বঙ্গবাজারের পোড়া কাপড় কিনে বিতর্ক! আদৌ কি সমাজসেবা করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন?

Bangladesh Vidyananda Foundation: শুধু পোস্ট নয়, অভিযোগ উঠছে, বিদ্যানন্দ বঙ্গবাজারে কাজ করতে নামায় সম্পূর্ণ আলো বিদ্যানন্দের দিকেই চলে গেছে।

গত ৪ এপ্রিল ঢাকার বঙ্গবাজারে বীভৎস অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান, ক্ষতির পরিমাণ যে কত ইয়ত্তা মেলে না। ইদের আগে ব্যবসায়ীদের এই বিপুল ক্ষতির কিছুটা অংশ ভাগ করে নিতে চেয়েছিল বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এই 'সাহায্যের হাত'-এর নেপথ্যে জালিয়াতির গন্ধ পাচ্ছেন বাংলাদেশের একাংশের মানুষ। ঠিক কী উদ্দেশ্য ছিল এই এনজিওর? আগুন লাগার ফলে জলে ভিজে যাওয়া, দাগ লাগা, বা খানিকটা পোড়া কাপড় নিলাম করতে চেয়েছিল এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের বক্তব্য, এসব কাপড় বাইরে না হলেও ঘরে পরতে পারবেন অনেকেই। ব্যবসায়ীরা নিজেদের অল্প ক্ষতিগ্রস্ত যে কাপড় উদ্ধার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাঁদের সেই কাজে সাহায্য করতেই প্রচারে নামেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ১৩ জন স্বেচ্ছাসেবক। জানা যায়, সংগঠনটি এইসব কাপড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নেবে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিজেদের ফেসবুক পেজে বঙ্গবাজারে আগুনে পোড়া কাপড় কেনা বিষয়ে একটি পোস্টও লেখে। তাতে জানানো হয়, বিক্রির অনুপযোগী কিন্তু পরার উপযোগী কাপড় কিনে বিনামূল্যে বিতরণ করতে চায় সংস্থাটি। মূলত পরিবেশগত কারণেই এইসব কাপড়ের পুনর্ব্যবহারের দিকে জোর দিচ্ছেন তারা।

ফেসবুক পোস্টে আরও জানানো হয়, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন মানুষ এসব কাপড় কিনে নিতে আগ্রহী হয়ে বিদ্যানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। লাখ টাকার পোড়া কাপড় কিনতে চেয়েছেন একজন। অনেকে নাকি জানিয়েছেন, পোড়া পোশাক পরবেন না, তবে কিনে যত্ন করে রেখে দেবেন। এই বিষয়টি নিয়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ প্রধান সালমান খান ইয়াসিন প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, বঙ্গবাজারে বিদ্যুৎ নেই। চার্জার লাইট দিয়েই কাজ সারতে হচ্ছে। প্রচণ্ড ধোঁয়া, আগুন নেভানোর জলও প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে। ব্যবসায়ীরাও কাপড় বিক্রি করার মতো অবস্থায় নেই। যে যতটুকু পারছেন, তাই উদ্ধার করছেন। বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবকেরা ট্রাকে কাপড় তুলে দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করছেন। ব্যবসায়ীদের ক্ষতি যাতে কিছুটা কমানো যায় তাই কাপড় কিনে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ইদের পোশাক বা ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করতে আগ্রহী। পুড়ে যাওয়া একটি লুঙ্গি এক লাখ টাকায় কিনে নেন সে দেশের জনপ্রিয় গায়ক ও অভিনেতা তাহসান খান। একুশে পদকজয়ী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এক উদ্যোগের মাধ্যমে তাহসান এই লুঙ্গিটি কেনেন। এই এক লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত বিক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়ার কথাও ফেসবুক পোস্টে জানানো হয়।

এর পরেই শুরু হয় বিতর্ক! বঙ্গবাজারে ব্যবসায়ীদের সাহায্য করার নামে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কাপড় চুরি করছে বলে অভিযোগ তোলেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। ফেসবুকে প্রকাশিত একটি কোলাজ ছবি ঘিরে বিদ্যানন্দের অন্যান্য কাজ এবং প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস জানিয়েছেন, বিদ্যানন্দের কাজকর্মে কেউ অস্বচ্ছতা পেলে বা প্রতিষ্ঠানটি অনৈতিক কাজ করছে মনে করলে যে কেউ বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারেন। একটি ফেসবুক পেজের পোস্টে ব্যবহার করা ছবি ঘিরে এতখানি দুর্নাম তৈরি হওয়াতে তিনি জানিয়েছেন, বিদ্যানন্দের অন্তত ৮ থেকে ১০টি ফেসবুক পেজ রয়েছে। সব পেজেই প্রায় ৩০ হাজার লেখা আছে, তার মধ্যে ৩০টি লেখাতে ভুল থাকতেই পারে। যারা এই পোস্ট করেছেন তারা সকলেই নবীন স্বেচ্ছাসেবক। সংগঠনের বেতনভুক্ত কেউ নন। ফলে পোস্টের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানের দিকে আঙুল তুললে আইনি পথে সমালোচকদের জবাব দেবেন বলেই জানিয়েছেন কিশোর।

আরও পড়ুন- ঈদের আগে ছাই বঙ্গবাজারের হাজার হাজার দোকান, বারবার কেন আগুনের গ্রাসে বাংলাদেশ?

