সফদারের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের সঙ্গে কথা বলা এবং তিনি থিয়েটারকেই তাঁর ভাষা হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।
এখন কোণঠাসা কিন্তু সফদাররা আজও মেঘনাদ
Safdar Hashmi: থিয়েটার মাঝপথে। তখন সকাল প্রায় ১১টা। হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন ওই নির্বাচনেরই কংগ্রেস প্রার্থী মুকেশ শর্মা এবং তাঁর দলবল।
১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাস। দিল্লিতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপস্থিত শাবানা আজমি। শাবানা আজমিকে প্রশ্ন করা হলো তাঁর প্ৰিয় পরিচালক প্রসঙ্গে। শাবানা আজমি শান্ত হয়ে মাইক তুলে নিলেন এবং বললেন,
"আমার প্ৰিয় পরিচালক প্রসঙ্গে পরেও আলোচনা হতে পারে। আপাতত যেটা বেশি জরুরি তা হলো, আমরা উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে কিছু লিফলেট বিলি করছি। হতেও পারে আমরা সবার কাছে এই লিফলেট পৌঁছতে পারলাম না। তাই মঞ্চের সুযোগটা ব্যবহার করে আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানাতে চাই।"
শুধু এটুকু বলার পরেই দর্শকরা সমর্থনে চিৎকারে আর কোরাসে হাল্লাবোলকে বাঁচিয়ে তুলছেন। হাততালি থামতে চাইছে না। শাবানা আজমি ধীরে ধীরে একটা কাগজের টুকরো খুলে পড়তে শুরু করেন। যে লেখার মূল অংশটাই ছিল তৎকালীন সরকার বা সিস্টেমের বিরুদ্ধে। শাবানা সেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, যে সিস্টেম একদিকে সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রচারের উদ্দেশ্যে নানাবিধ উদ্যোগ নিচ্ছে আর অন্যহাতে দিল্লি থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে শাহিবাবাদে একজন নাট্যকর্মী, সাংস্কৃতিককর্মীকে হত্যা করছে। শাবানা বলছেন,
"we filmmakers and film lovers wish to register our protest against the system that on the one hand claims to promote creativity and on the other hand, connives in the murder of cultural activists "
যখন শাবানা আজমি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম বৃহৎ মঞ্চে এই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ঠিক তখনই সারা দেশেও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। মাত্র কিছুদিন আগেই শাহিবাবাদে হত্যা করা হয়েছে সফদার হাসমিকে। ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি সফদারের দল 'জনম' গাজিয়াবাদ পৌরসভার নির্বাচনে শাহিবাবাদে সিপিআই(এম) প্রার্থী রামানন্দ ঝায়ের সমর্থনে থিয়েটার শুরু করেছিল। থিয়েটার 'হাল্লাবোল'। থিয়েটার মাঝপথে। তখন সকাল প্রায় ১১টা। হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন ওই নির্বাচনেরই কংগ্রেস প্রার্থী মুকেশ শর্মা এবং তাঁর দলবল। এসেই তাঁদের দাবি, নাটক থামাতে হবে। তাঁদের যাবার রাস্তা দিতে হবে। প্রত্যাশা মতোই সফদার বলেন অপেক্ষা করতে অথবা অন্য রাস্তায় যেতে। থিয়েটার মাঝপথে থামবে না।
