ভয়াবহ ভূমিকম্পের কবলে বাংলাদেশ, ক্ষয়ক্ষতি ঠিক কতটা?

Bangladesh Earthquake: বাংলাদেশের পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি সাবস্টেশনে ভূমিকম্পের পরই আগুন ধরে যায়। যন্ত্রাংশ পুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ে।

শুক্রবার সকাল। বাংলাদেশে ছুটির দিনের নিরিবিলি সময় কাটাচ্ছিলেন অনেকে। হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের তীব্র কাঁপুনিতে সেই শান্ত মুহূর্ত বদলে যায় আতঙ্কে। রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুভূত হয় মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প।
বাংলাদেশ আবহাওয়া দফতর জানায়, সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদী জেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে, এবং ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে।

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশের ভেতরে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প বলে মনে করা হচ্ছে। সাধারণত সিলেট, নোয়াখালী বা দেশের পূর্বাঞ্চলে ভূমিকম্পের সূচনা দেখা গেলেও এবার কেন্দ্র ছিল ঢাকার আরও নিকটে নরসিংদীতে। রাজধানীর এত কাছাকাছি এই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে টেকটোনিক প্লেটের পাঁচটি সক্রিয় সোর্স আছে। এর মধ্যে নোয়াখালী-কক্সবাজার, নোয়াখালী-সিলেট এবং সিলেট থেকে ভারতের দিকে বিস্তৃত একটি সক্রিয় অংশ গুরুত্বপূর্ণ। নোয়াখালী থেকে সিলেট পর্যন্ত যে বড় ভূতাত্ত্বিক ফাটল রয়েছে, তার একটি শাখা নরসিংদী পর্যন্ত প্রসারিত। তাই নরসিংদী এলাকায় ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

হঠাৎ এই কম্পনে অনেক ঘর দুলে ওঠে এবং মানুষ দ্রুত নিচে নেমে নিরাপদ স্থানে যায়। ভূমিকম্পের পর রাজধানী ও আশেপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় ফল্ট লাইনগুলোর কারণে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প ভবিষ্যতে আরও হতে পারে। তাই বিল্ডিং নির্মাণে ভূমিকম্প-নিরোধী নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণের উপর জোর দেওয়া জরুরি।

আরও পড়ুন

সুনামির ‘ T’ কেন উচ্চারিত হয় না?

রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশের বহু বহুতলের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য একে একে সামনে আসছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দফতর বলছে, ক্ষতির সঠিক হিসাব তৈরির কাজ এখনও চলছে এবং বিভিন্ন জেলা প্রশাসন থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস রাজধানীর প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ করেছে। অফিসার মো. সালাহ উদ্দীন-আল-ওয়াদুদ স্বাক্ষরিত এক বার্তায় জানানো হয়, মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, আরমানিটোলা, সূত্রাপুর, বনানী, কলাবাগান-সহ মোট ১৪টি এলাকায় ১৪টি বহুতল ফাটল-সহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞ দল বহুতলগুলি পরিদর্শন করে ঝুঁকি যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে। উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে ক্ষতির পরিমাণ সর্বাধিক। জেলা প্রশাসনের বিবৃতি অনুযায়ী, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সার্কিট হাউস-সহ শতাধিক ভবনে ফাটল দেখা গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সব বহুতলের কাঠামোগত অবস্থা মূল্যায়নে জরুরি পরিদর্শন চলছে।

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সার্কিট হাউস-সহ শতাধিক ভবনে ফাটল দেখা গিয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি ভবনের অবস্থা পর্যালোচনা করতে জরুরি টিম কাজ করছে। গাজীপুরে বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে ভূমিকম্পের সময় হুড়োহুড়ি করে বের হতে গিয়ে শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন। তবে বহুতলটির ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। কারখানাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলি চট্টগ্রাম-সহ বিভিন্ন জেলায় বহুতল হেলে পড়া ও ফাটল দেখা দেওয়ার খবর প্রকাশ করেছে।

ভূমিকম্পের পর কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি হেলে পড়া এবং ঘোড়াশাল গ্রিডে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত লাইনগুলো পরীক্ষা করে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়েছে। বাংলাদেশের পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি সাবস্টেশনে ভূমিকম্পের পরই আগুন ধরে যায়। যন্ত্রাংশ পুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ে। পলাশ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, দু'টি ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। দুপুরের পর থেকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। পলাশের দুই খোলা জায়গায় দেখা গিয়েছে গভীর ও দীর্ঘ ফাটল। দেশটির দড়িহাওলাপাড়ার একটি কাঁচা রাস্তায়েও মাঝখান দিয়ে ফাটল দেখা গিয়েছে। লেবুপাড়ার একটি গরুর খামারের আঙিনায়ও একাধিক বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটির এই ফাটলগুলো ভূকম্পনের তীব্রতা ও এলাকার ভৌত দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়।

ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দফতর একটি কন্ট্রোল রুম চালু করেছে। জরুরি তথ্য জানানোর জন্য টেলিফোন নম্বর ০২৫৮৮১১৬৫১-এ যোগাযোগের আহ্বান জানানো হয়েছে। সামগ্রিকভাবে, ঢাকা, নরসিংদী, চট্টগ্রাম ও গাজীপুর-সহ বিভিন্ন জেলার বিচ্ছিন্ন ক্ষতির খবর মিললেও সম্পূর্ণ চিত্র জানতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।