শুধু পোস্ট নয়, অভিযোগ উঠছে, বিদ্যানন্দ বঙ্গবাজারে কাজ করতে নামায় সম্পূর্ণ আলো বিদ্যানন্দের দিকেই চলে গেছে। বিদ্যানন্দের জন্যই নাকি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে ধরনের প্রতিবাদ হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। অস্বচ্ছতা প্রসঙ্গে কিশোর জানিয়েছেন, পোড়া পোশাক বিক্রি করে বঙ্গবাজার তহবিলে দুই কোটি টাকা জমা হয়েছে। অনুষ্ঠান করেই এই টাকা ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। তাহলে কেন এই অনুষ্ঠান কোথায় হবে, কবে হবে জানানো হচ্ছে না? "আগে থেকে জানানো হলে অনেককেই চাঁদা দিতে হয়। প্রতিষ্ঠান এটি চায় না বলেই আগে থেকে স্থান জানানো হয় না," দাবি কিশোরের।

বিভিন্ন জায়গায় জমি কেনার বিষয়েও আঙুল উঠেছে ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে। শর্ত অনুযায়ী জমি লিজ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন কিশোর। জমিতে অনাথাশ্রম, হাসপাতাল গড়া হচ্ছে, অনাথাশ্রমগুলোতে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা থাকছে, স্থানীয় লোকজনই সেখানে কাজ করছেন। তবে স্থায়ী উদ্যোগের উদ্দেশ্যে নাকি কুড়িগ্রামে মেয়েদের অনাথাশ্রমের জন্য এক একরের বেশি জায়গা এবং রামুতে অনাথাশ্রমের জন্য জমি কিনেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।

আরও পড়ুন- “নবীরও ৪ টে দাঁত ভেঙেছিল”, ঈশ্বর বিশ্বাসীদের কি অসুখ হয় না? তসলিমার যে প্রশ্নে তোলপাড় বিশ্ব…

তবে বঙ্গবাজারের ফেসবুক পোস্ট প্রসঙ্গে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, এক মহিলার তৈরি কিছু গয়নার ছবি দেখেই পোড়া কাপড় দিয়ে গয়না বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। বিদ্যানন্দের ফেসবুক পেজে কোলাজ ছবি দেওয়ার সময় ওই মহিলার তৈরি কয়েকটি গয়নার ছবিও প্রকাশ করা হয়। সমালোচনা শুরু হলে পরে পেজ থেকে তা সরিয়ে ফেলা হয় এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ডাক দিয়ে এমন সমালোচনার অর্থ খুঁজে পাননি তসলিমা নাসরিন! "পোড়া দেশে ভালো কাজের দাম নেই। সত্যিকার দেশপ্রেমের মূল্য নেই," লিখেছেন তসলিমা। তসলিমা বলছেন, দেশের মূর্খ ধর্মান্ধরা বিদ্যানন্দ সংস্থার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে কারণ বিদ্যানন্দ ভালো কাজ করছে, বিদ্যানন্দ নিঃস্বার্থ এবং সৎ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে। এবছরই সমাজসেবায় একুশে পদক পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে চট্টগ্রাম এবং খাগড়াছড়িতে বিদ্যানন্দের শাখা চালু করা হয়। বিদ্যানন্দের মোট ১৭টি শাখা রয়েছে এই মুহূর্তে। কিশোর কুমার দাস চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতক। বর্তমানে তিনি স্ত্রী জ্যাসিকা মারিয়ার সঙ্গে পেরুতেই বাস তাঁর।

সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য বেশ কিছু কাজ করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। বঞ্চিত শিশুদের মৌলিক শিক্ষা প্রদান, এক টাকায় খাবার, চিকিৎসা ও আইনি সেবা প্রদানও করে এই সংস্থা। বিনামূল্যের গ্রন্থাগার, প্রকাশনাও চালায় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বারেবারেই ফেসবুকে এক ছবিকে নানা কাজে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে, অন্যের ছবিকে নিজেদের বলে চালানোর ঘটনাও ঘটেছে। এত বড় প্রতিষ্ঠানের তরফে এমন গাফিলতি কি সত্যিই অনিচ্ছাকৃত ভুল? প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে বাংলাদেশ।

More Articles