ব্যাস! এটুকুই যথেষ্ট ইগো তছনছ করে দিতে। রাজনেতার অহং। সে যে দলই হোক, যে সাম্রাজ্যই হোক; রাজনেতা হলেন রাজনেতা। তাঁর হুকুম নিয়েই নদীতে জল বইবে, শিক্ষিতরা চাকরি পাবে। তাঁর রাস্তায় নাট! তাও, তাঁরই বিরুদ্ধে? শুরু হয় এলোপাথাড়ি আক্রমণ। লোহার রড, লাঠি আরও সব অস্ত্র দিয়ে সরাসরি আক্রমণ করা হয় জনমের শিল্পীদের এবং দর্শকদেরও। স্থানীয় বাসিন্দা রাম বাহাদুরের ওখানেই মৃত্যু হয়। সফদারের চোট গুরুতর। একতরফা আক্রমণ থামলে আহত, ভীষণ আহত সফদারকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। পরের দিন, মানে ২ জানুয়ারি সকাল ১০টা নাগাদ মৃত্যু হয় সফদারের। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বেঁচে ওঠে এই অমোঘ ভাষ্য। সিস্টেমের একহাতে মধুর প্রেরণা আর অন্য হাতে ধারালো ছুরি। তুমি আমার প্রেরণায় আপাদমস্তক ঋণী হয়ে আমারই জয়গান গাও। আমার ডাকা সভায় তুমি নাচো, তুমি গাও, তুমি নাটক করো, তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হয়ে ওঠো — কিন্তু তুমি যদি প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করো তোমাকে হত্যা করা হবে। প্রাণে অথবা মানে। হত্যা সফদার হাসমি আর সোমেন চন্দের মধ্যে কোনও পার্থক্য করেনি। সফদারকে প্রাণে নিহত হতে হয়েছিল। মাত্র চৌত্রিশে। মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সি যে যুবক একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন যে, তাঁর শিল্প হবে জনগণের শিল্প, খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের শিল্প।
আরও পড়ুন- মার্ক্সের দর্শনে বাংলা পথনাটকের জন্ম দিয়েছিলেন তিনিই, বাঙালি ভুলেছে পানু পালকে
শিল্পকে ব্যাখ্যা করার যে পুঁজিবাদী কৌশল, তাকে প্রায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে সফদার তাঁর থিয়েটারকে শুধু পথেই নামিয়ে আনেননি, পথের থিয়েটারের যোগ্য করে তুলেছিলেন। স্বাভাবিক অভিনয়ের বিরুদ্ধে তাঁকে যেতেই হতো। বৃদ্ধ চরিত্রের পোশাক পরে বৃদ্ধ সাজা বা বাচ্চা কোনও মেয়ের সাজে বাচ্চা হয়ে ওঠা — সফদারের থিয়েটারের পথে এসব নিতান্তই অযৌক্তিক এবং অপ্রয়োজনীয়। তাই মেকআপ বা সাজপোশাক নয়, বরং তাকে ছাপিয়ে সেই চরিত্র হয়ে উঠতে হবে। সফদারের অন্য থিয়েটার 'মেশিন' বা 'অউরত' দেখুন তাহলেই টের পাবেন। এই চরিত্রের স্বাভাবিকতাকে অতিক্রম করে একটা মূর্তি তৈরি করার তত্ত্ব আমরা বাদল সরকারের থিয়েটারেও পাই। বাদল সরকার আর সফদার হাসমির থিয়েটার কৌশলে অনেক কাছাকাছি ডিজাইন পাই ঠিকই কিন্তু অনেক, বিশেষ করে অঙ্গননাট্য এবং পথনাটকের মধ্যে দর্শনগত অনেক অনেক পার্থক্য। তবে তাঁদের দু'জনেরই শিল্পচর্চার মূলেই ছিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব।
শিল্পকে পুঁজিবাদী ঘেরাটোপের বাইরে নিয়ে আসতে হবে। নান্দনিকতার সংজ্ঞা পালটে দিতে হবে। যদিও, সফদার মঞ্চ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এমনকী টিভি সিরিয়াল এবং সিনেমার মতো শিল্প মাধ্যমেও (যাকে বিগ হাউজ বলেই ডাকেন সবাই) সফদার নজরকাড়া সাফল্য পেয়েছিলেন কিন্তু ওই পথ সফদারের পথ ছিল না। তিনি স্পষ্ট ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানে,
"আমার অভিজ্ঞতায় যেটা সঠিক রাজনৈতিক অবস্থান সেটা আমাকে বলতেই হবে এবং সেটা বলতে হবে সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষের সামনে। তবেই আমার শিল্প সার্থক"
(political understanding of Safdar Hashmi)
আরও পড়ুন- থিয়েটারে-বাস্তবে যেভাবে নগ্ন প্রতিবাদের মুখ হয়েছেন মণিপুরের মেয়েরা
