১০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ডায়ার উলফ সত্যিই ফিরেছে? জানুন আসল সত্য

Dire Wolves de-extinction: বিজ্ঞানীরা প্রথমে ১৩,০০০ বছরের পুরনো ডায়ার উলফের দাঁত এবং ৭২,০০০ বছরের পুরনো কানের হাড় থেকে এই প্রাণীটির ডিএনএ উদ্ধার করেন।

মার্কিন জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা ‘কলোসাল বায়োসায়েন্স’ দাবি করেছে যে, তারা ১০,০০০ বছর আগে পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়ানো এবং পরবর্তীতে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ডায়ার উলফকে ‘ডি-এক্সটিংক্ট’ করেছে। অর্থাৎ কিনা একটি বিলুপ্ত প্রাণীর অস্তিত্ব আবার ফিরিয়ে এনেছে পৃথিবীর বুকে।

সংস্থার দাবি, তারা জন্ম দিয়েছে তিনটি ডায়ার উলফ ছানার। রোমিউলাস, রেমাস এবং খালিসি। রোমিউলাস এবং রোমাস ছিলেন প্রাচীন রোমের প্রতিষ্ঠাতা। অন্যদিকে খালিসি ছিল বিখ্যাত টিভি সিরিজ ‘গেম অফ থ্রোনস’-এর একটি ডায়ার উলফ, যাকে মনে দাগ কাটার মতো একটি চরিত্র বললেও, ভুল হয় না বোধহয়।

কাজেই ইতিহাস, পুরাণ, কল্পবিজ্ঞান এবং অবশ্যই বিজ্ঞানকে মিলিয়ে মিশিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যম থেকে সাধারণ সমাজমাধ্যম — ডায়ার উলফের ‘ফিরে আসার’ উথাল-পাথাল ইমোশনাল খবরে ভরপুর। স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্জাল ভাসানো নাটকীয় ন্যারেটিভের অভ্যন্তরে যে বিজ্ঞান লুকিয়ে রয়েছে, সেখান অবধি সাধারণ মানুষকে পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে না।

সত্যিই কি ফিরে এসেছে ডায়ার উলফ?

না। ডায়ার উলফ ফিরে আসেনি।

আরও পড়ুন- হাতির থেকে আকারে বহুগুণ বড়! ম্যামথ ছানার দেহ নিয়ে তোলপাড় বিশ্ব

তাহলে আসলে কী ঘটেছে? অ্যাংলিয়া রাস্কিন ইউনিভার্সিটির বায়ো-ইনফর্ম্যাটিকসের অধ্যক্ষ টিমোথি হার্ন ‘দ্য কনভার্সেশন’-এ লিখেছেন, এই শেয়ালের প্রজাতি, যাকে গ্রে উলফ বলে দাবি করা হচ্ছে, তা আসলে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড গ্রে উলফ। অর্থাৎ যে কিনা জিনের মূল গঠনের দিক থেকে গ্রে উলফই, শুধু তার সামান্য জেনেটিক অদল-বদল করে তাদের খানিকটা ডায়ার উলফের মতো রূপ দেওয়া হয়েছে। ডায়ার উলফের মতোই এদের সাদা লোম, বড় দেশ এবং চওড়া কাঁধ রয়েছে।

হার্ন লিখেছেন, বিজ্ঞানীদের মতে (কলোসালের সঙ্গে যুক্ত নন তাঁরা) এটি সিন্থেটিক বায়োলজি ছাড়া আর অন্য কিছু নয়। বিজ্ঞানীরাই বলছেন, একে ডায়ার উলফের বদলে বলা ভালো 'গ্রে উলফের প্রসাধনী রদবদল'। তা ডি-এক্সটিংশন তো মোটেই নয়। কারণ আসল প্রাণীটি অর্থাৎ ডায়ার উলফ ফেরত আসেনি।

তাহলে আসলে কী হয়েছে?

বিজ্ঞানীরা প্রথমে ১৩,০০০ বছরের পুরনো ডায়ার উলফের দাঁত এবং ৭২,০০০ বছরের পুরনো কানের হাড় থেকে এই প্রাণীটির ডিএনএ উদ্ধার করেন। সেই ডিএনএ-কে সিকোয়েন্স করা হয়। ডিএনএ-কে সিকোয়েন্স করার অর্থ ডিএনএ-তে যে নাইট্রোজেন বেসগুলি আছে- যা কিনা ডিএনএ-র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান — তারা কোন ক্রমে সাজানো রয়েছে তা জানা। প্রতিটি জীবের ক্ষেত্রে ডিএনএ সিকোয়েন্স আলাদা আলাদা। সেই পার্থক্যের জন্যেই একটি জীব অন্য জীবের থেকে ভিন্ন এবং অনন্য।

কলোসালের বিজ্ঞানীরা তখন তুলনা করে দেখলেন গ্রে উলফ আর হোয়াইট উলফের ডিএনএ-র মধ্যে। ‘গ্রে উলফ’ যেহেতু এখনও পৃথিবীর বুকে দিব্যি বেঁচে রয়েছে, এদের ডিএনএ সিকোয়েন্স করতে সমস্যা হয়নি। দেখা গেল, এই দু’টি ভিন্ন প্রজাতির শেয়ালের মধ্যে মাত্র কুড়িটি জেনেটিক পার্থক্য। আর সেই জেনেটিক পার্থক্য জেনেটিক কোডের খুব ছোট ছোট জায়গায়। যে জেনেটিক কোডগুলিকে বলে সিঙ্গল নিওক্লিওটাইড পলিমরফিজম। সংক্ষেপে এসএনপি।

