স্বাধীনতার পর ভারতে প্রথম ১৯৫৪ সালে সংসদে ওয়াকফ বিল পাস হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে সেই বিলে সংশোধন করা হয়।
ওয়াকফ আইন আসলে কী? কেন ক্ষুব্ধ মুসলিম সমাজ?
Waqf (Amendment) Bill, 2024: দেশে সবচেয়ে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে উত্তরপ্রদেশে (২,৩২,৫৪৭, দেশের মোট ওয়াকফ সম্পত্তির ২৭ শতাংশ)। তারপরই তালিকায় আছে পশ্চিমবঙ্গ।
ওয়াকফ বিলের সংশোধনী নিয়ে ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকেই হইচই শুরু হয়। তারপর সংসদের দুই কক্ষে পাস হয়ে যাওয়ার পরে, রাষ্ট্রপতি তাতে সই করে দিয়েছেন। এই ওয়াকফ আইন সরসরি মুসলিমদের সম্পত্তির সঙ্গে জড়িত। যেহেতু দেশের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদ প্রচারের এবং সংখ্যালঘু দমনের অভিযোগ আছে, তাই সেই আবহে এই ওয়াকফ আইন নিয়ে বিতর্ক স্বাভাবিক। সারা দেশের পাশাপাশি, এই রাজ্য, বিশেষ করে কলকাতা শহরে মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ চোখে পড়েছে। তৃণমূল সরকার স্বাভাবিকভাবেই এই ইস্যুতে বিজেপিকে আক্রমণ করবে, করছেও। কিন্তু কেন বিতর্ক? ওয়াকফই বা কী? আর ওয়াকফ আইনেই বা কী বলা হচ্ছে? পুরনো একটি আইন থাকা সত্ত্বেও কেন নতুন ওয়াকফ আইন পাস করাতে এত মরিয়া হলো বিজেপি সরকার?
ওয়াকফ শব্দটি আরবি মূল শব্দ ওয়াকাফা থেকে এসেছে। এর অর্থ 'নিষেধ করা' বা 'বন্ধ করা'। কোনও মুসলিম মানুষ যদি তাঁর ব্যক্তিগত স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণে দান করেন, তাহলে সেটি ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি বলে বিবেচিত হতে পারে। সেই স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি কোনও ধর্মীয়, দান খয়রাতমূলক বা ব্যক্তিগত কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে। কারা এই সম্পত্তি ভোগ করবেন তা স্পষ্টভাবে বলা না হলেও উল্লিখিত আছে যে, এই সম্পত্তির সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকাটা জরুরি। অনেক সময়ে এই ধরনের সম্পত্তিকে ‘ওয়াকফ’ ঘোষণা করার জন্য, কোনও লিখিত দলিল থাকতে পারে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে মুখে মুখেও কোনও সম্পত্তিকে ‘ওয়াকফ’ ঘোষণা করা যেতে পারে। দীর্ঘদিন কোনও সম্পত্তি যদি ধর্মীয় বা ওই ধরনের কোনও কাজে ব্যবহৃত হয় তাহলেও সেটিকে ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি বলা যেতে পারে। একবার যদি কোনও সম্পত্তি ‘ওয়াকফ’ ঘোষিত হয়, তাহলে তার চরিত্র আর বদল করা যাবে না।
ওয়াকফ আইন কী?
ওয়াকফে দান করা সম্পদ নির্দিষ্ট ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়, যাকে ওয়াকফ বোর্ড বলা হয়। যাঁরা সম্পত্তি দান করেন তাদের ওয়াকিফ বলা হয়। তথ্য বলছে, সবচেয়ে প্রাচীনতম ওয়াকফিয়ার নজির মেলে ৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। সম্ভাব্য প্রাচীনতম পুরনো ওয়াকফিয়া প্যারিসের লুভের জাদুঘর দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে এর লিখিত কোনও তারিখ পাওয়া যায়নি। অনেক ইতিহাসবিদ এটিকে নবম শতকের মাঝামাঝি বলে মনে করেন।
‘প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো’-র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের ইতিহাসে ওয়াকফের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দিল্লির সুলতানশাহির প্রথম দিকে। জামা মসজিদ কর্তৃপক্ষকে দু'টি গ্রাম উৎসর্গ করেছিলেন সুলতান মুইজুদ্দিন সাম ঘোর মুলতান। ওয়াকফ হিসেবে ওই গ্রাম দু’টি মসজিদের তৎকালীন প্রশাসন শাইখুল ইসলামের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এটিই ভারতের প্রথম ওয়াকফ বলে মনে করা হয়।
মুঘল যুগে ওয়াকফের সম্প্রসারণ এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, শাহজাহান ১৬৪০-এর দশকে তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেশ কয়েকটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই চ্যারিটিগুলিই ওয়াকফ রক্ষণাবেক্ষণ, অনুষ্ঠান এবং পরিচারকদের বেতনের জন্য আর্থিক সংস্থান সরবরাহ করত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ওয়াকফ ব্যবস্থায় এক পরিবর্তন আসে, কারণ আইনি কাঠামো নতুন নিয়মকানুন প্রবর্তন করে। ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন ওয়াকফ আইন চালু করে। এই আইনি পরিবর্তনগুলি ওয়াকফ ব্যবস্থাপনাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য হলেও দুর্নীতি ঠেকানো যায়নি।
আরও পড়ুন- কেন মুসলিমদের সম্পত্তি নিয়ে ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪’ চাইছে মোদি সরকার?