নরসিংদী ভূমিকম্পের ‘হটস্পট’ হয়ে উঠছে বলে আগেই সতর্ক করেছিলেন ভূতাত্ত্বিকরা। গত ১২ বছরে এই এলাকায় অস্বাভাবিকভাবে ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়েছে, এটি বড় কোনো ভূ-চাপ জমে থাকার ইঙ্গিত। দুর্বল মাটি, অপরিকল্পিত বহুত এবং জনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা সব মিলিয়ে এই অঞ্চল বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, একটি অঞ্চলে সাধারণত ১০০ থেকে ১৫০ বছর পরপর বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশ ও আশপাশের অঞ্চলে গত দেড়শ বছরে একটি বড় এবং পাঁচটির মতো মধ্যম মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছে। সর্বশেষ বড় ভূমিকম্পটি হয়েছিল প্রায় একশ বছর আগে। তাই বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করছেন, আগামী দিনগুলোতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি অস্বীকার করা যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে ঢাকার আশপাশে ১০টি ভূমিকম্পের তথ্য রয়েছে, এগুলি গত ৪৮৫ বছরের যে কোন সময়ের তুলনায় বেশি। ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে পাঁচটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, সবগুলোর মাত্রাই রিখটার স্কেলে ৭-এর উপরে। তার পর থেকে এত বছর ভূমিকম্প না হওয়া ভূতাত্ত্বিকদের মতে আরও বিপজ্জনক।

তবে বিশ্লেষকরা এও বলছেন, ঝুঁকির বড় কারণ লুকিয়ে আছে নির্মাণ ব্যবস্থাপনাতেই। বিল্ডিং কোড না মেনে বহুতল তৈরি করলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। ঝুঁকিপূর্ণ বহুতলগুলি চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তারা বলছেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম-সহ বড় শহরগুলোতে যেভাবে অপরিকল্পিত ভবন গড়ে উঠছে, তা ভবিষ্যতের কোনো বড় ভূমিকম্পে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও একই মত প্রকাশ করেছেন। শুক্রবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। তাঁর মতে, নতুন বহুতলগুলিতে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হলেও দেশে বিপুল সংখ্যক পুরনো ভবন কোনো নিয়ম-নীতি ছাড়াই নির্মিত হয়েছে। এসব বহুতলই বড় ঝুঁকির মূল উৎস।

আরও পড়ুন

কলকাতা জুড়ে কম্পন, বাংলাদেশে নিহত ৩! সবচেয়ে ভয়াবহ ৬টি ভূমিকম্পের ঘটনা

বাংলাদেশের শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীরে বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, বেসরকারি শিল্প এলাকা এবং ঘনবসতিপূর্ণ আবাসন বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, এসব এলাকায় অধিকাংশ স্থাপনাই জলাভূমি ভরাট করে তৈরি, ফলে ভূমিধসের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পই এ অঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ রাসায়নিক কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বহুগুণ।

বাংলাদেশের ইংরেজি সংবাদমাধ্যম দৈনিক নিউ এইজ জানিয়েছে, শুক্রবার সকালের ভূমিকম্পে কমপক্ষে ১০ জন নিহত ও এক হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে নরসিংদীর পাঁচজন, ঢাকায় চারজন ও নারায়ণগঞ্জে একজন রয়েছেন। হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে শিশু থেকে শ্রমিক অনেকে আহত হয়েছেন। বাংলাদেশের আরেক সংবাদমাধ্যম দেশ রূপান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের জরিপে উপকূলীয় এলাকায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ততার ক্ষতিতে পড়েছিল। বর্তমানে সেই পরিমাণ বেড়ে ১১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর অর্থাৎ ১৫ বছরে ক্ষতিগ্রস্ত জমি বেড়েছে এক লাখ হেক্টরেরও বেশি। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা, যদি সরকারি সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষকরা দ্রুত যৌথ উদ্যোগ না নেন, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যেই উপকূলীয় এলাকার বড় অংশ লবণাক্ত হয়ে যেতে পারে। এতে কৃষি উৎপাদন কমে যাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। ভূমিকম্প, উপকূলের লবণাক্ততা সব মিলিয়ে বাংলাদেশের শনিবারের পত্রিকাগুলির খবর বাংলাদেশের সামনে থাকা বহুমুখী সংকট ও চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেছে।

ঢাকার প্রায় ৬ লাখ ভবনের দুই-তৃতীয়াংশই বহুতল কোড মানে না। বিষয়টি বহুবার আলোচনায় এলেও বাস্তবে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। নতুন বহুতলেও একই অনিয়ম। দুর্যোগ প্রস্তুতি ও উদ্ধার সক্ষমতাও এখনও পর্যাপ্ত নয়। নির্মাণশৈলী, পুরনো বহুতলের জীর্ণ অবস্থা, জনবহুল নগরায়ণ— সবকিছু মিলে বাংলাদেশে এক বড় বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্প গবেষকদের পরামর্শ, জরুরি ভিত্তিতে সব ঢাকার পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল তালিকাভুক্ত করতে হবে, বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন করতে হবে, এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ নিয়মিত চালু রাখতে হবে। না হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়বে, আর ছোট কম্পনগুলো সত্যিই বড় বিপদের আগাম বার্তায় রূপ নিতে পারে। এই ভূমিকম্প আবারও মনে করিয়ে দিল ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে, তাই প্রস্তুত থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

More Articles