এই এসএনপি গুলোকেই বিজ্ঞানীরা জেনেটিক্যালি এডিট করেন। এডিটিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়, ক্রিস্পার-ক্যাস৯ নামের একটি জিন এডিটিং টুল। খুব সোজাভাবে বললে, ক্রিস্পার-ক্যাস৯ আসলে একটি মলিকিউলার কাঁচি। যা জিনের নির্দিষ্ট কিছু অংশ কেটে ফেলতে কাজে লাগে।

আর গ্রে উলফের যে কোশে এই জিন এডিট করা হয়, সেই কোশগুলিকেই কাজে লাগানো হয় ভ্রূণ তৈরিতে। সেই ভ্রূণ আবার প্রতিস্থাপন করা হয় সারোগেট কুকুরের শরীরে। তারা একেবারেই গৃহপালিত কুকুর বা ডোমেস্টিক ডগ।

পাশাপাশি ডি-এক্সটিংশনের প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অফ নেচারের এক বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন,

“সফল ডি-এক্সটিংশন তখনই ঘোষণা করা যাবে, যখন কোনও এক বিলুপ্ত প্রজাতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক প্রাণীকে ফিরিয়ে আনা যাবে এবং পৃথিবীর বুকে তারা অনেক বছর টিকে থাকবে।"

আসল ডায়ার উলফ, গবেষণাগারে তৈরি ডায়ার উলফ, আর গ্রে উলফ — তফাৎ কতখানি?

এই আলোচনায় আসার আগে, আমাদের নিকট আত্মীয় শিম্পাঞ্জির কথাই ধরা যাক, যাদের সঙ্গে আমাদের জেনেটিক তফাৎ মাত্র ৯৮.৮%। কিন্তু তাতেই ২৫ থেকে ৪০ কোটি জেনেটিক পার্থক্য রয়েছে আমাদের এবং শিম্পাঞ্জির মধ্যে, লিখেছেন টিমোথি হার্ন।
ডায়ার উলফ আর গ্রে উলফ জেনেটিক্যালি আলাদা হয়ে দু’টি ভিন্ন প্রজাতি হয়ে জন্ম নিয়েছিল তিন লক্ষ বছর আগে। হার্নের মতে, জেনেটিক্যালি আলাদা হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়া শুরু হয় তারও আগে থেকে। তার মানে এই দুই প্রাণীর মধ্যে জেনেটিক পার্থক্য আরও অনেক বেশি। তিনি জানাচ্ছেন, লক্ষ লক্ষ জেনেটিক তফাতের মাঝে, মাত্র কুড়িটি এসএনপি-কে এডিট করলেই একটি নতুন প্রজাতি তৈরি হয়ে যায় না।

হোয়াইট উলফ

আরও পড়ুন- ৩৫০০ বছর ধরে বরফের মধ্যে ‘বহাল তবিয়তে’! যে প্রাচীন ভালুকের দিকে নজর বিজ্ঞানীদের

বিলুপ্ত প্রাণীকে ফিরিয়ে আনা নাকি প্রাণী সংরক্ষণ – বর্তমান সময়ে কোনটি জরুরি?

পৃথিবীতে পরিবেশবিদ, জলবায়ুবিদ, জীব সংরক্ষণবিদ থেকে শুরু করে নানা মহলের বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবী ষষ্ঠ ‘মাস এক্সটিংশন’-এর দিকে এগোচ্ছে। যেখানে পৃথিবীর ৭৫% জীব পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে যাবে। ইটিএইচ জুরিখের জলবায়ু বিজ্ঞানী ডঃ চাহান কফ ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন, “এতবড় ‘মাস এক্সটিংশন বোধহয় পৃথিবী এর আগে কখনও দেখেনি।”

এদিকে সারা পৃথিবী জুড়ে যে যে প্রাণী ও উদ্ভিদ বেঁচে রয়েছে তাদের সংরক্ষণের জন্য, নিদেনপক্ষে তাদের সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে প্রচেষ্টাটুকু দরকার, সেটুকুও দেখা যায় না। ডঃ কফের মধ্যে, “পৃথিবীতে বেঁচে থাকা স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর, বড় গাছপালা থেকে শুরু করে ফার্ন, ফাঙ্গাস, পোকামাকড় সবাইকে আমাদের এই পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন প্রকৃতির স্বার্থে।"

গ্রে উলফ

২০২৪ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্র-সহ একাধিক দেশে জীব সংরক্ষণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত একাধিক প্রকল্পে প্রয়োজনীয় পুঁজি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে জীব সংরক্ষণের প্রয়াস। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এই মুহূর্তে বিলুপ্তপ্রায় একাধিক জীব। উল্টোদিকে তিনটি মাত্র ডায়ার উলফকে, যা আদতেও ডায়ার উলফ নয়, তৈরি করতে খরচ করা হয়েছে একশো কোটি মার্কিন ডলার।

পৃথিবীতে যখন হাজার হাজার জীব একত্রে বিলুপ্ত হচ্ছে, সেখানে দাঁড়িয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস অত্যন্ত স্বল্প। এদিকে হাজার হাজার বছর পুরনো প্রাণীকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ‘ফিরিয়ে আনার’ বা ‘ডি-এক্সটিংশনের’ উদ্যোগ নিয়েছে পুঁজিবাদী সংস্থাগুলি। যদি সত্যিই ডি-এক্সটিংশন সম্ভব হয়, হাজার হাজার বছর আগের পরিবেশে বেঁচে থাকা প্রাণীদের এই জলবায়ুতে বাঁচিয়ে রাখার অবস্থা আছে তো?

More Articles