পরবর্তীকালে, এই প্রসঙ্গে অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহকে বলতে শুনি,
"আমার সঙ্গে সফদারের একটা বড় পার্থক্য ছিল। আমি অভিনয়ের বিনিময়ে প্রত্যাশা করেছি খ্যাতি, অর্থ। আর সফদার প্রত্যাশা করেছিলেন পরিবর্তন, বিপ্লব।"
তাঁর বক্তব্যের এই সামান্য অংশই সফদারের শিল্পপথকে স্পষ্ট করে তোলে। সফদারের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের সঙ্গে কথা বলা এবং তিনি থিয়েটারকেই তাঁর ভাষা হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। মানুষের কাছে তাঁর থিয়েটারকে আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য তিনি অবলীলায় তৎকালীন জনপ্রিয় হিন্দি ফিল্মি গানের সুরে নতুন কথা বসিয়ে গান তৈরি করছেন। সেই নতুন গান গাইতে গাইতে ভুলেও যাচ্ছেন আসল গানটার কথা কী ছিল! মূল উদ্দেশ্য একটাই। দর্শকদের কাছে তাঁর থিয়েটারের রাজনৈতিক অবস্থানকে পৌঁছে দেওয়া। এখন অনেকেই বলেন, সব শিল্পই রাজনৈতিক। রাজনীতি ছাড়া কোনও শিল্প বা কোনও থিয়েটারই নাকি হয় না। এগুলো বলে আসলে নিজেদের সঙ্গে নিজেরাই প্রতারণা করার পথ তৈরি করেন। সেটাই যদি হতো তাহলে 'পারিবারিক নাটক', 'প্রেমের মিষ্টি নাটক' এসব বিজ্ঞাপন হাটেবাজারে দেখা যেত না। বিপক্ষে যুক্তি আসে, "প্রেম কি রাজনীতির বাইরে? পরিবার কি রাজনীতির বাইরে?" এসব অক্ষমের যুক্তি। আর এইসব যুক্তিখোরেরা এটাও জানেন যে, তাঁদের প্রেমে বা পরিবারে শেয়ার বাজার বা শ্রমিক ছাঁটাইয়ের দিকনির্দেশ হয় না, যুদ্ধে শিশুহত্যা বন্ধ হয় না। হ্যাঁ, উল্টোটা হতে পারে। একটা ঘৃণ্য রাজনৈতিক পাঁকে পড়ে হাজার হাজার শিক্ষককে চাকরি হারাতে হয়। তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাই রাজনৈতিক কথা বলতে গেলে মঞ্চে মৃদু কান্নার সুরে বিরহের কথা বললে সেটা কি রাজনৈতিক হয়ে উঠবে? সফদার হাসমি নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর।
সফদার যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন তবে, রাশিয়ার ভেঙে যাওয়া, বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া বা খোলা বাজার অর্থনীতির লেজ ধরে পাড়ায় পাড়ায় শপিংমলের নির্লজ্জ অহংকার দেখতে পেতেন। হয়তো সফদার নতুন কোনও থিয়েটার তৈরি করতেন। তাঁর চব্বিশটা নাটকের চারহাজার শো, দুশো চব্বিশটা নাটকের চল্লিশহাজার শো হয়ে উঠত। হয়তো 'মেশিন'-কেই তিনি আবার তৈরি করতেন। নতুন মেশিন। সাথ সাথ এক সাথ। কবি ও চোর এক সাথ, ধর্ষক ও প্রতিবাদী একসাথ, বেড়াল ও মাছ একসাথ। খাদ্য খাদক বোঝা কঠিন। যে চরম বিশ্বাসঘাতক, তাঁকেই বিশ্বাসের মূর্তি বানিয়ে এখন মঞ্চে মঞ্চে থিয়েটার। পুঁজিবাদী লোভকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেবার নিদারুণ চেষ্টা।সফদাররা এখন কোণঠাসা কিন্তু মনে রাখতে হবে সফদাররাই মেঘনাদ। মনে রাখতে হবে, যে শহরের যে রাস্তায় সফদারকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই শহরের সেই রাস্তাতই কিন্তু সফদারের শেষ না হওয়া 'হাল্লাবোল' শেষ করতে পৌঁছেছিলেন তাঁর স্ত্রী, তাঁর কমরেড মলয়াশ্রী। আজ সফদারের জন্মদিন। একজন বিকল্পহীন স্বপ্নদর্শীর জন্মদিন। আসলে এক সাহসের জন্মদিন। এই দিন আসলে মানুষের শিল্পীদের, জনগণের শিল্পীদের আরেকবার ঘুরে তাকানোর দিন। ভাবার দিন। ভেতরে ভেতরে সফদার কি সত্যিই বেঁচে আছেন?