স্বাধীনতার পর ভারতে প্রথম ১৯৫৪ সালে সংসদে ওয়াকফ বিল পাস হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে সেই বিলে সংশোধন করা হয়। বর্তমান ওয়াকফ আইনের ৪০ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যে কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসাবে ঘোষণার অধিকার এতদিন ছিল ওয়াকফ বোর্ডের হাতেই। অতীতে ওয়াকফ বোর্ডের বিরুদ্ধে বারবার বহু গরিব মুসলিমের সম্পত্তি, অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি অধিগ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। তাই ওয়াকফ বোর্ডের দুর্নীতি ঠেকাতেই নাকি এই বিলের সংশোধনী প্রয়োজন বলে মত এক অংশের।
কী কী সংশোধনী আনা হয় নতুন বিলে?
নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার কেড়ে নিয়ে কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ কিনা, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে জেলাশাসক বা সমপদমর্যাদার কোনও সরকারি আধিকারিকের হাতে। আগের আইনে ওয়াকফের দখল করা জমি বা সম্পত্তিতে কোনওভাবেই পর্যালোচনা করার সুযোগ ছিল না। কারও আপত্তি সত্ত্বেও জমি বা সম্পত্তি দখল করতে পারত ওয়াকফ বোর্ড। তাতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ ছিল না সরকারের। নতুন আইনে তার বন্দোবস্ত রয়েছে। এছাড়া রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তিকরণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব। নতুন আইনে ওয়াকফ বোর্ডে দুই অমুসলিম সদস্যের অন্তর্ভুক্তির কথা রয়েছে বলে অভিযোগ করা হলেও তা খণ্ডন করেছেন অমিত শাহ।
ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরোধিতা প্রসঙ্গে মুসলিম সংগঠনগুলির যুক্তি ছিল, ওয়াকফ বোর্ডের বিভিন্ন সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যেই ওই বিল আনছে কেন্দ্র। গত বুধবার গভীর রাতে লোকসভায় পাস হয় ওয়াকফ বিল। সংসদ কক্ষে দাঁড়িয়ে ওয়াকফ বিল সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কী বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ? "ওয়াকফ অ্যাক্ট এবং বোর্ড ১৯৯৫ সালে কার্যকর হয়েছিল। অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সমস্ত তর্ক-বিতর্কই ওয়াকফে হস্তক্ষেপের বিষয়ে। বলা হচ্ছে, কোনও অমুসলিম ওয়াকফের মধ্যে আসবে না। পরিষ্কারভাবে বুঝুন... যারা এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনা করেন তাঁদের মধ্যে কোনও অমুসলিমকে অন্তর্ভুক্ত করার এমন কোনও বিধান নেই...আমরা তা চাই না। মুসলিমদের ধর্মীয় আচার-আচরণে হস্তক্ষেপ করা হবে এবং তাঁদের দান করা সম্পত্তি হস্তগত করা হবে এই চূড়ান্ত ভুল ধারণাটি সংখ্যালঘুদের মধ্যে তাদের ভোটব্যাঙ্কের ভয় জাগানোর জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।"
বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, “তারকেশ্বরের ডেভেলপমেন্ট কমিটিতে ফিরহাদ হাকিম কী করে চেয়ারপার্সন ছিলেন? প্রশ্নটা হিন্দু মুসলিম বিভাজনের নয়, প্রশ্নটা আইনের। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদের হ্যাংওভার থেকে ক্রমেই মুক্তি পাচ্ছে। ব্রিটিশরা মানুষকে গোলাম বানিয়ে রাখার যে যে আইন করেছিল সমস্ত আইনেরই সংশোধন হবে। এই আইন প্রান্তিক দরিদ্র মুসলমানদের স্বার্থে, দুর্নীতি বন্ধ করতে।"
তবে কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ বিরোধীদের অভিযোগ, ৪৪টি সংশোধনী এনে ওয়াকফ বোর্ডের উপর সরকারি কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে চাইছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। মূলত মুসলিমদের কোণঠাসা করতে এবং হিন্দুদের বার্তা দিতেই এই বিল পাস করানো বিজেপির উদ্দেশ্য বলে মত বিরোধীদের। লোকসভায় বিল পাসের দিন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি বলছেন, "সংবিধানের উপর আরএসএস, বিজেপি এবং তাদের সহযোগীদের এই আক্রমণ আজ মুসলমানদের নিশানা করছে ঠিকই কিন্তু ভবিষ্যতে অন্যান্য সম্প্রদায়কেও নিশানায় রাখার নজির গড়ে তুলছে।"
মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি মুফতি আবদুস সালাম বলছেন, “ওয়াকফ আইন ওয়াকফ সম্পত্তিকে সুরক্ষা তো দেবেই না উল্টে ওয়াকফ করার ক্ষেত্রে বা উদ্ধার করার ক্ষেত্রে অসুবিধা করবে। হিন্দু সমাজ কখনও ওয়াকফ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি, নীরব সমর্থন করেছে। হিন্দুদের পক্ষ থেকেও আমরা মসজিদ নির্মাণের জন্য জমি পেয়েছি। আবার মোগল সম্রাটরা একসময় হিন্দুদের পুজোর জন্য জমি দিয়েছেন। এটাই আমাদের সংস্কৃতি। কোনও ধর্মীয় সমাজের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন নয়। এটা কেন্দ্রের আইনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই।"
আরও পড়ুন- ভারতীয় মুসলিমকে ‘পাকিস্তানি’ বলা কি আইনের চোখে অপরাধ?
বর্তমানে ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে। ভারত জুড়ে রয়েছে ৩০টি ওয়াকফ বোর্ড। প্রায় দশ লক্ষ একর জমি রয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। উল্লেখযোগ্যভাবে, দেশে সবচেয়ে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে উত্তরপ্রদেশে (২,৩২,৫৪৭, দেশের মোট ওয়াকফ সম্পত্তির ২৭ শতাংশ)। তারপরই তালিকায় আছে পশ্চিমবঙ্গ। রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মোট ৮০ হাজার ৫৪৮টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে।
নতুন ওয়াকফ আইনের কারণে পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণের রাজনীতি আরও তীব্র হবে বলেই মত রাজনৈতিক মহলের। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে চলেছেন বাংলায় ওয়াকফ আইন প্রয়োগ হতে দেবেন না। "মনে রাখবেন, যে আইনের বিরুদ্ধে অনেকে উত্তেজিত, সেই আইনটি কিন্তু আমরা করিনি। আইনটি কেন্দ্রীয় সরকার করেছে। আমরা এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে বলেছি – আমরা এই আইনকে সমর্থন করিনা। এই আইন আমাদের রাজ্যে লাগুও হবে না।” মমতা আরও বলছেন, ‘‘আমি জানি ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে সংখ্যালঘুদের মনে একটা দুঃখ আছে। আপনারা ভরসা রাখুন, বাংলায় এমন কিছু হবে না যাতে বিভাজন হয়। সবাইকে একসঙ্গে থেকে বাঁচতে হবে। আপনারা সবাই একসঙ্গে বাঁচার কথা বলুন। কেউ কেউ রাজনৈতিক প্ররোচনা দেয়। আমি বলছি, দিদি আছে, দিদি আপনাদের রক্ষা করবে। আপনাদের সম্পত্তি রক্ষা করবে। কেউ উস্কানিতে পা দেবেন না।’’
সবার কাছে আবেদন
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) April 12, 2025
সব ধর্মের সকল মানুষের কাছে আমার একান্ত আবেদন, আপনারা দয়া করে শান্ত থাকুন, সংযত থাকুন। ধর্মের নামে কোনো অ-ধার্মিক আচরণ করবেন না। প্রত্যেক মানুষের প্রাণই মূল্যবান, রাজনীতির স্বার্থে দাঙ্গা লাগাবেন না। দাঙ্গা যারা করছেন তারা সমাজের ক্ষতি করছেন।
মনে রাখবেন, যে…
পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি জায়গায় মুসলিমদের বিক্ষোভ প্রদর্শন ও হিংসার খবর সামনে এসেছে। জাতীয় সড়ক ও রেল পথ অবরোধ থেকে বাস, বাইক, গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন লাগানোর অভিযোগ উঠেছে। বিশেষত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলি যেমন মুর্শিদাবাদ, ডায়মন্ড হারবারের মতো জায়গাগুলি খবরের শিরোনামে। জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৬ এপ্রিল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ইমাম-মোয়াজ্জিন ও সমাজের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী সত্যিই ওয়াকফকে আটকাতে পারবেন, নজর এখন সেদিকেই।