হয় সিলভার আয়োডাইড (AgI) নামক রাসায়নিক পদার্থের গুঁড়ো, এটি রুপো ও আয়োডিনের সংমিশ্রণে তৈরি যৌগ যা কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় কীটনাশক ও দৈনন্দিন জীবনে অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়, এমনকি ফটোগ্রাফিতেও এর ব‍্যাপক প্রয়োগ রয়েছে। এই কাজে পটাশিয়াম আয়োডাইড ও ব‍্যবহার করা যেতে পারে। তবে, ১৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সিলভার আয়োডাইডের সবচেয়ে স্থিতিশীল রূপটি ষড়ভুজাকার, যেটির সঙ্গে বরফের আণবিক গঠনের প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে; প্রতিটি রূপার পরমাণু চারটি আয়োডাইড পরমাণুর সঙ্গে টেট্রাহেড্রাল বা চতুস্তলক বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, একইরকম ভাবে বরফের কেলাসের প্রতিটি অক্সিজেন পরমাণু, তার পার্শ্ববর্তী চারটি জলের অণুর সঙ্গে টেট্রাহেড্রাল হাইড্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। সেই কারণে, কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রথম পছন্দ এই রাসায়নিকের গুঁড়ো।

আরও পড়ুন

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজের মতামতের যুৎসই ব্যখ্যা দিতে পারবে?

এই গুঁড়ো গুলোর চারপাশে দ্রুত বরফ কণা জমতে শুরু করে, ফলে ক্রমাগত ভারী হতে থাকে। ভর বাড়তে বাড়তে সীমাস্থ মান অতিক্রম করে গেলে এই কণাগুলি আর আকাশে ভেসে বেড়াতে পারে না, ঝরে পড়ে পৃথিবী বক্ষে।

প্রধানত তিন ধরণের মেঘে ক্লাউড সিডিং করা হয়: স্থির মেঘ, গতিশীল মেঘ ও হাইগ্রোস্কোপিক বা জল শোষণকারী মেঘ। প্রথমটির ক্ষেত্রে তুষারপাত বা বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির জন্য ঠান্ডা মেঘের মধ্যে রাসায়নিকের প্রয়োগ করা হয়, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মেঘের মধ্যে উল্লম্ব বায়ু চলাচল বাড়াতে রাসায়নিক অনুঘটকের সাহায্য নেওয়া হয়, আর উপকুলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির ফোঁটা গঠনের হারকে তরান্বিত করার জন‍্যে হাইগ্রোস্কোপিক মেঘে বপন করা হয় রাসায়নিকের গুঁড়ো ।

এই কৃত্রিম বৃষ্টিপাত কতটা পরিস্কার করতে পারবে দিল্লির বাতাস? এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর নির্ভর করছে মেঘের আদ্রতা, বাতাসের তাপমাত্র ও গতিপথ, কতটা জায়গা জুড়ে ক্লাউড সিডিং করা হবে, এই সব বিষয়ের উপর। গবেষণায় দেখা গেছে শতকরা ২০% পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে এই ক্লাউড সিডিং। দিল্লির বাতাসে উপস্থিত পিএম 2.5 ও পিএম 10-এর দূষণ সৃষ্টিকারী কণাগুলো ধুয়ে ফেলতে পারে কৃত্রিম বৃষ্টি। তবে এই স্বস্তি সাময়িকের, বিশেষজ্ঞদের দাবি দু-এক দিন পরেই আবার দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকবে।

আরও পড়ুন

আমেরিকা বনাম চিন! চাঁদ জয়ের যুদ্ধে কে এগিয়ে?

১৯৪৬ সালে জন্ম নেওয়া এই ধারণার প্রথম প্রয়োগ হয় ভিয়েতনামের যুদ্ধে, সেই শুরু। তারপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন বিমান বন্দরে কুয়াশা নিয়ন্ত্রণে, দাবানল নিয়ন্ত্রণে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে), দরকারে বৃষ্টির গতিপথ পরিবর্তন করতে (২০০৮ সালে চিনের বেজিং অলিম্পিকের সময়) এই প্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে আসছে। মধ‍্যপ্রাচ‍্যের রুক্ষ অঞ্চলে, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে খরা পরিস্থিতি সামাল দিতে কাজে লাগে এই ক্লাউড সিডিং। ভারতে, এবারই প্রথম নয়, খরার মোকাবিলার জন্য আগে ও এই প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে; মহারাষ্ট্রের মারাঠওয়াড়াতে দীর্ঘদিন অনাবৃস্টির কারণে খরার সৃষ্টি হলে সাহায্য নেওয়া হয় এই কৃত্রিম বৃষ্টির। এবার, দেশের রাজধানীতে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সাহায্য নেওয়া হবে এই প্রযুক্তির।

তবে, এটি কখনোই দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়, সেজন্য অনেক বিশেষজ্ঞরাই বায়ুদূষণের প্রকৃত কারণ চিহ্নিত না করে, ক্লাউড সিডিং-এর সিদ্ধান্তকে চটকদার বলে মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি অনেকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে– বৃষ্টির জলের সঙ্গে রাসায়নিক মিশে আমাদের ত্বক বা শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে কি না। তবে গবেষকরা হিসাব করে দেখেছেন এই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সিলভার আয়োডাইডের পরিমাণ খুব কম হওয়ায় আমাদের উপরে বিশেষ প্রভাব পড়বে না, কিন্তু বারংবার এই প্রযুক্তি ব্যবহার বাস্ততন্ত্রে ছাপ ফেলতে বাধ‍্য। সেই সঙ্গে আর একটা আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা– যদি অসাবধানতাবশত ক্লাউড সিডিং কখনও তীব্র বৃষ্টিপাতের সঙ্গে মিশে যায়, তাহলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির দায় কে নেবে? সেজন্য সমস্যা সৃষ্টির কারণকে সমূলে বিনাশ না করতে পারলে, কৃত্রিম বৃষ্টিপাত মানুষকে স্থায়ী কোনো স্বস্তি দিতে পারবে না।

More Articles